॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥
আমাদের সামনে এসে গেছে অতি ফযীলতের একটি মাস মাহে শা’বান। প্রিয় নবীজী এ মাসেও দোয়া করতেন, যেভাবে রজব মাসে দোয়া করতেন: ‘‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফী রজব ওয়া শা’বান ওয়া বাল্লিগনা রামাদ্বান।’’ অর্থ: হে আল্লাহ আমাদের জন্য রজব ও শাবান মাসকে বরকতময় করে দিন। আর আমাদেরকে রামাদ্বান পাওয়ার তাওফিক দিন। আমীন।
শা’বান মাসে তিনি অনেকগুলো নফল রোজা রাখতেন। আয়েশা (রা:) বর্ণনা করেন: “আমি প্রিয় নবী (স:)কে রমাদ্বান ছাড়া আর কোন পূর্ণ মাসের রোযা রাখতে দেখিনি। আর শাবান মাস ছাড়া আর কোন মাসে এত অধিক পরিমাণ নফল রোজা রাখতে দেখিনি”।-(বোখারী ও মুসলিম) সাহাবী উসামা বিন যায়েদ (রা:) বর্ণনা করেন: আমি প্রিয় নবীজী (স:) কে জিজ্ঞেস করলাম: ইয়া রাসূলুল্লাহ! (স:) শাবান মাসে আপনি যত নফল রোয়া রাখেন অন্য কোন মাসে আপনাকে এত নফল রোজা রাখতে দেখিনা। প্রিয় নবীজী (স:) এরশাদ করলেন: রজব ও রামাদ্বান, এ দুটো মাসের মাঝখানের এ মাসটি সম্পর্কে অনেকেই আসলে গাফেল হয়ে থাকেন। এ মাসে মানুষের আমলের (বার্ষিক রিপোর্ট) আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়। আমি চাই আমার আমল যখন পেশ করা হয় আমি যেন তখন রোজার হালতে থাকি।-(আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে খোযাইমা)। তবে শাবান মাসের ১৫ তারিখে শুধু একটি রোজা রাখার ব্যাপারে কোন সহীহ হাদীস পাওয়া যায় না। আর আমাদের সামনে আসছে মধ্য শাবানের রাতটি। যা অনেক দেশে শবে বরাত নামে পরিচিত। এ রাতের ফযীলত ও আমল সম্পর্কে অন্যান্য বৎসরের মত এবারও আপনাদের খেদমতে কিছু বিস্তারিত আলোচনা পেশ করতে চাই। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফিক দিন। আমীন
প্রত্যেক মুসলমানই অবগত আছেন ইসলামী শরীয়তের মূল উৎস দু’টি কুরআন ও হাদীস। কুরআন ও হাদীসে যে ইবাদতের যতটুকু গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, তার চেয়ে একটু বেশি বা কম গুরুত্ব দেয়ার কোন অধিকার কোন মুসলিমের নেই। শবে বরাত নামক বিষয়টি কুরআন করীমে আদৌ উল্লেখ করা হয়নি। এটাই হচ্ছে উম্মতের মুহাক্বিক আলিম ও ইমামদের মতামত। কেউ কেউ দাবী করে থাকেন সূরা আদ্-দোখানে “লাইলাতুম্ মুবারাকাহ’’- বরকতময় রাত বলতে, শবে বরাতকেই বুঝানো হয়েছে। এ ব্যাপারে তাফ্সীরে ইবনে কাছীর, কুরতুবী ইত্যাদির রেফারেন্সও দেয়া হয়্ আসুন আমরা চেক করে দেখি নির্ভরযোগ্য তাফসীর গ্রন্থ সমূহে এ ব্যাপারে কি বলা হয়েছে। লিখার কলেবর যাতে বৃদ্ধি না হয়ে যায়, সে জন্য যথাসম্ভব তাফ্সীরের সার সংক্ষেপ পেশ করা হচ্ছে: ইমাম ইবনে কাছীর (র:) বলেন, বরকতময় রাত বলতে সূরা দোকানে শবে ক্বদরকে বোঝানো হয়েছে। কারণ এখানে কুরআন নাযিলের কথা বলা হয়েছে। আর সেটা তো সূরা ক্বদর এ স্পষ্ট করেই বলা আছে। আর কুরআন রামাদ্বান মাসেই নাযিল হয়েছে সেটাও সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে সূরা বাকারায়। তিনি আরো বলেন, কেউ যদি বলে, বরকতময় রাত বলতে মধ্য শাবানের রাত বুঝানো হয়েছে যেমনটি ইকরিমা কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে, তাহলে সে প্রকৃত সত্য থেকে অনেক দূরে অবস্থান করলো। শবে বরাতে মানুষের হায়াত, মাউত ও রিযকের বার্ষিক ফায়সালা হওয়া সংক্রান্ত যে হাদীসটি উসমান বিন মুহাম্মদ কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে, সে সম্পর্কে তিনি বলেছেন, হাদীসটি মুরসাল। অর্থাৎ হাদীসের প্রথম বর্ণনাকারী হিসেবে যে সাহাবী রাসূলুল্লাহ (স:) থেকে হাদীসটি শুনেছেন তার কোন উল্লেখ নেই। ফলে এমন দুর্বল হাদীস দিয়ে কুরআন ও সহীহ হাদীসের অকাট্য বক্তব্যকে খন্ডন করা যায় না। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন- তাফসীর ইবনে কাছীর, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৩১৬১)।
ইমাম কুরতুবী ঃ ইমাম কুরতুবী বলেন, বরকতময় রাত্রি বলতে ক্বদরের রাতকে বোঝানো হয়েছে। যদিও কেউ বা বলেছেন সেটা হচ্ছে মধ্য শাবানের রাত। ইকরিমাও বলেছেন সেটি হচ্ছে মধ্য শাবানের রাত। তবে, প্রথম মতটি অধিকতর শুদ্ধ। কেননা, আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, আমি এ কুরআনকে লাইলাতুল ক্বদর এ নাযিল করেছি। এ প্রসঙ্গে মানুষের হায়াত, মাউত, রিযক ইত্যাদির ফায়সালা শবে বরাতে সম্পন্ন করা হয় বলে যে রেওয়ায়েত এসেচে, সেটাকে তিনি অগ্রহণযোগ্য বলে বর্ণনা করেন। তিনি পুনরায় উল্লেখ করেন, সহীহ শুদ্ধ কথা হচ্ছে এ রাতটি লাইলাতুল ক্বদর।
অত:পর তিনি প্রখ্যাত ফকীহ কাযী আবু বকর ইবনুল আরাবীর উদ্ধৃতি পেশ করেন, ‘‘জমহুর আলিমদের মতামত হচ্ছে এ রাতটি লাইলাতুল ক্বদর। কেউ কেউ বলতে চেয়েছেন এটা মধ্য শাবানের রাত। এ কথাটি একেবারেই বাতিল। কারণ আল্লাহ স্বয়ং তার অকাট্য বাণী কুরআনে বলেছেন, রামাদ্বান হচ্ছে ঐ মাস যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে। যেথায় তিনি মাস উল্লেখ করে দিয়েছেন। আর বরকতময় রাত বলে লাইলাতুল ক্বদরকে উল্লেখ করে দিয়েছেন। যে ব্যক্তি এ রাতটাকে রামাদ্বান থেকে সরিয়ে অন্য মাসে নিয়ে যায়, সে মূলত আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে বসে। মধ্য শাবানের রাতটির ফযীলত এবং এ রাতে হায়াত, মাউতের ফায়সালা সংক্রান্ত কোন একটি হাদীসও সহীহ এবং নির্ভরযোগ্য নয়। কাজেই কেউ যেন সেগুলোর প্রতি দৃষ্টিপাত না করে। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন: তাফসীরে কুরতুবী ১৬শ’ খন্ড, পৃষ্ঠা: ১২৬-১২৮)। ইমাম তাবারী তাফসীরে তাবারীতে বরকতময় রাতের তাফসীরে উল্লেখ করেন: কাতাদাহ (র:) বর্ণিত এ রাতটি লাইলাতুল ক্বদর এর রাত। প্রতি বৎসরের শাবানের মতামতটিও উল্লেখ করেন। পরিশেষে তিনি মন্তব্য করেন : লাইলাতুল ক্বদর এর মতটিই শুদ্ধ ও সহীহ। কারণ এখানে কুরআন নাযিলের কথা বলা হয়েছে। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন : তাফসীরে তাবারী ১১ খন্ড, পৃষ্ঠা: ২২১-২২৩)।
