কাজিরবাজার ডেস্ক :
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে তোলা দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারলে অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, জাবি উপাচার্যের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তাদের প্রমাণ করতে হবে। প্রত্যেকে যারা অভিযোগ নিয়ে আসছে, যারা বক্তৃতা দিচ্ছে, আমি বলেছি সব ফুটেজ সংরক্ষণ করতে হবে। যদি দুর্নীতি প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে যার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে তার যে শাস্তি হতো, যে অভিযোগকারী তাকে কিন্তু সেই সাজা পেতে হবে। এটা কিন্তু আইনে আছে। মিথ্যা অভিযোগ করলে তার বিরুদ্ধে কিন্তু আইন ব্যবস্থা নেবে। সেই ব্যবস্থা কিন্তু আমরা নেব। আপনাদের স্পষ্ট জানিয়ে দিলাম।
বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী তার কার্যালয়ে অসুস্থ, অসচ্ছল ও বিভিন্ন দুর্ঘটনায় হতাহত সাংবাদিকদের আর্থিক অনুদানের চেক বিতরণ অনুষ্ঠানে আরও বলেন, যারা প্রায়শই দুর্নীতির অভিযোগে ভাইস চ্যান্সেলরদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন, তাদের অবশ্যই অভিযোগ প্রমাণ করতে হবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতির অভিযোগে সৃষ্ট অশান্ত পরিস্থিতির পটভূমিতে তিনি আরও বলেন, কোন রকম আইনগত ভিত্তি ছাড়া আন্দোলনের নামে ক্লাস বন্ধ, ভিসিদের বাসভবন ও কার্যালয়ে হামলা বরদাশত করা হবে না।
কোন উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হলে সচরাচর দুর্নীতির অভিযোগ উঠে এ কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ ঠিকভাবে বণ্টন না হলে অভিযোগ উঠতে পারে বলে শোনা যায়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বুয়েটের শিক্ষার্থীরা একজন ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনায় আন্দোলন করেছে। এই হত্যার ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার এবং মামলা দায়েরের পর এই আন্দোলন অব্যাহত রাখার কোন যুক্তি আমি দেখি না। তিনি বলেন, প্রমাণ করতে হবে দুর্নীতির টাকা নিয়ে কোথায় রাখল। মুখে বললে তো হবে না। দিনের পর দিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা বরদাশত করা হবে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন কাজ শুরু হলেই আন্দোলন কেন এমন প্রশ্ন তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সব থেকে যেটা লক্ষ্যণীয়, যখন উন্নয়নের কোন কাজ দেয়া হয়, যখনই সেখানে একটা প্রজেক্ট দেয়া হয়, তখনই এই আন্দোলন যেন আরও ঘনীভূত হয়ে উঠে। কেন? তাহলে যারা আন্দোলন করেন তাদেরও ভাগ-বাটোয়ারার ব্যাপার আছে, নাকি ভাগে কম পড়ছে, আমার প্রশ্ন সেখানেও আছে। আমি জানি আমি খুব রূঢ় হচ্ছি কিন্তু বাস্তবে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে, এটা কি ধরনের কথা? হয়ত প্রজেক্ট পাস হয়ে গেছে টাকাও ছাড় হয়নি। তার আগেই দুর্নীতির অভিযোগে আন্দোলন, কি কারণে? কার ভাগে কম পড়ল যে এই আন্দোলন?’
আন্দোলনে থাকা শিক্ষকদের সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, এভাবে ছেলেমেয়েদের জীবন নষ্ট করার কি অধিকার আছে? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলছে, যদি অভিযোগ থাকে বলুক আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেব। কিন্তু যেখানে আমরা একজনকে ভিসি বানালাম তার বিরুদ্ধে আন্দোলন। আর এর মধ্যে শিক্ষকও জড়িত। শিক্ষকরা ছাত্রদের ব্যবহার করে। এটা কোন ধরনের কথা? এখানে কি কোন ডিসিপ্লিন থাকবে না? কোন আইন থাকবে না? আইন প্রয়োগ হবে না? আর আমাদের কিছু কিছু থাকে, এটাকে আরও উস্কানি দেয়। এই বিষয়গুলো মনে হয় একটু দেখা দরকার আপনাদের।
ছাত্র-শিক্ষকরা এই ধরনের কর্মকান্ড কেন ঘটাবে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, তারা ক্লাস কেন বন্ধ করবে? প্রত্যেকটা পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে কয় টাকা তারা খরচ করে তাদের পড়ার জন্য? খরচ তো সরকারের পক্ষ থেকে করি। স্বায়ত্তশাসন তাদের আছে। স্বায়ত্তশাসিত হলে তো তাদের নিজেদের অর্থের জোগান দিয়ে প্রতিষ্ঠান চালানোর কথা। কিন্তু প্রতিবছর বাজেটে আমরা টাকা দেই। বাজেটে আমরা টাকা দেব আর সরকারের সেখানে কিছুই করতে পারবে না, আর এভাবে দিনের পর দিন তারা ক্লাস বন্ধ করে থাকবে এটা হয় না।
