মৌলভীবাজার থেকে সংবাদদাতা :
মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলায় পারিবারিক কলহের জের ধরে স্ত্রী-শাশুড়ি এবং দুজনকে হত্যার পর এক যুবক আত্মহত্যা ঘটনায় পুরো পাল্লাথল চা বাগান এলাকায় চা শ্রমিকের মাঝে যেনো শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েছে।
শোকে ভারি হয়ে উঠেছে সেখানকার পরিবেশ। নির্মম এই হত্যাকান্ড অতীতের কোন সময় ঘটেনি এ এলাকায়।
খবর পেয়ে জেলা পুলিশ সুপার মো. ফারুক আহমদ পিপিএম (বার), জেলা প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, পিবিআই, সিআইডির পৃথক টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আলামত সংগ্রহ করেন।
পাল্লাথল চা শ্রমিক লতা রানী কর্মকার বলেন,‘ ঘটনাটি সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনেছি। এই ঘটনায় আমরা আতঙ্কিত। এরকম ঘটনা কোনোদিন আমাদের এখানে ঘটেনি। আর যারা মারা গেছেন তাদের সাথে কারো কোনো বিরোধ ছিল না। এই ঘটনায় আমরা বাকরুদ্ধ।’
নিহত জলি ব্যানার্জির বাবা বিষ্ণু ব্যানার্জি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি অন্য একটা চা বাগানে আমার আরেক মেয়ের সাথে থাকি। সকালে খবর পাই আমার স্ত্রী ও মেয়েসহ পাশের ঘরের আরও দুজনকে আমার মেয়ের জামাই কুপিয়ে হত্যা করেছে। পরে সে নিজে আত্মহত্যা করেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রায় একবছর আগে নির্মলের সাথে আমার মেয়ে জলির বিয়ে হয়। বিয়ের পর তাদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো। আমি তাদের অনেক বুঝানোর চেষ্টা করতাম। কিন্তু তারা আমার কথা শুনতো না।’
যেভাবে হত্যা করা হয়: পাল্লাথল চা বাগানের টিলায় পাশাপাশি দুটি ঘরে বসবাস করতেন নির্মল কর্মকার (৪০) ও প্রতিবেশী বসন্ত (৫৫)। রবিবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে নির্মল ও তার স্ত্রী জলি ব্যানার্জি(৩৫) ঝগড়া-বিবাদ শুরু হয়। এক পর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে জলিকে মারধর শুরু করলে জলি দৌড়ে প্রতিবেশি বসন্তের ঘরের সামনে গিয়ে চিৎকার শুরু করেন। এ সময় নির্মল ক্ষিপ্ত হয়ে ধারালো দা দিয়ে স্ত্রী ও শাশুড়িকে কোপাতে থাকে। ঘাতকের সৎ মেয়ে চন্দনা ব্যানার্জি দৌড়ে গিয়ে বাগানের সবাইকে ঘটনাটি জানালে বাগানের চা শ্রমিকরা বাড়ি ঘিরে ফেলে।
সে সময় পাশের ঘরের বসন্ত ও তার স্ত্রী কানন এবং ও মেয়ে শিউলি এগিয়ে এলে তাদেরকে ও ধারালো দা দিয়ে নির্মল এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। এতে ঘটনাস্থলে চারজনের মারা যায়। পরে ঘাতক নিজে আত্নহত্যা করে। এর মধ্যে আহতবস্থায় নিহত বসন্তের স্ত্রী কাননকে উদ্ধার করে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
নিহতদের লাশ ঘরের মেঝে ও উঠানে পড়ে থাকে। মাটিতে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ লেগে রয়েছে। এই ঘটনায় স্থানীয় এলাকাবাসী বাকরুদ্ধ। এলাকার মানুষজন লাশ দেখতে ওই বাড়িতে ভিড় জমান। দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন মানুষজন।’
সিআইডি পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সিলেট জোন) অপূর্ব সাহা বলেন,আমরা আলামত সংগ্রহ করেছি,যা পরবর্তী কাজে আসে। ঘটনাস্থল কর্ডন করে রাখা হয়েছে।’
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন মৌলভীবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নজরুল ইসলাম বলেন,ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জানতে পেরেছি পারিবারিক কলহের জের ধরে এই হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। ঘাতক নির্মল মাদকাসক্ত ছিলেন। তবে এই ঘটনার সাথে অন্য কিছু আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
পাল্লাথল চা বাগানে ব্যবস্থাপক এবিএম মাহবুবুর রহমান বলেন,নির্মল ও জলি দুইজনের ছিল দ্বিতীয় বিয়ে। বছরখানেক আগে তাদের বিয়ে হয়। তাদের নিজের কোন সন্তান ছিল না। চন্দনা ছিল জলির সাবেক স্বামীর। জলির বাবা বিষ্ণু ব্যানার্জি দীর্ঘদিন ধরে নিজ বাড়িতে না থেকে আরেক বাড়িতে থাকতেন। বিষ্ণু ব্যানার্জির দুই মেয়ের মধ্যে জলি ব্যানার্জি তার স্বামী নির্মল কর্মকার, মা লক্ষ্মী ব্যানার্জি ও চন্দনা নিয়ে বাবার বাড়িতে থাকতেন।’
ঘটনার সময় পালিয়ে বেঁচে যাওয়া চন্দনা বোনার্জি বলেন, ‘হঠাৎ দেখি আমার সৎ বাবা আমার মাকে দা দিয়ে কোপাচ্ছে। আমি এগিয়ে এসে বাধা দিলে আমাকেও বেধড়ক মারধর করে। ততক্ষণে আমার মা, নানিসহ আরও দু’জনকে খুন করে ফেলে সৎ বাবা নির্মল কর্মকার। আমি তখন দৌড়ে পালিয়ে চিৎকার করে ঘটনাটি বলি।’ কি কারনে এ ঘটনাটি ঘটেছে সে বলতে পারছে না।
বড়লেখা উপজেলার পাল্লাথল চা বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক জাকির হোসেন জানান, ঘাতক নির্মল কর্মকার বছরখানেক আগে জলি ব্যানার্জিকে বিয়ে করে ঘরজামাই হিসেবে বসবাস করে আসছিল। সে আমার বাগানের কোনো চা শ্রমিক না। এর আগে সে পাশ্ববর্তী আল্লাদাদ চা বাগানে ছিল।’
মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মো.ফারুক আহমেদ পিপিএম(বার) বলেন, পারিবারিক কলহের জেরে এই ঘটনা। রাতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অনেকক্ষণ ঝগড়া হয়েছিল। এটা শুনেছি। এ থেকেই ঘটনার সূত্রপাত। লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে অধিকতর তদন্ত করা হচ্ছে। ’