তাফসীরে আদওয়াউল বায়ান ঃ আল্লামা মুহাম্মদ আল আমীন আশ শিনকীতী (র:) সূরা দোখানের বরকতময় রাতের তাফসীরে বলেন, এটি হচ্ছে রামাদ্বান মাসের ক্বদরের রাত। মধ্য শাবানের রাত হিসেবে সেটিকে বোঝানো হয়েছে মনে করা, যেমনটি ইকরিমা কর্তৃক বর্ণিত রেওয়াতে বলা হয়েছে, একটি মিথ্যা দাবী ছাড়া আর কিছু নয়। কুরআনের সুস্পষ্ট বক্তব্যের বিরোধী এ দাবীটি নি:সন্দেহে হকের বিপরীত যে কোন কথাই বাতিল। কুরআনের সুস্পষ্ট বক্তব্যের বিরোধী যে হাদীসগুলো কেউ কেউ বর্ণনা করে থাকেন, যাতে বলা হয় এ রাতটি হচ্ছে মধ্য শাবানের রাত, সে হাদীসগুলোর কোন ভিত্তি নেই। সেগুলোর কোনটার সনদই সহীহ নয়। ইবনুল আরাবী সহ অনেক মুহাক্বীক আইম্মায়ে কেরাম এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে বলেছেন- বড়ই আফসোস ঐসব মুসলমানদের জন্য যারা কুরআনের সুস্পষ্ট বক্তব্যের বিরোধীতা করে কুরআন বা সহীহ হাদীসের দলিল ছাড়াই। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন: আদওয়াউল বায়ান, ৭ম খন্ড, পৃ: ৩১৯)। উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম মুফতী শফী (র:) এ বিষয়ে মা’আরেফুল কুরআনে বলেন, বরকতময় রাত বলতে অধিকাংশ তাফসীরবিদদের মতে এখানে শবে ক্বদর বোঝানো হয়েছে যা রামাদ্বান মাসের শেষ দশকে হয়। কেউ কেউ আলোচ্য আয়াতে বরকতের রাত্রির অর্থ নিয়েছেন শবে বরাত। কিন্তু এটা শুদ্ধ নয়। কেননা, এখানে সর্বাগ্রে কুরআন অবতরণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর কুরআন যে রামাদ্বান মাসে নাযিল হয়েছে, তা কুরআনের বর্ণনা দ্বারাই প্রমাণিত। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন: মা’আরিফুল কুরআন, পৃষ্ঠা: ১২৩৫)।
প্রিয় পাঠক, লক্ষ্য করুন প্রতিটি তাফসীরেই ইকরিমা কর্তৃক বর্ণিত শবে বরাতের বর্ণানাটিকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। আর কুরআনের অন্যান্য আয়াত দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত করা হয়েছে এটি হচ্ছে লাইলাতুল ক্বদর। কুরআন দিয়েই কুরআনের তাফসীর গ্রহণ করার সুযোগ থাকলে সেটাই গ্রহণ করতে হবে। এটাই ওলামায়ে উম্মতের এজমাহ। তারপরও কি এ বিষয়ে আর কোন বিতর্কের অবকাশ থাকে? কুরআনে শবে বরাতের কোন উল্লেখ নেই, এ বক্তব্যটি সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এবার আমরা দেখি হাদীস শরীফে কি আছে। শবে বরাত সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসগুলো দু’প্রকার: প্রথমত: শবে বরাতে কত রাকাত নামায পড়তে হবে, সূরা ইখরাস, আয়াতুল কুরসী প্রতি রাতে কতবার পড়তে হবে ইত্যাদি এবং সে আমলগুলোর বিস্তারিত ছওয়াবের ফিরিস্তি সংক্রান্ত হাদীসগুলো একেবারেই জাল এবং বানোয়াট। আর দ্বিতীয় প্রকার হাদীস হলো এ রাতের ফযীলত, ইবাদতের গুরুত্ব ইত্যাদি বিষয়ে। এসব হাদীসগুলোর কোনটাই সহীহ হিসেবে প্রমাণিত হয়নি। বরং সবগুলোই দ্বায়ীফ (দুর্বল)। তবে সবগুলোই মাউদু (জাল বা বানোয়াট নয়)
এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার। ছিহাহ্ ছিত্তা (ছয়টি গ্রন্থের) সবগুলো হাদীসই কি সহীহ? হাদীস বিশারদগণ প্রায় একমত যে বুখারী ও মুসলিম এ দুটো গ্রন্থের সবগুলো হাদীসই সহীহ পর্যায়ের। কোন দ্বায়ীফ (দুর্বল) হাদীসের অবকাশ নেই এ দুটো গ্রন্থে। আর বাকী ৪টি গ্রন্থের অধিকাংশ হাদীসগুলো সহীহ। তবে, বেশ কিছু সংখ্যক দ্বায়ীফ (দুর্বল) হাদীসও রয়েছে সেগুলোর মধ্যে। শবে বরাত সংক্রান্ত কোন একটি হাদীসও বুখারী ও মুসলিম গ্রন্থদ্বয়ে আসেনি। আর বাকি ৪টি গ্রন্থে বা অন্যান্য আরও কিছু গ্রন্থে এ সংক্রান্ত যে হাদীসগুলো এসেছে, তার একটিও সহীহ হাদীসের মানদন্ডে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। শবে বরাত সংক্রান্ত কয়েকটি হাদীস হাদীস বিশারদদের মন্তব্য সহকারে উল্লেখ করা হলো : ১) আলী (রা:)’র বরাত দিয়ে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (স:) এরশাদ করেছেন, ১৫ই শাবানের রাতে তোমরা বেশি বেশি করে ইবাদত করো এবং দিনের বেলায় রোযা রাখ। এ রাতে আল্লাহ তা’আলা সূর্যাস্তের সাথে সাথেই দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন। বলতে থাকেন ঃ কে আছ আমার কাছে গুনাহ মাফ চাইতে। আমি তাকে মাফ করতে প্রস্তুত। কে আছ ‘রিযক চাইতে’! আমি তোকে রিযক দিতে প্রস্তুত। কে আছ বিপদগ্রস্ত! আমি তাকে বিপদমুক্ত করতে প্রস্তুত। কে আছ… এভাবে (বিভিন্ন প্রয়োজনের নাম নিয়ে) ডাকা হতে থাকে সুবহে সাদেক পর্যন্ত।” ইবনে মাজাহ কর্তৃক হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে।
এ হাদীসটি যে আদৌ সহীহ নয় সে মন্তব্য করতে গিয়ে প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ ইমাম হাফেয শিহাবুদ্দিন যাওয়ায়েদে ইবনে মাজাহ গ্রন্থে উল্লেখ করেন হাদীসটির সনদ দ্বায়ীফ (দুর্বল)। কারণ অনির্ভরযোগ্য। এমন কি ইমাম আহমদ বিজন হাম্বল এবং প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ ইবনু মাঈন তার মাজাহ, মন্তব্য ও সম্পাদনা, মুহাম্মদ ফুয়াদ আব্দুল বারী, পৃ: ৪৪৪)।
২) আয়েশা (রা:) বরাত দিয়ে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আমি এক রাতে দেখতে পাই যে, রাসূলুল্লাহ (স:) আমার পাশে নেই। আমি উনার সন্ধানে বের হলাম। দেখি যে তিনি জান্নাতুল বাকী (কবর স্থানে) অবস্থান করছেন। ঊর্ধ্বাকাশের পানে তার মন্তক ফেরানো। আমাকে দেখে বললেন, আয়েশা, তুমি কি আশংকা করেছিলে যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (স:) তোমার প্রতি অবিচার করছেন। আয়েশা (রা:) বললেন, এমন ধারণা করিনি, তবে মনে করেছিলাম, আপনার অন্য কোন বিবির সান্নিধ্যে গিয়েছিলেন কিনা! রাসূলুল্লাহ (স:) বললেন, আল্লাহ তা’আলা ১৫ই শাবানের রাতে দুনিয়ার আকাশে নেমে আসে এবং কালব গোত্রের সমুদয় বকরীর সকল পশমের পরিমাণ মানুষকে মাফ করে দেন। (তিরমিযী/ ইবানে মাজাহ)। ইমাম তিরমিযী হাদীসটি বর্ণনা করে নিজেই মন্তব্য করেছেন, আয়েশা (রা:) বর্ণিত এ হাদীসটি হাজ্জাজ বিন আরতাআহ্ ছাড়া আর কেউ বর্ণনা করেছেন বলে জানা নেই।
