কাজিরবাজার ডেস্ক :
মায়ের কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও অবিভক্ত ঢাকার সাবেক মেয়র মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা। সর্বস্তরের মানুষের শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন, ধূপখোলা মাঠে শেষ জানাযা ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অব অনার প্রদান শেষে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় জুরাইন গোরস্তানে মায়ের কবরে তাঁকে দাফন করা হয়।
বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা ২৬ মিনিটে এমিরেটস এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছে সাদেক হোসেন খোকার লাশ। সেখানে তাঁর লাশ গ্রহণ করতে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুসহ বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী। মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে সোমবার যুক্তরাষ্ট্রে মারা যান সাদেক হোসেন খোকা। ওই দিনই যুক্তরাষ্ট্রে খোকার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। বুধবার বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ১০টায় তাঁর লাশ নিয়ে স্বজনরা এমিরেটস এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে নিউইয়র্ক ত্যাগ করেন। সঙ্গে ছিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আব্দুস সালাম, খোকার স্ত্রী ইসমাত হোসেন, বড় ছেলে ইসরাক হোসেন, ছোট ছেলে ইসফাক হোসেন, মেয়ে সারিকা সাদেক প্রমুখ।
বিমানবন্দর থেকে সংসদ ভবনে যাওয়ার পথে নেতাকর্মীবেষ্টিত সাদেক হোসেন খোকার মরদেহবাহী এ্যাম্বুলেন্সের চারপাশে বিএনপির নেতাকর্মীরা কেউ হেঁটে, কেউ গাড়ি ও মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে এগোতে থাকেন।
জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জানাযা ও শ্রদ্ধা নিবেদন : বেলা সোয়া ১১টায় জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় সাদেক হোসেন খোকার দ্বিতীয় নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। জানাযা শেষে সেখানে তাঁকে গার্ড অব অনার দেয়া হয়।
জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জানাযায় অংশ নিয়ে খোকার লাশের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাসহ সর্বস্তরের মানুষ। জানাযা শেষে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেন, সাদেক হোসেন খোকা ভাল মানুষ ছিলেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, সাদেক হোসেন খোকা সর্বজন স্বীকৃত রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনি আধুনিক ঢাকা গড়তে কাজ করছেন। বিকল্প ধারা সভাপতি ও সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, খোকা দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। এলডিপি সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ বলেন, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি সাদেক হোসেন খোকার রাজনৈতিক জীবন নিয়ে গর্ব করি। সেখানের জানাযায় আরও অংশ নেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ড. সালেহ উদ্দিন, ওয়ার্ক পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, সাবের হোসেন চৌধুরী, কল্যাণ পার্টির সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহিম, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, জাপা মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা, ঢাকা উত্তর সিটি মেয়র আতিকুল ইসলাম প্রমুখ।
সেখানে খোকার জন্য দোয়া চাইতে গিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে তার ছেলে ইঞ্জিনিয়ার ইসরাক হোসেন বলেন, বাবা বলেছিলেন, আমি বাক্সবন্দী হয়ে দেশে যাব। তিনি ঠিকই বাক্সবন্দী হয়ে দেশে এলেন। এ চিত্র আমি কখনও ভুলতে পারব না। তার বুকে চাপা কষ্ট ছিল। তিনি নিজ দেশে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারেননি। ট্রাভেল ডকুমেন্ট নিয়ে তাঁর লাশ আনা হয়েছে। আমার বাবা ২০১৭ সালে পাসপোর্ট নবায়ন করতে আবেদন করেছেন কিন্তু সেটা পাননি। ফলে তিনি জীবিত থাকতে দেশে অসতে পারেননি। বাবাকে দেখতে আমি যেদিন নিউইয়র্ক গেলাম সেদিন শেষ কথা বলেছেন। বাবা আমাকে বলেছেন, তাঁর জানাযা যেন দেশে হয়। বাবার মরদেহ দেশে আনতে সহযোগিতা করার জন্য আমি সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। এখানে সব রাজনৈতিক দলের নেতাসহ সর্বস্তরের মানুষের উপস্থিতি প্রমাণ করে আমার বাবার সঙ্গে সকলের সুসম্পর্ক ছিল।
শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা : জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজা থেকে দুপুর ১২টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেয়া হয় খোকার লাশবাহী কফিন। দুপুর ১টা পর্যন্ত সেখানে সর্বস্তরের মানুষ তাঁর কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সাদেক হোসেন খোকাকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলেন সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বাসদ সভাপতি খালেকুজ্জামান, গণফোরাম নেতা অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, সুব্রত চৌধুরী, জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব, এলডিপি মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের সভাপতি জোনায়েদ সাকি, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ জাফরউল্লাহ চৌধুরী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ফকির আলমগীর, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, চিত্রনায়ক উজ্জল, ডাকসু সহসভাপতি নুরুল হক নুরু প্রমুখ। এ ছাড়া বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের অন্য নেতাকর্মীরা ছিলেন।
বিএনপি কার্যালয়ের সামনে শেষ শ্রদ্ধা ও জানাযা : বাদ জোহর নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নেয়া হয় সাদেক হোসেন খোকার লাশ। সেখানে দলীয় নেতাকর্মীদের শ্রদ্ধা নিবেদন ও তৃতীয় নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। কফিনে দলীয় পতাকা মুড়িয়ে ফুল দিয়ে প্রথমে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলসহ সিনিয়র নেতারা। এরপর অন্য নেতাকর্মীরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় ফকিরাপুল মোড় থেকে বিএনপি কার্যালয় পর্যন্ত বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
সেখানের জানাযা ও শ্রদ্ধা নিবেদনে সাদেক হোসেন খোকার দুই ছেলে ইসরাক হোসেন ও ইসফাক হোসেন ছাড়াও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ড. মোশাররফ, মওদুদ আহমদ, ড. আব্দুল মঈন খান, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, শাহজাহান ওমর, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, বরকত উল্লাহ বুলু, আবদুল আউয়াল মিন্টু, জয়নাল আবেদীন, দলের নেতা রুহুল কবির রিজভী, মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, হাবিবউন নবী খান সোহেল, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, ২০ দলীয় জোটের নেতা জামায়াতের অধ্যাপক মজিবুর রহমান, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান প্রমুখ।
দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে চতুর্থ জানাযা ও শ্রদ্ধা নিবেদন : বিকেল ৩টায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ভবনে চতুর্থ নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে মেয়র সাঈদ খোকনসহ সিটি কর্পোরেশনের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় খোকা মেয়র থাকা অবস্থায় সেখানে কর্মরত ছিলেন এমন ক’জন কর্মচারী কফিনের সামনে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। সাদেক হোসেন খোকার সম্মানে বৃহস্পতিবার এই সিটি কর্পোরেশনের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর সাধারণ ছুটি ছিল।
দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে জানাযার আগে মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, একজন মেয়র হিসেবে নগরবাসীর সেবা করে গেছেন অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা। তিনি দলমত নির্বিশেষে মানুষের সেবা করে গেছেন, এটাই ছিল তার আদর্শ। তার মৃত্যুতে ঢাকাসহ দেশবাসী শোক প্রকাশ করছে। মহান রাব্বুল আল আমিনের কাছে দোয়া করি যেন, তার ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করেন, আমিন।
ধূপখোলা মাঠে শেষ জানাযা : ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ভবন থেকে খোকার লাশ নেয়া হয় গোপীবাগের নিজ বাসায়। বাসায় লাশ পৌঁছার পর কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন প্রিয় আত্মীয়স্বজন ও এলাকাবাসী। এ সময় সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। আত্মীয়স্বজনদের শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বাদ আসর ধূপখোলা মাঠে ৫ম এবং শেষ জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে তার দীর্ঘদিনের প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনরা শেষ শ্রদ্ধা ও জানাযায় অংশ নেন। সেখানে জানাযা ও রাষ্ট্রায় মর্যাদায় গার্ড অব অনার শেষে সন্ধ্যায় জুরাইন গোরস্তানে মায়ের কবরে তার লাশ দাফন করা হয়।