শাহ আলম শামীম কুলাউড়া থেকে :
মৌলভীবাজার জেলার মধ্যে কুলাউড়া উপজেলার পাহাড়ি এলাকায় বন-পাহাড়ে খাসিয়া আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বৃহত্তম বসবাস। আর তাদের জীবিকা আয়ের প্রধান উৎস হচ্ছে পান চাষ। উপজেলার বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ৩৩টি খাসিয়া পুঞ্জি (গ্রাম) রয়েছে। তবে এ বছর আগাম বৃষ্টি হওয়ায় পান গাছে ‘লবর’ নতুন পানের দেখা পেয়েছেন পান চাষিরা। তাই পুঞ্জি গুলোতে বইছে আনন্দের বন্যা। আধিবাসিরা বেশ উৎফুল্লভাবে নতুন পান উত্তোলন করতে শুরু করেছে। শীত মৌসুমে বৃষ্টির অভাবে পানের ফলন কম হওয়ায় বেশ বেগ পেতে হয়েছিল তাদের। কিন্তু আগাম বৃষ্টিতে লবর পানের আগমন ঘটায় ভালো দামও পাচ্ছেন আধিবাসিরা।পান গুছানো ও বিপননের ব্যস্ত সময় পার করছেন খাসিয়া নারী,পুরুষের পাশাপাশি শিশু ও পান চাষীরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলার কর্মধা আমুলী পানপুঞ্জির মন্ত্রী (পুঞ্জি প্রধান) প্রর্তুস শাহাকরা বলেন, ফেব্র“য়ারি মাসের মধ্যে পান গাছ থেকে সম্পূর্ণ পান উত্তোলন শেষ হয়ে যায়। তবে সময় মতো বৃষ্টি দিলে মে মাসের শেষ দিকে আবারও পান উত্তোলন শুরু হয়ে থাকে। তবে এবার আগাম বৃষ্টির কারণে মার্চ মাসেই পান উত্তোলন শুরু করা সম্ভব। ইতি মধ্যে আবার অনেকে পান উত্তলন শুরু করে দিয়েছেন।
সিঙ্গুর পানপুঞ্জির প্রাক্তন (মন্ত্রী) জামিল ধার জানান, পানকে খাসিয়া ভাষায় ‘পাথা’ বলে থাকে। আর এ পান শুধু খাসিয়া আদিবাসীরাই চাষাবাদ করছে বলে সবার কাছে খাসিয়া পান বলে পরিচিত। খাসিয়া পুরুষরা পান জুমে লতানো পানগাছের পরিচর্যা এবং বছরে একবার গাছের ডালপালা ও পাতা ছেঁটে দেয় এবং ছাঁটানো ডালপালা ও পাতা পানগাছের গোঁড়ায় দিয়ে থাকে। ডালপালা ও পাতা পঁচে প্রাকৃতিক জৈব সার তৈরি হয়। বর্তমান যুগে কেউ কেউ বাজার থেকে জৈব সার ক্রয় করে নিজেদের পান জুমে বেশি ফলানোর আশায় দিয়ে থাকে। খাসিয়া পুরুষরা লু-উ নামে (অর্থ মই) এক ধরনের বাঁশের মই দিয়ে পান তুলে থাকে। পান তোলার সময় এরা সঙ্গে পান সংগ্রহ করার জন্য ঝুড়ি রাখে, ঝুড়ির ভেতরে পান তুলে রাখে এবং খাসিয়া পুরুষরা পান সংগ্রহ করে জুম থেকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে আসে। আর খাসিয়া নারীরা ঘরে বসে পান গুছিয়ে বিক্রয় করে থাকে। বেগুন ছড়া পানপুঞ্জির হ্যাডম্যান (মন্ত্রী) দিলবাহাদুর লেম্বু বলেন, আগাম বৃষ্টির কারণে লবর পানের দেখা পাওয়ায় পানপুঞ্জি গুলোতে যেন বড় দিনের উৎসব শুরু হয়েছে।
সাহেব টিলা পানপুঞ্জির মলই গুন্ডি বলেন, ১২টি পান পাতায় এক গুছি আর ১২টি গুছিতে এক কান্তা (মুটি) এবং ১২ কান্তায় এক কুড়ি। তাদের নিজেদের মধ্যে নারী শ্রমিকও আছে, তারা শুধু নিজের পুঞ্জিতে পান গুছি করে। এক কুড়ি গুছি করলে পারিশ্রমিক বাবদ ৩৫-৪০ টাকা পেয়ে থাকে। তবে এক-সময় খাসিয়া আদিবাসী নারীরাই এ এলাকার বাজারে নিয়ে নিজেদের পান বিক্রয় করত। বর্তমানে স্থানীয় বাঙালি ক্রেতারা খাসিয়া পুঞ্জিগুলোর বাড়িতে বাড়িতে এসে নারীদের কাছ থেকে পান ক্রয় করে নিয়ে যায়। এ কারণে তাদের কষ্ট অনেকটাই কমে যায়।
বর্ষাকালে বৃষ্টিপাতের জন্য পানের উৎপাদন বেশি হওয়ার ফলে পানের মূল্যও কম হয়ে থাকে। কুড়িপ্রতি ৪০০-৫৫০ টাকা আর শুকনো মৌসুমে পানের উৎপাদন কম হওয়ায় কুঁড়ি প্রতি ২৫০০-৩০০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রয় হয়। তবে গত বছরের তুলনায় এ বছর পানের মূল্য অনেক কম। খাসিয়া পান বর্তমানে বিদেশেও রপ্তানি হয়ে থাকে এবং এ দেশের অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
মৌলভীবাজার কৃষি অধিদপ্ততরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ শাহাজান বলেন, এ বছর আগাম বৃষ্টিপাত হওয়ায় জেলার ছোটবড় সব পুঞ্জিতেই কমবেশি নতুন পান উত্তোলন হচ্ছে। এ পান দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে তাই সরকারী আর্থিক সহায়তা পেলে খাসিয়ারা পান চাষে আরও লাভবান হতে পারবে।