গণতন্ত্রের সূতিকাগারে চার বাঙালি কন্যার জয় জয়কার

34

কাজিরবাজার ডেস্ক :
যুক্তরাজ্যে পাঁচ বছরের মধ্যে তৃতীয় সাধারণ নির্বাচন লেবার পার্টির জন্য সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় হার বয়ে আনলেও দমানো যায়নি চার বাঙালি কন্যাকে। লেবার পার্টির এমপি বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত রুশনারা আলী, টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক ও রূপা হক বড় জয়ে তাদের আসন ধরে রেখেছেন। তাদের সঙ্গে এবার আফসানা বেগমও ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রধান বিরোধী দলের বেঞ্চে বসবেন।
এবারই প্রথম চার ব্রিটিশ বাংলাদেশী এমপি প্রতিনিধিত্ব করতে যাচ্ছেন গণতন্ত্রের সূতিকাগারে। নির্ধারিত সময়ের তিন বছর আগেই বৃহস্পতিবার যুক্তরাজ্যে এই সাধারণ নির্বাচন ছিল কার্যত ব্রেক্সিটের ভাগ্য নির্ধারণের ভোট। আর তাতে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিপরীতে প্রধান বিরোধী দল লেবার পার্টি অর্ধশতাধিক আসন খুইয়েছে। তবে লেবার পার্টির ব্রিটিশ বাঙালি চার নারী প্রার্থীর সবাই বড় ব্যবধানে জয় পেয়েছেন। উত্তর-পশ্চিম লন্ডনের হ্যামস্টেড এ্যান্ড কিলবার্ন আসনে টানা তৃতীয়বারের মতো বিজয়ী হয়েছেন বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি টিউলিপ সিদ্দিক। কনজারভেটিভ পার্টির জনি লুককে ১৪ হাজারের বেশি ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ ২০১৫ সালে লেবার পার্টি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে জয়ী হন। পরের দফায় ২০১৭ সালের নির্বাচনে তিনি পুনর্র্নিবাচিত হন। একদিকে পারিবারিক পরিচয়, অন্যদিকে লন্ডনের তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আসনে প্রার্থিতার কারণে টিউলিপ সব সময়ই ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রে। ৩৭ বছর বয়সী টিউলিপ সিদ্দিককে পারিবারিক রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণেই অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে। টিউলিপ প্রথমে ইংরেজী এবং পরে রাজনীতি, নীতি ও সরকার বিষয়ে লেখাপড়া করেছেন যুক্তরাজ্যের অন্যতম শীর্ষ দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট নেতা বারাক ওবামার প্রচারাভিযানেও অংশ নেন।
পশ্চিম লন্ডনের ইলিং সেন্ট্রাল এ্যান্ড এ্যাকটন আসনেও টানা তৃতীয়বারের মতো জয়ী হয়েছেন লেবার এমপি রূপা হক, যার আদি বাড়ি বাংলাদেশের পাবনায়। ৪৮ বছর বয়সী রূপা ২০১৫ সালের নির্বাচনে রক্ষণশীলদের হাত থেকে আসনটি পুনরুদ্ধার করেছিলেন। ২০১৭ সালের নির্বাচনে তিনি ব্যবধান বাড়িয়ে আসনটি ধরে রাখেন। আর এবার তিনি কনজারভেটিভ প্রার্থী জুলিয়ান গ্যালান্টকে হারিয়েছেন ১৩ হাজার ভোটের ব্যবধানে। রূপ হক ক্যামব্রিজে রাজনীতি, সামাজিক বিজ্ঞান ও আইন পড়েছেন। তিনি পড়াচ্ছেন সমাজবিজ্ঞান, অপরাধবিজ্ঞান, গণমাধ্যম ও সংস্কৃতি অধ্যায়নের মতো বিষয়। শিক্ষক রূপা এর আগে ডেপুটি মেয়র হিসাবে স্থানীয় সরকারে দায়িত্ব পালন করেছেন। লেখক, মিউজিক ডিজে, যুক্তরাজ্যের কয়েকটি প্রধান দৈনিকের কলামিস্ট রূপার ছোট বোন কনি হক বিবিসির ব্লু পিটার শো উপস্থাপনার কল্যাণে ব্রিটিশদের কাছে খুব পরিচিত নাম।
বাঙালী অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটসের দুটি আসনই ঐতিহ্যগতভাবে লেবার পার্টির ঘাঁটি হিসাবে পরিচিত। এর মধ্যে বেথনাল গ্রিণ এ্যান্ড বো আসনে গত তিনবারের এমপি সিলেটের বিশ্বনাথের মেয়ে রুশনারা আরও পাঁচ বছর ব্রিটিশ পার্লামেন্টে থাকার টিকেট পেয়েছেন। এবারের নির্বাচনে তার ভোট আরও বেড়েছে। কনজারভেটিভ প্রার্থী নিকোলাস স্টভোল্ডকে তিনি হারিয়েছেন সাড়ে ৩৭ হাজার ভোটের ব্যবধানে।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রথম বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এমপি রুশনারা আলী প্রথমবার নির্বাচিত হন ২০১০ সালের নির্বাচনে। সে সময় তিনি পার্লামেন্টারি ট্রেজারি সিলেক্ট কমিটির সদস্য ছিলেন। কনজারভেটিভ সরকারের আমলেও তিনি বাংলাদেশ-বিষয়ক বাণিজ্য দূতের দায়িত্ব পালন করেছেন। সাধারণ এক কর্মজীবী বাঙালির মেয়ে রুশনারা পরিবারের প্রথম সদস্য, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। তিনি দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ডিগ্রী নিয়েছেন অক্সফোর্ডের সেইন্ট জন’স কলেজ থেকে। টাওয়ার হ্যামলেটস বারার অন্য আসন পপলার এ্যান্ড লাইম হাউস থেকে প্রথমবার নির্বাচন করেই বাজিমাত করেছেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আফসানা বেগম। এই লেবার প্রার্থী এমপি নির্বাচিত হয়েছেন কনজারভেটিভ প্রার্থী শিউন ওককে প্রায় ২৯ হাজার ভোটে হারিয়ে।
