কাজিরবাজার ডেস্ক :
এক গবেষণায় উঠে এসেছে সিলেট অঞ্চলের মানুষ বেশি পেঁয়াজ খায়। অন্যদিকে কম খায় বরিশাল অঞ্চলের মানুষ। দেশে একেকটি পরিবারে প্রতি মাসে সর্বনিম্ন এক কেজি ৫৬ গ্রাম থেকে সর্বোচ্চ চার কেজি ৯১ গ্রাম পেঁয়াজ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের পরিবারগুলো সেপ্টেম্বরে বেশি পেঁয়াজ ব্যবহার করে আর ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসে পেঁয়াজ কম ব্যবহার হয়ে থাকে।
গবেষণা বলছে, সিলেটে শহর ও গ্রাম অঞ্চলে সমানভাবে বেশি পেঁয়াজ ব্যবহার হয়ে থাকে। তবে সারাদেশের হিসাবে গ্রামের চেয়ে শহরের মানুষের পেঁয়াজ খাওয়ার প্রবণতা বেশি।
দেশের গত কয়েক মাস ধরে পেঁয়াজের বাজারে চলছে চরম অস্থিরতা। পেঁয়াজের বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চেষ্টার কমতি নেই। বছরখানেক আগে পেঁয়াজের ওপর চালানো একটি গবেষণা নিয়ে সম্প্রতি মাঠে নেমেছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে (বিআইডিএস) দিয়ে গবেষণাটি করায় বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন।
বিআইডিএসের জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো নাজনীন আহমেদের নেতৃত্বে ‘ওনিয়ন মার্কেট অব বাংলাদেশ: রোল অব ডিফরেন্ট প্লেয়ার্স অ্যান্ড অ্যাসেজিং কম্পিটিভন্স’ নামক মূল গবেষণাটি করা হয়। যা প্রকাশ হয় গত বছর ডিসেম্বরে।
গবেষণায় বলা হয়, পেঁয়াজ ৬০ শতাংশ দেশীয় উৎপাদন থেকে আসে, বাকি ৪০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশ ভারত থেকেই মূলত পেঁয়াজ আমদানি করে। বাংলাদেশে পেঁয়াজের মূল্য নিয়ন্ত্রণে ভারতের বাজার সব সময় পর্যবেক্ষণ জরুরি। ভারতে বন্যার সময় থেকেই বাংলাদেশের আরও সতর্ক হয়ে বিকল্প বাজার খোঁজা জরুরি ছিল বলে মনে করে বিআইডিএস।
গবেষণায় উঠে আসে, পেঁয়াজ আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে হবে। ধানের মতো পেঁয়াজের হাইব্রিড জাত উদ্ভাবন করতে হবে। এছাড়া যখন পেঁয়াজের দাম কম থাকে তখন সরকারের উচিত পেঁয়াজ কিনে মজুদ করা। যাতে আপদকালে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে কম দামে পেঁয়াজ বিক্রি করা যায়। প্রতিটি পরিবারে মাসে চার থেকে পাঁচ কেজি পেঁয়াজ লাগে বলে জরিপে উঠে আসে।
উৎপাদনের সঙ্গে বেড়েছে চাহিদা : দেশে চাহিদার তুলনায় বাড়েনি পেঁয়াজের উৎপাদন। ফলে উৎপাদন ও ঘাটতি সমানতালে বাড়ছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছিল ১১ লাখ ৫৯ হাজার মেট্রিক টন, এই সময়ে মাত্র তিন লাখ ৬৩ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। এ অর্থবছরে মোট পেঁয়াজের চাহিদা হয় ১৫ লাখ ২২ হাজার মেট্রিক টন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছিল ১৭ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন। পাঁচ বছর পর উৎপাদন বাড়লেও ছয় লাখ ৫২ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। জনসংখ্যা বাড়ার কারণে পেঁয়াজের চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় ২৩ লাখ ৮৭ হাজার মেট্রিক টন। দেশে চাহিদা মেটাতে গবেষণায় হাইব্রিড জাতের পেঁয়াজ উৎপাদনের কথা তুলে ধরেছে বিআইডিএস।
এ বিষয়ে বিআইডিএসের জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘পেঁয়াজ নিয়ে এমন গবেষণা প্রথম। গবেষণায় উঠে এসেছে পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে তিনটা জিনিস গুরুত্ব দিতে হবে উৎপাদন বাড়ানো, যোগান ও ভারতের বাজার পর্যবেক্ষন। হাইব্রিড জাতের পেঁয়াজ উৎপাদন করে আমদানিনির্ভরতা কমাতে হবে। সরকারের উচিত পেঁয়াজের মৌসুমে পেঁয়াজ কিনে মজুদ করা। যখন পেঁয়াজ থাকবে না তখন কম দামে টিসিবির মাধ্যমে পেঁয়াজ বিক্রি করতে হবে।’
পেঁয়াজ উৎপাদনে শীর্ষে পাবনা : গবেষণায় আরও দেখা গেছে, বাংলাদেশে ১০টি জেলায় বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন হয়ে থাকে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে পেঁয়াজ উৎপাদনে শীর্ষে ছিল পাবনা। জেলাটিতে চার লাখ ১৫ হাজার ৩৭২ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। এ বছর ফরিদপুরে দুই লাখ ৯০ হাজার ৪১৭, রাজবাড়ীতে দুই লাখ ২৭ হাজার ৩৬৮, রাজশাহীতে এক লাখ ৪২ হাজার ৯৫ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। দেশে পেঁয়াজ উৎপাদনে পঞ্চম অবস্থানে কুষ্টিয়া। এই জেলায় এক লাখ নয় হাজার ৬৪৫ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। মেহেরপুরে ৬৮ হাজার ৭২০, মাগুরায় ৫৪ হাজার ৩২৭, ঝিনাইদহে ৫৩ হাজার ৭০১, মানিকগঞ্জে ৪৮ হাজার ১৪৬ ও মাদারীপুরে ৪২ হাজার ৯৭৭ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে।
পেঁয়াজ উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষে চীন : পেঁয়াজ উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষে চীন। বিশ্বের ২৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ পেঁয়াজ চীনে উৎপাদিত হয়। এর পরিমাণ ২৩৯ লাখ আট হাজার মেট্রিক টন। এরপরেই ভারতের অবস্থান। ১৯৪ লাখ ১৫ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয় দেশটিতে। যা বিশ্বে মোট উৎপাদনের ২০ দশমিক ৮৩ শতাংশ। এরপরে রয়েছে মিসর, যুক্তরাষ্ট্র, ইরান, তুরস্ক, রাশিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ব্রাজিল। বিশ্বে পেঁয়াজ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবদান মাত্র এক দশমিক ৮৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন মো. মফিজুল ইসলাম বলেন, বাজারে অনৈতিক মুনাফার লোভে ষড়যন্ত্রমূলক প্রতিযোগিতাবিরোধী কর্মকা- প্রতিরোধ করতে আমরা কাজ করছি। এক বছর আগে আমরা বিআইডিএসকে দিয়ে পেঁয়াজ ও চালের ওপর স্টাডি করিয়েছি। আমরা বাজার পর্যবেক্ষণ করছি। সেখানে বিআইডিএস আমাদের কিছু রিকোমেন্ডশন দিয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য যারা যারা কনসার্ন যেমন বাণিজ্য, কৃষি মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য সংস্থা তাদেরকে সাজেশনস পাঠিয়েছি। আমরা এর স্থায়ী সমাধান চাই।