এবারের কাউন্সিল ॥ দল ও সরকারকে আলাদা করার চেষ্টায় সফল আওয়ামী লীগ

11

কাজিরবাজার ডেস্ক :
এবারের কাউন্সিলের মাধ্যমে সরকার ও দলকে আলাদা করার চেষ্টায় অনেকটাই সফল হয়েছে আওয়ামী লীগ। এতে দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দূরদর্শিতারই প্রতিফলন ঘটছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এই প্রচেষ্টার মাধ্যমে সরকার যেমন গতিশীল হবে তেমনি দল হিসেবে আওয়ামী লীগও শক্তিশালী হবে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, দল ও সরকারকে আলাদা করার প্রচেষ্টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার আরও সফল হয়েছেন। এ উদ্যোগ যদি সফল হয় তবে আগামী দিনে এই চেষ্টা আরও বাড়বে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বছরচারেক আগে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা ধারণা দিয়েছিলেন যে, মন্ত্রিসভার সদস্যদের খুব বেশি দলীয় পদে রাখা হবে না। অর্থাৎ রাজনৈতিক দল এবং সরকারের মধ্যে একটি সীমারেখা টানতে চাইছেন তারা। কিন্তু ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলের পর গত চার বছরে সেটির প্রতিফলন তেমন একটা দেখা যায়নি। এবার দল ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য তৈরির চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়েছে।
গত ২১ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলন শেষে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির ৪২ সদস্যের নাম ঘোষণা করা হয়। আর ২৬ ডিসেম্বর ঘোষণা করা হয় ৩২ সদস্যের নাম। সব মিলিয়ে ৮১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটির ৭৪ সদস্যের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। আর বাকি আছে ৭টি পদ। এগুলো হলো সাংগঠনিক সম্পাদক, ধর্ম এবং শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক ৩টি সম্পাদকীয় পদ, কোষধ্যক্ষ ও নির্বাহী কমিটির ৩টি পদ।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, মন্ত্রিসভার ৯ সদস্য বাদ পড়েছেন। নতুন মুখ এসেছেন ১৬ জন। এছাড়া কিছু দায়িত্ব অদলবদল করা হয়েছে। নতুনদের দায়িত্বে নিয়ে এসে তাদের দায়িত্বশীল ও দক্ষ করে গড়ে তোলার একটি প্রচেষ্টা যেমন দেখা যাচ্ছে তেমনি মন্ত্রিসভার ৯ সদস্যকে বাদ দিয়ে তাদের সরকার পরিচালনায় দক্ষ করার চেষ্টাও প্রতিফলিত হয়েছে।
তবে সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, কমিটিতে নারী নেতৃত্ব বেড়েছে। নারীর ক্ষমতায়নে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তার প্রতিফলন ঘটেছে নতুন কমিটিতে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ২০২০ সালের মধ্যে সব স্তরের নেতৃত্বে ৩৩ শতাংশ নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রেও এই বিষয়টির উল্লেখ আছে। যদিও এবার গঠনতন্ত্র সংশোধন করে সময়সীমা ২০২১ সাল করা হয়েছে। উল্লেখ্য, নতুন কমিটিতে এখন পর্যন্ত ১৯ নারী নেত্রী আছেন। শতকরা হিসেবে যা দাঁড়ায় ২৫.৬৭ শতাংশ। আগের কমিটিতে নারীর সংখ্যা ছিল ১৫ জন।
সর্বশেষ কাউন্সিলে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের ‘সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণের ফোরাম’ প্রেসিডিয়ামের মাত্র একজন সদস্য মন্ত্রিসভায় আছেন। তিনি হচ্ছেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। অথচ ২০১৬ সালের কাউন্সিলের পর অন্তত চারজন প্রেসিডিয়াম সদস্য মন্ত্রিসভায় ছিলেন। কেন্দ্রীয় যে কমিটি তখন হয়েছিল তাতে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা এবং সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ মন্ত্রিসভার অন্তত আটজন সদস্য ছিলেন। কিন্তু ২০১৯ সালের কমিটিতে সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকসহ মন্ত্রিসভায় আছেন পাঁচ সদস্য। এরা হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি এবং তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার কারণে দল অনেকটাই সরকারে বিলীন হয়ে যাচ্ছিল। দল ও সরকার একাকার হয়ে গেলে মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়, জনবিচ্ছিন্নতাও বাড়তে থাকে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা নেতাদের ব্যর্থতার দায়ভাগ বহন করতে হয় দলকেই। একই ব্যক্তি মন্ত্রী, এমপি ও দলে থাকলে ক্ষমতার ভারসাম্যও নষ্ট হয়। একই ব্যক্তি সবক্ষেত্রে থাকলে আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে অসন্তোষও সৃষ্টি হয়। এসব চিন্তা থেকেই দল ও সরকারকে আলাদা করার চেষ্টা করা হযেছে। আশা করা হচ্ছে, এই প্রচেষ্টা আওয়ামী লীগের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে।