আফসানার জন্ম ও বেড়ে ওঠা টাওয়ার হ্যামলেটসে হলেও বাংলাদেশে তাদের আদি বাড়ি সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে। টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের আবাসন বিভাগে চাকরি করছিলেন তিনি। এই আসনে লেবার পার্টির দুই দশকের এমপি জিম ফিটজপেট্রিক চলতি বছরের শুরুর দিকে নির্বাচন না করার ঘোষণা দেন। লেবার দলের নিরাপদ এই আসনে মনোনয়ন নিয়ে লড়াইয়ের মধ্যে অনেকটা চমকে দিয়ে মনোনয়ন পেয়ে যান অপেক্ষাকৃত তরুণ আফসানা। কুইনমেরী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজনীতিতে লেখাপড়া করা আফসানার বাবা মনির উদ্দিন টাওয়ার হ্যামলেটসের কাউন্সিলর ছিলেন। তিন দল থেকে মোট সাতজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত প্রার্থী এবারের নির্বাচনে অংশ নিলেও লেবারের চারকন্যা ছাড়া জয় পাননি কেউ।
লেবার পার্টি থেকেই তৃতীয়বারের মতো লন্ডনের বেকেনহাম আসনে নির্বাচন করেছিলেন নারায়ণগঞ্জের মেয়ে ব্যারিস্টার মেরিনা আহমেদ। এবারও তিনি কনজারভেটিভ প্রার্থীর কাছে হেরে গেছেন বড় ব্যবধানে। কনজারভেটিভ পার্টি নির্বাচনে জয় পেলেও এ দলের একমাত্র বাঙালী প্রার্থী আনোয়ারা আলী নিজের আসনে ভোটে জিততে পারেননি। হ্যারো ওয়েস্ট আসনে তিনি লেবার প্রার্থীর কাছে হেরেছেন নয় হাজার ভোটের ব্যবধানে। আর মৌলভীবাজারের মেয়ে বাবলিন মল্লিক লিবডেমের মনোনয়নে প্রার্থী হয়েছিলেন কার্ডিফ সেন্ট্রাল আসন থেকে। ভোটের টালিতে তার অবস্থান এবার তৃতীয়।
আওয়ামী লীগের অভিনন্দন : বিশেষ প্রতিনিধি জানান, যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত চার বাঙালি নারী- জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক টানা তৃতীয়বার এবং রূপা হক, রুশনারা আলী পুনরায় ও আফসানা বেগম প্রথমবারের মতো বিজয়ী হওয়ায় তাদেরকে অভিনন্দন জানিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ।
শুক্রবার এক বিবৃতিতে বিজয়ী এই চার বাঙালি নারীকে প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে দলের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৌহিত্রী টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক টানা তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত হওয়ায় এবং বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত রূপা হক, রুশনারা আলী পুনরায় বিজয়ী হওয়ায় ও আরেক বাঙালি নারী প্রথমবারের মতো বিজয়ী হওয়ায় বিশ^ সভায় বাঙালি জাতির ভাবমূর্তি ও মর্যাদা আরও সমুজ্জ্বল হয়েছে। তাদের এই জয়যাত্রা বাঙালি জাতির গৌরব ও মর্যাদাকে অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেছে। এ বিজয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসরত বাঙালিদের মধ্যে এক নবতর জাগরণের সৃষ্টি করেছে।
বিবৃতিতে তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির বিশ্বজয়ের যে অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তা কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে। বাঙালির বিশ্বজয়ের স্বপ্ন-সারথি দেশরতœ শেখ হাসিনার অব্যাহত সাফল্যের ধারাবাহিকতা এবং যুক্তরাজ্যের গণতন্ত্রে চার বাঙালি কন্যার ঐতিহাসিক বিজয় বাঙালির বিশ্বজয়ের অগ্রযাত্রায় অনন্য মাইল ফলক হিসেবে বিবেচিত হবে।
বিবৃতিতে ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে চার বাঙালি নারীর ঐতিহাসিক এ বিজয় বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রমে নারীর অংশগ্রহণকে আরও ত্বরান্বিত এবং শান্তি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও প্রগতি প্রতিষ্ঠায় নারীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণকে সুনিশ্চিত করবে। বিবৃতিতে যুক্তরাজ্যের হ্যাম্পস্টেড এ্যান্ড কিলবার্ন, ইলিং সেন্ট্রাল এ্যান্ড এ্যাকটন, বেথনাল গ্রীণ এ্যান্ড বো ও পূর্ব লন্ডনের পপলার এ্যান্ড লাইমহাউজ আসনে চার বাঙালি কন্যাকে নির্বাচিত করায় এসব আসনের সকল ভোটার এবং যুক্তরাজ্যে বসবাসরত সকল বাঙালির প্রতি অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন ওবায়দুল কাদের এমপি। একই সঙ্গে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো বিজয়ী হওয়ায় কনজারভেটিভ পার্টিকেও শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান তিনি।