প্রধানমন্ত্রী একটি স্কুলে প্রথম আলো আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আয়োজকদের অবহেলায় বিদ্যুতস্পৃষ্ট হয়ে ঢাকা রেজিডেন্সিয়াল স্কুল ও কলেজের এক ছাত্রের মৃত্যুর নিন্দা জানিয়ে বলেন, ‘তারা (প্রথম আলো) কিভাবে এ ধরনের অবহেলা করতে পারে? স্কুল শিক্ষার্থীরা যেখানে ঘোরাফেরা করছে সেখানে এই ধরনের একটি অনুষ্ঠান আয়োজনে তাদের কোন দায়িত্বশীলতা ছিল না। এটি একটি গুরুতর অভিযোগ, এটি সহ্য করা যায় না। এটি বরদাশত করা হবে না। অনুষ্ঠানস্থলের আশপাশেই শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স এবং ট্রমা সেন্টারের মতো হাসপাতাল থাকা সত্ত্বেও ছাত্রটিকে মহাখালীর একটি বেসরকারী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী প্রথম আলো কর্তৃপক্ষের সমালোচনাও করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী গণমাধ্যমের উন্নয়নে তার সরকারের গৃহীত কর্মকান্ডের কথা তুলে ধরে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার যত বেশি উন্মুক্ত করে দেয়, যত বেশি সুযোগ দেয়, ততবেশি সমালোচনারও সম্মুখীন হয়। আগে কথাও বলতে পারত না, কাজেই সে সমালোচনাও করতে পারত না। সেটা আমি চিন্তা করি না। আমি মনে করি যে, কাজ করব দেশের জন্য এবং নিজের আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ করি। গত এক দশকে বাংলাদেশ আজকে আর্থ-সামাজিকভাবে উন্নতি করেছে, দেশ এগিয়ে গেছে।
গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য বেসরকারী পর্যায়ে ট্রাস্ট ফান্ডেও অনুদান দিয়েছি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তবে আমরা যে ট্রাস্ট ফান্ড করেছি এখানে কথা ছিল এবং আমাদের টেলিভিশনের আর্থিকভাবে সচ্ছল মালিকদের বলেছিলাম এই সব ট্রাস্ট ফান্ডে যেন অনুদান দেয়। কিন্তু ইত্তেফাক থেকে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সাহেব এবং স্কয়ার গ্রুপের মাছরাঙা থেকে অঞ্জন চৌধুরী এই দুই জনেই বোধ হয় অনুদান দিয়েছেন। আর কেউ দিয়েছি কি না, জানি না। এ সময় সামনে বসে থাকা একজন সম্পাদক অনুদান দেয়ার কথা বললে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অবজারভার থেকে কত? খুব কম। অথচ সবাই যদি একটু একটু করে দেয় এবং সবসময় যদি দিতে থাকে তাহলে কিন্তু ভাল একটা এ্যামাউন্ট জমা হয়। আমরা সরকারের পক্ষ থেকে সিড মানি যেটা সেটা দিয়ে ট্রাস্ট ফান্ড করে দিয়েছি।
গণমাধ্যমকর্মীদের চাকরিতে অনিশ্চয়তা, বেতন-ভাতা, পেনশন, চিকিৎসা ভাতাসহ বিভিন্ন অস্থিরতার প্রসঙ্গ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার চেষ্টা হচ্ছে, প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে এইভাবে ট্রাস্ট ফান্ড করে করে যাচ্ছি। কিন্তু এখানে যদি নিজেদের গরজ থেকেও কিছু দেয়া হয় তাহলে কিন্তু একটা ভাল এ্যামাউন্টও জমা হয় এবং সেটা নিরাপত্তাটা নিশ্চিত করে। আমি সরকারে যখনি এসেছি তখনই চেষ্টা করি, যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর কল্যাণ ফান্ড একটা আছে, আবার সেটা দেই কেন? কাকে দেই? কেন দেই, কোথায় থেকে দেই? এই নীতিমালা কি? এসব প্রশ্নেরও সম্মুখীন হতে হয়।
উদাহরণ তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, যেমন আমাদের অফিসে একটা চিঠি এসে গেল? কোন নীতিমালায় প্রধানমন্ত্রী টাকা দেন, আমি বলেছি লিখে দেন, প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছার নীতিমালায় দেন। এই ধরনের প্রশ্ন ওঠে। যাই হোক, মানুষকে সহযোগিতা করব, সেটা নিয়েও প্রশ্ন? তারপরে আবার তারাই বলবে, কথা বলার অধিকার নেই। এমনকি কোর্ট থেকে স্বনামধন্য একজন আইনজীবী তথ্য চাইলেন, কোন নীতিমালার ভিত্তিতে দেয়া হয়? আসলে সব কিছুর একটা নীতিমালা আছে, নিয়ম আছে, সব করাই আছে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা আমার কথা জানেন, কেউ অপরাধ করলে আমি অপরাধীকে অপরাধী হিসেবেই দেখি। সে কোন দল করে বা কী করে, সেটা আমার কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়। আমি অপরাধীদের কোন মতে রক্ষা করার জন্য বলি না, আমার দলের সম্মান নষ্ট হবে বা আমার দল ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমি কিন্তু সেটা চিন্তা করি না। আমার কাছে কিন্তু অপরাধী অপরাধীই। সে হিসেবেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেই এবং সেটা আমরা নিয়ে যাচ্ছি।
তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডাঃ মুরাদ হাসান এবং তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হাসানুল হক ইনু মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন। তথ্য সচিব আবদুল মালেক অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব মোঃ নজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সাজ্জাদুল হাসান, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ এবং প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার মোঃ নজরুল ইসলাম অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়াও বাংলাদেশ অবজারভার সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী, বিশিষ্ট সাংবাদিক আবেদ খান, পিআইবির মহাপরিচালক জাফর ওয়াজেদ, বিটিভির মহাপরিচালক এসএম হারুনুর রশিদ, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি মোল্লা জালাল, মহাসচিব শাবান মাহমুদ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতি আবু জাফর সূর্য, সাধারণ সম্পাদক সোহেল হায়দার চৌধুরী প্রমুখ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।