ইমাম বোখারী বলেছেন, এ হাদীসটি দ্বায়ীফ (দুর্বল)। হাজ্জাজ বিন আরতাআহ্ বর্ণনা করেছেন ইয়াহ্ইয়া বিন আবি কাছীর থেকে। অথচ হাজ্জাজ ইয়াহ্ইয়া থেকে আদৌ হাদীস শুনেননি। ইমাম বোখারী আরও বলেছেন, এমন কি ইয়াহ্ইয়া বিন আবি কাছীর ও ওরওয়া থেকে আদৌ কোন হাদীস শুনেননি। (দেখুন জামে তিরমিযী, ছাওম অধ্যায়, মধ্য শাবানের রাত, পৃ: ১৬৮-১৬৫)।
৩) আবু মুছা আশআরী (রা:) থেকে বর্ণিত: রাসুলুল্লাহ (স:) বলেছেন, ১৫ই শাবানের রাতে আল্লাহ তা’আলা নীচে নেমে আসেন, বরং সকল মাফলুককেই মাফ করে দেন। তবে মুশরিক এবং মানুষের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টিকারীকে মাফ করেন না- (ইবনে মাজাহ)। এ হাদীসটির ব্যাপারে হাফেয শিহাবুদ্দীন তাঁর যাওয়ায়েদে ইবনে মাজাহ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, এর সনদ দ্বাইফ (দুর্বল) একজন রাবী (বর্ণনাকারী) আব্দুল্লাহ বিন লাহইয়াআহ নির্ভরযোগ্য নন। আরেকজন রাবী ওয়ালিদ বিন মুসলিম তাদলীছকারী (সনদের মধ্যে হেরফের করতে অভ্যস্ত) হিসেবে পরিচিত। প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ আছ্ছিন্দী বলেছেন, এ হাদীসের আরেকজন রাবী আদ্দাহ্হাক কখনো আবু মুছা থেকে হাদীস শুনেননি। শবে বরাত সংক্রান্ত বিষয়ে বর্ণিত সবগুলো হাদীসের সনদের মধ্যেই এ জাতীয় দুর্বলতা বিদ্যামান থাকার কারণে একটি হাদীস ও সহীহর’র মানদন্ডে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। লিখার কলেবর বৃদ্ধি হওয়ার আশংকায় আমরা বাকি হাদীসগুলো বা তদসংক্রান্ত মন্তব্য উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকছি।
এবার প্রশ্ন আসে দ্বায়ীফ (দুর্বল) হাদীসের ভিত্তিতে কোন আমল করা যায় কি না? অধিকাংশ মুহাদ্দীসের মতে দ্বায়ীফ হাদীসের কোন আমলা করা শরীয়তে জায়েয নেই। অধিকাংশ ফোকাহা ও আইম্মায়ে কেরাম দ্বায়ীফ (দুর্বল) হাদীস দ্বারা শর্ত সাপেক্ষে আমল করা যেতে পারে বলে মত দিয়েছেন। সেগুলো নিম্নরূপ: খুব বেশি দ্বায়ীফ (দুর্বল) পর্যায়ের না হওয়া, শুধুমাত্র ফাযায়েল অধ্যায়ের হওয়া, আমল করার সময় সহীহভাবে প্রমাণিত হওয়ার সুস্পষ্ট ধারণা না রাখা, কুরআন ও সহীহ হাদীসের কোন বক্তব্যের সাথে সাংঘর্ষিক না হওয়া। বরং কুরআন বা সহীহ হাদীসের বক্তব্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল হওয়া। উক্ত মূলনীতিগুলোর আলোকে শবে বরাতের আমল করা যেতে পারে অনেক ওলামায়ে কেরাম মতামত দিয়েছেন। এখন প্রশ্ন আসে আমল করতে হলে কিভাবে করা যাবে।
প্রথমত: ব্যক্তিগতভাবে কিছু ইবাদত বন্দেগী করা যেতে পারে। সেজন্য মসজিদে সমবেত হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করার জন্য ওয়ায, নসীহত, যিকির ইত্যাদির আয়োজন করা যাবে না (দেখুন-ফাতাওয়া শামীয়া, ইমাম বিন আবেদীন, পৃ: ৬৪২)। কারণ রাসূলুল্লাহ (স:) এবং সাহাবায়ে কিরামগণ এমনটি করেননি। তাই সে ত্বরীকার বাইরে ইবাদতের আনুষ্ঠানিকতা আবিষ্কার করলে সেটা হয়ে যাবে বিদ্আত।
দ্বিতীয়ত: হায়াত, মাউত, রিযক ইত্যাদির ফায়সালা এ রাতে হয়, এটা বিশ্বাস করা যাবে না। কারণ, এসব ফায়সালা লাইলাতুল ক্বদরে হয়, তা সুস্পষ্টভাবে কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
তৃতীয়ত: আমাদের দেশে আলোকসজ্জা ও আতশবাজীর যে তামাশা করা হয়, তা স্স্পুষ্ট বিদ্আত। সে ধারণা থেকেই কোন কোন এলাকায় এ রাতের নাম হচ্ছে বাতির রাত। এসব ধারণা ইসলামী শরীয়তে হিন্দুদের দিওয়ালী অনুষ্ঠান থেকে এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (র:)। হালুয়া, রুটি, বিলি বন্টনের কার্যক্রমও বিদআত (দেখুন-ফাতওয়া শামীয়া, ইমাম বিন আবেদীন পৃ : ৬৪২)। ইবাদতের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। এসব অনেক আমল শিয়াদের কাছ থেকে উপমহাদেশের মুসলমানরা গ্রহণ করেছেন বলে মুফতি রশীদ আহমদ লুধিয়ানী উল্লেখ করেছেন (দেখুন সাত মাসায়েল : শবে বরাতে শিয়াদের ভ্রষ্টতা, পৃ: ৩৯-৪২)।
চতুর্থত : নফল ইবাদতের জন্য সারা রাত মসজিদে এসে জেগে থাকা রাসূল (স:) এর সুন্নাত বিরোধী। তিনি নফল ইবাদত ঘরে করতে এবং ফরয নামায জামাআতের সাথে মসজিদে আদায় করতে তাগিদ করেছেন। আর সারারাত জেগে থেকে ইবাদত করাটাও সুন্নাত বিরোধী। প্রিয় নবীজী (স:) সব রাতেই কিছু অংশ ইবাদত করতেন, আর কিছু অংশ ঘুমাতেন। ওনার জীবনে এমন কোন রাতের খবর পাওয়া যায়না, যাতে তিনি একদম না ঘুমিয়ে সারা রাত জেগে ইবাদত করেছেন।
পঞ্চমত : শবে বরাতের দিনের বেলায় রোযা রাখার হাদীস একেবারেই দুর্বল। এর ভিত্তিতে আমল করা যায় না বলে পাকিস্তানের প্রখ্যাত আলেম ও ফকীহ মুফতী মাওলানা তাকী উসমানী সাহেবের সুস্পষ্ট ফাতওয়া রয়েছে। শবে বরাতে কবর জিয়ারত সহ ইত্যাদি অনেকগুলো আমলের কোন সহীহ দলিল না থাকার কারণে উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম ও ফকীহ মুফতী রশীদ আহমদ লুধিয়ানী হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (র:)’র সাথে বহু বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন। মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (র:) শেষের দিকে কিছু কিছু বিষয় অবশ্য প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
ষষ্ঠত : শবে বরাতের রোজার পক্ষে যেহেতু কোন মজবুত দলিল নেই, তাই যারা নফল রোজা রাখতে চান তারা আইয়ামে বীদ্বের তিনটি রোজা ১৩, ১৪ ও ১৫ রাখতে পারেন। এর পক্ষে সহীহ হাদীসের দলিল রয়েছে। শুধু একটি না রেখে এ তিনটি বা তার চেয়েও বেশি রোজা রাখতে পারলে আরও ভাল। কারণ, শাবান মাসে রাসূলুল্লাহ (স:) সবচেয়ে বেশি পরিমাণ নফল রোজা রেখেছেন। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে সহীহ হাদীসের উপর আমল করার তাওফিক দিন-আমীন।