কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের আস্থা-বিশ্বাস অর্জন করে জনগণের বাহিনী হিসেবে পুলিশকে গড়ে তুলতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, আসলে পুলিশকে জনতার হতে হবে, জনগণ যেন আস্থা পায়, বিশ্বাস পায়, পুলিশের কাছে দাঁড়াতে পারে। পুলিশের প্রতি আগে মানুষের যে একটা অনীহা ছিল সেটা আর নেই। বরং পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস বেড়েছে। আসলে এটাই সব থেকে বেশি প্রয়োজন। কাজেই আপনারা সেভাবেই কাজ করবেন।
ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের বিভিন্ন দাবি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কোন গ্রেফতারের এখতিয়ার নেই। গ্রেফতারের জন্য তাদের কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদেরই বলতে হবে। তারা নির্দেশ দিতে পারে। তারা (দুদক) ধরে রেখে ওখানে হাজতখানা বানাবে, হাজতে রাখবে এটা কিন্তু দুর্নীতি কমিশনের কাজ নয়। যার যা কাজ তার তা করতে হবেÑ একথা মনে রাখতে হবে।
সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ‘পুলিশ সপ্তাহ-২০’ উপলক্ষে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে দেয়া ভাষণে শেখ হাসিনা এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ট্রেনিং সেন্টারগুলোতে পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিলে তাদের ‘ডাম্পিং প্লেসে ফেলে দেয়া হয়েছে’ বলে ভাবনার সমালোচনা করে বলেন, যারা মেধাবী আসলে তাদেরই সেখানে পদায়ন করা দরকার। কারণ বেসিক নলেজ যদি শক্তিশালী না হয় তাহলে উপযুক্ত লোক আমরা কীভাবে গড়ে তুলব? বিআরটিএ, বিআইডব্লিউটিএ এবং মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরে পুলিশ সদস্যদের প্রতিনিধি থাকা প্রয়োজন এবং তার সরকার সেই উদ্যোগ নেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দুদুকে ইতোমধ্যেই পুলিশ সদস্যদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এসব সংস্থায় পুলিশ প্রতিনিধি থাকা দরকার, আমরা সে ব্যবস্থা নেব।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি আরও উন্নত করার তাগিদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে করে আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা যাতে নিয়ন্ত্রণে থাকে, উন্নত হয়। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখার বড় দায়িত্ব পুলিশ বাহিনীর। পুলিশ বাহিনীকে ধন্যবাদ জানাই আপনারা সেটা করতে পেরেছেন। আপনারা যদি সেটা করতে না পারতেন তাহলে হয়তো এই উন্নয়ন সম্ভব হতো না। এটা হলো বাস্তবতা।
নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে যথাযথ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন এবং অগ্রযাত্রায় অগ্রণী ভূমিকা পালনের জন্যও পুলিশ সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা আপনাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ পালন করে বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা ত্বরান্বিত করবেন। দেশের মানুষের নিরাপত্তার অগ্রাধিকার দিয়ে তিনি বলেন, এবার আপনারা মুজিববর্ষে পুলিশ সপ্তাহের যে প্রতিপাদ্য ‘মুজিববর্ষের অঙ্গিকার, পুলিশ হবে জনতার’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় জরুরী সেবা ‘৯৯৯’ চালু হওয়ায় মানুষের মাঝে একটা আত্মবিশ্বাস এসেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কোথাও কেউ কোন অন্যায় দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে ফোন করছে এবং পুলিশ সেখানে পৌঁছে যাচ্ছে, ব্যবস্থা নিচ্ছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের অর্থনীতি যত শক্তিশালী ও মজবুত হবে তত বেশি আমরা আমাদের সকল প্রতিষ্ঠানকে আরও উন্নত করতে পারব। আজ বাংলাদেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল এবং উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে। এটা আমাদের ২০২৪ সাল পর্যন্ত ধরে রাখতে হবে যাতে উন্নয়নশীল দেশের স্থায়ী স্বীকৃতি অর্জন করতে পারি। তিনি বলেন, পঁচাত্তরের পর অনেকের ধারণা ছিল আওয়ামী লীগ আর জীবনে সরকার গঠন করতে পারবে না। কিন্তু বাংলার জনগণের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা জানাই। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সহায় ছিলেন বলেই এতবড় একটা গুরুদায়িত্ব নিতে পেরেছি এবং দেশটাকে উন্নত করতে পেরেছি।
প্রধানমন্ত্রী ’২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ’২১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনকালকে ‘মুজিববর্ষ’ হিসেবে তার সরকারের ঘোষণার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, বাংলাদেশ বর্তমানে ক্ষুধামুক্ত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখনও যারা দরিদ্র বা গৃহহীন, কর্মক্ষমতাহীন তাদের প্রত্যেকের জীবনমানটা যাতে উন্নত হয়, তারা কেউ যেন ক্ষুধার কষ্টে না ভোগে, রোগে শোকে কষ্ট না পায়। তিনি বলেন, সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলোর মধ্য দিয়েই মানুষকে একটা সুন্দর জীবন উপহার দেয়াই তার সরকারের লক্ষ্য।
তিনি বলেন, স্বাধীনতার মূল্যবোধ পঁচাত্তরের পর যেটা আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম তা আজ আবার ফিরে পেয়েছি। মানুষের মনে আজ স্বাধীনতার মূল্যবোধ জাগ্রত। আবার সেই নতুন চেতনা নিয়েই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। সকলকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের স্বাধীনতার মূল্যরোধটা আর যেন হারিয়ে না যায়। এই অগ্রযাত্রা ভবিষ্যতে যাতে কেউ আর ব্যাহত করতে না পারে। ইনশাল্লাহ বাংলাদেশকে আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করব।
পুলিশ সদস্যদের জন্য পৃথক মেডিক্যাল কোর স্থাপনের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পুলিশে কিন্তু মেধাবীরাই আসে। ব্যারিস্টার আসে, ডাক্তার আসে, আবার ইঞ্জিনিয়ারও আসে। কিন্তু আমি মনে করি পুলিশের জন্য একটি পৃথক মেডিক্যাল কোর করা প্রয়োজন। পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসক নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে বিড়ম্বনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসকরা আসতে চান না। কাজেই পুলিশের মধ্যে যে ডাক্তার রয়েছে তাকে খুঁজেই সেখানে অনেকসময় দায়িত্ব দিতে হয়।
তিনি বলেন, কাজেই আপনারা যদি আলাদা একটা ইউনিট করে ফেলেন ডাক্তারদের জন্য তাহলে আপনাদের চিকিৎসারই সুবিধা হবে। তিনি বলেন, পুলিশ সদস্যদের জন্য সরকারী হাসপাতালে ফ্রি চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও পুলিশের জনবল বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে পৃথক ইউনিট করে নিতে পারলে ভাল হবে। এই পৃথক ইউনিটের দাবি কিন্তু আপনারা করেননি কিন্তু আমি আপনাদের পক্ষ থেকেই দাবিটা করলাম।
শিল্পাঞ্চল পুলিশসহ বিভিন্ন বিশেষায়িত পুলিশ ইউনিট বিভিন্ন জায়গায় খোলায় পুলিশ কর্মকর্তাদের পদায়ন এবং পদোন্নতির সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা একশ’ শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলেছি। কাজেই আমাদের শিল্প পুলিশকে আরও শক্তিশালী করতে হবে এবং এখানে নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিতে হবে, সেটা আমরা করব। একটি দেশের উন্নয়নে জননিরাপত্তার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যদি ঠিকমত তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে তখনই সেটা সম্ভব। আর আপনারা এটা করতে পেরেছেন বলেই আজকে আমরা উন্নতি করতে পেরেছি। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, পুলিশের জন্য আমরা যেটুকু করেছি তা আমাদের চিন্তা থেকেই করেছি। এজন্য কোন দাবি বা তেমন কিছু করতে হয়নি। পুলিশ সদস্যদের বিভিন্ন দাবির প্রেক্ষিতে তিনি জনবল বৃদ্ধির সঙ্গে আনুপাতিকহারে পদ সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তাও স্বীকার করেন। পুলিশ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বর্তমানে বেড়ে দুই লাখ ২২ হাজার ৭২১ জনে উন্নীত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পুলিশ সদস্যদের রিক্রুটমেন্টের সময় শুধু নয়, পদোন্নতির সময়ও ট্রেনিংয়ের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তিনি বলেন, যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অপরাধের ধরন ও প্রকৃতি পাল্টাচ্ছে। কাজেই এর সঙ্গে তাল রেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও ট্রেনিং দরকার। আমরা যে কারণে ট্রেনিংকে গুরুত্ব দিচ্ছি। আমরা কিন্তু ট্রেনিংয়ের ওপর সব থেকে গুরুত্ব দেই।
বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধের নামে ‘অগ্নিসন্ত্রাসের’ সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা দেখেছি জ্বালাও-পোড়াও, হরতাল-অবরোধের নামে মানুষ খুন করা। এমনকি পুলিশ সদস্যদের হত্যা করা, ধরে পেটাচ্ছে, মারছে। পুলিশের গাড়িতে আগুন দিচ্ছে। সেই ভয়াবহ দৃশ্যও আমরা দেখেছি। বিএনপি-জামায়াতের হাত থেকে কেউ রেহাই পায়নি। আমাদের হাজার হাজার নেতাকর্মীর হাতকাটা, তাদের চোখ তুলে ফেলা, হাতুড়ি দিয়ে হাড় গুঁড়ো গুঁড়ো করে মারা- এরকম বহু ঘটনা এবং নৃশংসতা আমরা দেখেছি। এসব অবস্থাও মোকাবেলা করে আজকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এখন বাংলাদেশ সারাবিশ্বে প্রবৃদ্ধি অর্জনে অনেক ওপরে উঠে আছে। ৮ দশমিক ১৫ ভাগ আমরা প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। মাথাপিছু আয় দুই হাজার ডলারের কাছাকাছি চলে এসেছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দীন ও আইজিপি ড. জাভেদ পাটোয়ারী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। এছাড়া অনুষ্ঠানে ডিএমপি কমিশনার সফিকুল ইসলাম, চট্টগ্রামের সহকারী পুলিশ কমিশনার আমেনা বেগম, খুলনার পুলিশ কমিশনার খন্দকার লুৎফুল কবির ও ময়মনসিংহ রেঞ্জের ডিআইজি ব্যারিস্টার হারুনুর রশিদ পুলিশের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া প্রধানমন্ত্রীর সামনে তুলে ধরেন।