আওয়ামীলীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনকে ঘিরে নগরী জুড়ে উৎসবের আমেজ ॥ কারা হচ্ছেন জেলা ও মহানগর আ’লীগের সভাপতি-সেক্রেটারী

14

সিন্টু রঞ্জন চন্দ :
আর মাত্র ২ দিন পর আগামী ৫ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আর এই সম্মেলনকে ঘিরে নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ও উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। বিশেষ করে ১৪ ও ৮ বছর পর সিলেটের ঐতিহ্যবাহী আলিয়া মাদ্রাসার মাঠে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এই সম্মেলনকে ঘিরে পদপ্রত্যাশী নেতাদের সমর্থনে সিলেট নগরী ও তার আশপাশ এলাকাগুলোতে ব্যানার, ফেস্টুন, গেইট, বিলবোর্ড-প¬্যাকার্ড ও লাইটিং করে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। সেই সাথে তৎপর হয়ে উঠছেন পদপ্রত্যাশী নেতারা।
তাদের প্রায় সকলেই জানিয়েছেন, শেষ পর্যন্ত নির্বাচন নয়, কেন্দ্রীয় নেতাদের ইচ্ছায় মনোনীত করা হবে শীর্ষ নেতৃত্ব। মূলত দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইচ্ছেতেই হয়ত সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক বাছাই করা হবে।
গতকাল রবিবার নগরীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, দক্ষিণ সুরমা হুমায়ুন রশীদ চত্ত্বর, চন্ডিপুল সামাদ আজাদ চত্ত্বর, জিতু মিয়ার পয়েন্ট, সার্কিট হাউসের সামন, কীন ব্রীজ এলাকা, সুরমা পয়েন্ট, সিটি পয়েন্ট, কোর্ট পয়েন্ট, জিন্দাবাজার এলাকা, চৌহাট্টা পয়েন্ট, আলীয়া মাদ্রাসা মাঠের আশপাশ এলাকা, রিকাবীবাজার পয়েন্টসহ নগরী গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে বড় বড় ব্যানার, গেইট, বিলবোর্ড-প¬্যাকার্ড ও লাইটিংয়ে চেয়ে গেছে। এসব ব্যানার-বিলবোর্ডে পদপ্রত্যাশী নেতাদের আওয়ামীলীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনের সফলতা কামনা করে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এদিকে সম্মেলনের সভাস্থল আলীয়া মাঠের স্ট্যাজের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। ইতিপূর্বে আওয়ামীলীগের নেতা ও মন্ত্রীরা সম্মেলনস্থল পরিদর্শন করে গেছেন। এছাড়া গত শনিবার রাতে সিলেট জেলা পরিষদ মিলনায়তনে সিলেটে আওয়ামী লীগের সম্মেলনকে সামনে রেখে সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের যৌথ বর্ধিত সভায় সম্মেলন সফলে সকলের সহযোগিতা ও সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
মহানগর আওয়ামী লীগের দায়িত্বরত নেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সম্মেলনকে সামনে রেখে ইতিমধ্যে উপজেলা ও সিসিকের ২৭টি ওয়ার্ডে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কাউন্সিলর নির্বাচনের প্রক্রিয়াও প্রায় শেষ পর্যায়ে। আগামী ৫ ডিসেম্বর আলিয়া মাদ্রাসার মাঠে। কমিটির শীর্ষ পদ কারা পাবেন এনিয়ে শীর্ষ নেতাদের অনুসারী, ও কর্মী-সমর্থকদের রয়েছে ভিন্নমত। নেতাকর্মীদের একপক্ষ মনে করেন, মহানগর আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি বদরউদ্দিন আহমদ কামরান বর্তমানে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। আগামী সম্মেলনে তাকে কেন্দ্রীয় কমিটির আরও বড় পদ দেওয়া হতে পারে। তবে কামরান অনুসারীরা মনে করেন, আবারও কামরানের উপরই আস্থা রাখতে পারেন দলীয় সভানেত্রী। সাধারণ সম্পাদক পদে পরিবর্তন আসতে পারে বলেও নেতাকর্মীদের মধ্যে আলোচনা রয়েছে। বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদ নিজেও এবার সভাপতি পদে প্রার্থী চলে তার অসুসারীদের অভিমত। তবে সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে নিয়ে মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদে নতুন কাউকে আনা হতে পারে এমন আলোচনাও রয়েছে। সভাপতি পদে বর্তমান সভাপতি বদর উদ্দিন আহমদ কামরান ও সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদ ছাড়াও আলোচনায় রয়েছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এডভোকেট রাজ উদ্দিন, এডভোকেট মফুর আলী ও সাবেক সিটি কাউন্সিলর আবদুল খালিক এবং যুগ্ম সম্পাদক সাবেক সিটি কাউন্সিলর ফয়জুল আনোয়ার আলাওর। সাধারণ সম্পাদক পদে আলোচনায় রয়েছে বর্তমান কমিটির যুগ্ম সম্পাদক বিজিত চৌধুরী, অধ্যাপক জাকির হোসেন, বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক ও বিসিবির পরিচালক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, সাংগঠনিক সম্পাদক এটিএম হাসান জেবুল, পরিবেশ সম্পাদক জগদীশ চন্দ্র দাস, শিক্ষা সম্পাদক ও সিটি কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক তপন মিত্র এবং সাংস্কৃতিক সম্পাদক প্রিন্স সদরুজ্জামান চৌধুরী ও এড.ছালেহ আহমদ সেলিম।
এ ব্যাপারে সাধারণ সম্পাদক পদপ্রত্যাশী শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল বলেন, ছাত্রলীগ থেকে রাজনীতি শুরু করেছি। দলের দুঃসময়ে আন্দোলন সংগ্রামে মাঠে কাজ করেছি। সেখান থেকে নিজের কর্ম দিয়ে এই পর্যন্ত এসেছি। তাই স্বাভাবিক ভাবেই ভাল পদ পাওয়ার আশা থাকে। আশাকরি এ বিষয়টা তৃণমূলের নেতাকর্মী থেকে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ও প্রধানমন্ত্রী বিবেচনা করবেন। তবে আমি মনে করি নেতৃত্বে পরিবর্তন আসা প্রয়োজন। কারণ নেতৃত্বে পরিবর্তন না আসলে নতুন নেতৃত্ব তৈরি হবে না। নেতাকর্মীরা কাজের স্পৃহা হারিয়ে ফেলবে। তাই তৃণমূলের নেতাকর্মীদের স্পৃহা বাড়ানোর জন্য হলেও নেতৃত্বে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।
সাধারণ সম্পাদক প্রত্যাশী এটিএম হাসান জেবুল বলেন, নতুন কমিটিতে নবীন-প্রবীণের সমন্বয় ঘটতে পারে। যারা স্বচ্ছ ইমেজের, দলের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন তারা এবার মূল্যায়িত হবেন বলে মনে করেন জেবুল।
এ বিষয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদ বলেন, সম্মেলনের জন্য সাংগঠনিক প্রস্তুতি শেষ। কাউন্সিলর নির্বাচন চলছে। সার্বিক ব্যবস্থাপনাও চলমান আছে। সম্মেলনে তার প্রার্থিতা নিয়ে তিনি বলেন, কে কোন পদে থাকবেন সেটা জানেন প্রধানমন্ত্রী। আমি ব্যক্তিগত ভাবে কোনো পদে প্রার্থিতা করছি না। তবে সম্মেলন আসলে কর্মী সমর্থকরা তাদের প্রিয় নেতাদের বড় পদে দেখতে চান। তাই তারা বিভিন্ন ভাবে প্রচার প্রচারণা করেন। আমার ক্ষেত্রেও এমনটা হয়েছে। কর্মী সমর্থকরা চাচ্ছেন আমাকে একটি পদে দেখতে। তাই তারা ব্যানার ফেস্টুনের মাধ্যমে নিজেদের সমর্থন দিচ্ছেন।
এ ব্যাপারে বর্তমান সভাপতি বদরউদ্দিন আহমদ কামরান বলেন, সম্মেলনকে কেন্দ্র করে কর্মী সমর্থকদের মধ্যে আনন্দমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। আমরা বর্ধিত সভাও করে ফেলেছি। ওয়ার্ড কমিটিগুলোও গঠন করা হয়েছে। সম্মেলনে নেতৃত্বে পরিবর্তনের গুঞ্জন নিয়ে তিনি বলেন, এখন যারাই যেসব কথা বলছেন সব অনুমান নির্ভর কথা। সম্মেলন মানে শুধু নেতৃত্বে রদবদল নয়। সম্মেলনের মাধ্যমে দল সুসংগঠিত হয়। সম্মেলনের মাধ্যমে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা চাঙ্গা হন। তাছাড়া জেলা বা মহানগর কমিটিগুলো সরাসরি প্রধানমন্ত্রী দেখেন। তিনি আরো বলেন, আমি দলের একজন কর্মী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে যে দায়িত্ব দিবেন আমি সে দায়িত্ব মাথা পেতে নিতে রাজি আছি। সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতা বলে জানান তিনি।