তারা আরও বলছেন, চার বছর ধরেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দল ও সরকারকে আলাদা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। দল ও সরকারকে আলাদা করার সেই প্রচেষ্টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার আরও সফল হয়েছেন। এটা যদি সফল হয় তবে আগামী দিনে এই চেষ্টা আরও বাড়বে।
এ প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, দল ও সরকারকে আলাদা করার কারণ হচ্ছে, মন্ত্রীরা মনোযোগ দিয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করবেন। দলের জন্য তাকে সময় দিতে হবে না। এতে সরকারের আরও সফলতা আসবে। কারণ সরকার কতটা সফল তা মন্ত্রীদের সফলতার ওপরই নির্ভর করে। অন্যদিকে, দলের যারা পদ পেলেন তারাও কাজ করার জন্য একটি পরিচয় পেলেন। ফলে ক্ষমতারও কিছুটা বিকেন্দ্রীকরণ হলো।
আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন, যেহেতু রাজনৈতিক দল সরকার পরিচালনা করে, সেজন্য দলকে সরকার থেকে পুরোপুরি আলাদা করা খুব কঠিন কাজ হবে। আওয়ামী লীগের তথ্য এবং গবেষণা সম্পাদক পদে নতুন অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ড. সেলিম মাহমুদ। তিনি বলেন, দলকে সরকার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করা যেমন সম্ভব নয় তেমনি কাক্সিক্ষতও নয়। কারণ দল ও সরকারের মধ্যে একটি সেতুবন্ধ থাকা দরকার। সরকার থেকে দলকে আলাদা করার বিষয়টি যতটুকু যৌক্তিক ততটুকুই রাখা হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি বলেন, দলের মধ্যে কয়েক মন্ত্রী থাকাটাও প্রয়োজন রয়েছে। সরকার জনগণের জন্য যা যা করবে সেটির মূল কমিটমেন্ট দল থেকে আসে। সেজন্য দলের সঙ্গে সরকারের একটা রিলেশনশিপের (সম্পর্ক) প্রয়োজন রয়েছে। তিনি বলেন, দলের অনেক সাংগঠনিক কাজ থাকে। কিন্তু বেশি মন্ত্রী যদি দলে থাকেন এবং তারা যদি দলের কাজে ব্যস্ত থাকেন তাহলে সরকারের কাজ ব্যাহত হয়। দল এবং সরকারের মধ্যে স্বার্থের সংঘাত তৈরি হয়। সেটাও অনুধাবন করে আমাদের নেত্রী, একেবারে সবাইকে না সরিয়ে পলিসি লেভেলে কয়েকজনকে রেখেছেন যাতে করে দল এবং সরকারের মধ্যে সবসময় একটা সেতুবন্ধন থাকে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির এখনও ৭টি পদ বাকি আছে। সভাপতিম-লী নিশ্চয়ই খুব স্বল্প সময়েই এই পদগুলো পূরণ করবে। ঘোষিত কমিটির মতো এই পদগুলোতেও সিনিয়র-জুনিয়র মিলিয়ে সরকারের বাইরের নেতারাই ঠাঁই পাবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি মাকসুদ কামাল বলেন, দীর্ঘদিন ধরে দল ও সরকারের দায়িত্ব আলাদা করার যে কথা বলা হচ্ছিল, এবারের কমিটিতে সেই প্রতিফলন দেখা গেছে। এতে দল ও সরকারকে আলাদা করার চেষ্টার ফলে দুই পক্ষই উপকৃত হবে। সরকার নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে সচেষ্ট হবে, আর দল সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হবে।
সরকার ও দল আলাদা হওয়ায় সবচেয়ে বড় যে ফল আশা করা যায় তা হলো, মন্ত্রীরা সরকার পরিচালনায় আরও মনোযোগী হতে পারবেন, দলের প্রতি তাদের পিছুটান থাকবে না। এতে সরকারের কর্মকা-ে গতিশীলতা আসবে এবং সরকার আরও সফল হবে। অন্যদিকে দল পরিচালনায় যারা দায়িত্ব পেয়েছেন তারাা দলকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত গতিশীল করার সুযোগ পাবেন। সাংগঠনিকভাবে দল আরও শক্তিশালী হবে। আবার দলের নেতৃবৃন্দ সরকারের কর্মকা-ে নজর রাখতে পারবেন, সরকারের ভুলত্রুটি তারা ধরিয়ে দিতে পারবেন। এজন্য দলের সঙ্গে সরকারের বছরে অন্তত দুবার সমন্বয় বৈঠক হওয়া প্রয়োজন। এতে দলের নেতারা সরকারের কর্মকা- নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতে পারবেন এবং মন্ত্রীরা তাদের ভুলত্রুটি শুধরে নিতে পারবেন। পাশাপাশি সরকারের কাছে দলের প্রত্যাশার বিষয়টিও জানতে পারবেন মন্ত্রীরা। সে অনুযায়ী তারা কাজ করতে পারবেন। কারণ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং ইশতেহার অনুযায়ী প্রত্যাশা পূরণে জনগণ সরকার পরিচালনার জন্য রাজনৈতিক দলকেই ম্যান্ডেট দিয়ে থাকে।