আওয়ামী লীগ দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হতে পদ প্রত্যাশী নেতারা তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। সভাপতি পদে এ পর্যন্ত ৬ জন ও সাধারণ সম্পাদক পদে ৮ জনের নাম আলোচনায় রয়েছে। সভাপতি পদে বর্তমান কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সিলেট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এডভোকেট লুৎফুর রহমান চৌধুরী, বর্তমান সহ-সভাপতি ও প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ এমপি, বর্তমান সহ-সভাপতি মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী কয়েস এমপি, বর্তমান সহ-সভাপতি ও সিলেট সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আশফাক আহমদ, বর্তমান সহ-সভাপতি মাসুক উদ্দিন আহমদ এবং বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান চৌধুরীর নাম শোনা যাচ্ছে।
সাধারণ সম্পাদক পদের জন্যে বর্তমান কমিটির সহ-সভাপতি এডভোকেট শাহ ফরিদ আহমদ, বর্তমান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট নিজাম উদ্দিন, বর্তমান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ সুজাত আলী রফিক, বর্তমান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট নাসির উদ্দিন খান, বর্তমান দপ্তর সম্পাদক সাইফুল আলম রুহেল, সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ আলী দুলাল, বর্তমান উপ-দপ্তর সম্পাদক জগলু চৌধুরী এবং বর্তমান কমিটির সদস্য অধ্যক্ষ শামসুল ইসলাম জোর লবিং করছেন বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে। শীর্ষ দুই পদ পেতে এ সকল নেতৃবৃন্দ প্রতিদিন দলের কাউন্সিলরদের সাথে যোগাযোগের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সাথেও লবিং অব্যাহত রেখেছেন। ভোটে নেতৃত্ব নির্বাচিত হতে কাউন্সিলর, সমঝোতায় হলে কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতাদের দৃষ্টিতে থাকতেই নানা চেষ্টা-তদবির করছেন তারা। তবে পদ প্রত্যাশীর ১৪ জনই বর্তমান কমিটির কোনো না কোনো দায়িত্বে রয়েছেন। আবার তারা প্রায় সকলেই ছাত্রলীগ হয়েই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসীন হন বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, ২০০৫ সালে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে সম্মেলনের পর কমিটি গঠন করা হয়। প্রায় ৬ বছরেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে না পারায় নেতাকর্মীদের মাঝে ক্ষোভেরও শেষ ছিল না। দল ক্ষমতায় আসার পর সম্মেলন ছাড়াই ২০১১ সালের ২২ নভেম্বর ৬৯ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি অনুমোদন দেয়া হয়। কমিটিতে ৬ জনকে করা হয় উপদেষ্টা। কমিটিতে শ্রম সম্পাদক, ৩৪নং সদস্যের পদ শূন্য রাখা হলেও তা পূরণ হয়নি। আব্দুজ জহির চৌধুরী সুফিয়ানকে সভাপতি ও শফিকুর রহমান চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক করে দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই কমিটি অনুমোদন দেন। এ কমিটি ৮ বছরে ৬ উপজেলায় সম্মেলন করেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের কঠোর নির্দেশের পর ৭ উপজেলার সম্মেলনের দিন ধার্য্য করে জেলা সম্মেলনেরও প্রস্তুতি নেয়া হয়। গত সোমবার দক্ষিণ সুরমা উপজেলার সম্মেলনের মধ্য দিয়ে জেলার সকল উপজেলা সম্মেলন সম্পন্ন হলেও সকল উপজেলায় কমিটি গঠন সম্পন্ন হয়নি। তবে ১৪ বছর পরে আবারো জেলা সম্মেলনের প্রস্তুতি চলছে। এর ফলে দলের নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন। বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ।