কাজিরবাজার ডেস্ক :
চলমান শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবে এবার আওয়ামী লীগের তৃণমূল কমিটি থেকে বিতর্কিতদের বাদ দেওয়ার কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হলেও এ পর্যায়ের দুর্নীতিবাজ নেতাকর্মীদের এখনো টনক নড়েনি। বরং ধীর গতির অভিযানের ঢেউ কোনোভাবেই তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছবে না- এ প্রত্যাশায় তারা অনেকে হাইকমান্ডের এ হুঁশিয়ারি থোড়াই কেয়ার করছেন। দলের শীর্ষপর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সর্বস্তরে শুদ্ধি অভিযান চালানো হলে ‘ঠগ বাঁছতে গা উজাড়’ হবে বলেও কেউ কেউ প্রকাশ্যে দম্ভ দেখাচ্ছেন। ফলে স্থানীয় পর্যায়ে সন্ত্রাস-দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা অনেকটা আগের মতোই রয়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দাদের পাশাপাশি খোদ আওয়ামী লীগের প্রথম সারির একাধিক নেতাও এ বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আওয়ামী লীগের সহযোগী বিভিন্ন সংগঠনের দুর্নীতিবাজ শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে দলীয় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি ফৌজদারি মামলা হওয়ায় মূল দলের প্রথম সারির বিপুলসংখ্যক নেতা এখন তটস্থ। বিশেষ করে যাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস-দুর্নীতিসহ নানা অপকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে তারা এখন রাতারাতি ভোল পাল্টে নিষ্ঠাবান ত্যাগী নেতাদের কাতারে দাঁড়াতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। অথচ তৃণমূলের বিতর্কিত নেতাকর্মীরা এখনো আগের মতো দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। আর এ কারণে শুদ্ধি অভিযানের ইতিবাচক প্রভাব এখনো সমাজের সাধারণ স্তরে পৌঁছেনি বলে মনে করেন তারা।
একই ধরনের অভিমত প্রকাশ করে দায়িত্বশীল একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, শুদ্ধি অভিযান শুরুর পর মদ-জুয়া-ক্যাসিনো ও টেন্ডারবাজির ঘটনা বেশকিছুটা কমলেও ক্ষমতাসীন দলের তৃণমূলে চাঁদাবাজি-দখলবাজি, এলাকার আধিপত্য বিস্তার নিয়ে অবৈধ অস্ত্রের মহড়া আগের মতোই রয়ে গেছে। স্থানীয় পর্যায়ের বেশকিছু নেতা ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে ফুটপাতে হকার বসিয়ে ‘তোলা’ আদায়, অবৈধ পরিবহন পরিচালনা, ময়লা-ডিস ও নেট বাণিজ্য আগের মতোই নির্বিঘেœ চালিয়ে যাচ্ছেন।
জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই-এর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বলেন, তৃণমূল কমিটি থেকে বিতর্কিত নেতাদের সরিয়ে দেওয়ার জন্য সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা যে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন, তাতে তারা গুরুত্ব দিলে তৃণমূলের পরিবেশ-পরিস্থিতি পুরোপুরি পাল্টে যাওয়ার কথা। অথচ বাস্তবে তা ঘটেনি। স্থানীয় পর্যায়ের যেসব নেতাকর্মী দীর্ঘদিন ধরে নানা অপকর্মে জড়িত তারা রাতারাতি সে পথ থেকে সরে এসেছে- এ ধরনের কোনো তথ্য মাঠপর্যায় থেকে পাওয়া যায়নি বলেও জানান ওই এনএসআই কর্মকর্তা।
বরং দলের তৃণমূলে নজর দিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কঠোর নির্দেশনার পরও এ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নানা অপকর্ম চালিয়ে যাওয়ার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে যেসব এলাকার জেলা পর্যায়ের শীর্ষ নেতারা সরাসরি সন্ত্রাস-দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত, ওইসব এলাকার তৃণমূল নেতাকর্মী আগের মতোই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের বিশ্বাস, দলীয় হাইকমান্ড ছোট নেতাদের আগে বড় নেতাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে। ফলে তারা সতর্ক হওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় হাতে পাবে। আর বিতর্কিত ছোট নেতাদের বিরুদ্ধে আগে অ্যাকশনে নামলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা বড় নেতারা সামনে এসে দাঁড়াবে।
অন্যদিকে স্থানীয় পর্যায়ের বিতর্কিত নেতাদের সরিয়ে দিয়ে পেশিশক্তিতে দুর্বল নিষ্ঠাবান-ত্যাগী নেতাদের তৃণমূল কমিটিতে আনা হলে উল্টো দলই বিপাকে পড়বে। তাই দলীয় হাইকমান্ড মুখে নানা হুমকি ধামকি দিলেও শেষপর্যন্ত এ ধরনের ঝুঁকি নেবে না বলে মনে করেন তৃণমূলের দুর্নীতিবাজ নেতাকর্মীরা।
তবে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের দাবি, দলের তৃণমূলে দুর্নীতিবাজ নেতাকর্মীর সংখ্যা অতি নগণ্য। এছাড়া এদের একটি বড় অংশ দলে অনুপ্রবেশকারী। দলের নাম ভাঙিয়েই এসব বিতর্কিত নেতা এতদিন দাপট দেখিয়ে আসছে। তৃণমূল কমিটি থেকে তাদের সরিয়ে দেওয়া হলে তাদের ক্ষমতার ভিত্তি মুহূর্তে গুঁড়িয়ে যাবে। স্থানীয় পর্যায়ের নিষ্ঠাবান-ত্যাগী নেতাদের পক্ষে তাদের নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন হবে না বলে মনে করে আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড।
যদিও এ বিষয়টি এত সহজে সমাধান করা যাবে তা মনে করছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের ভাষ্য, সন্ত্রাস-দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত তৃণমূল নেতাদের যারা নির্বাচিত করেছেন, আগে তাদের সরানো না গেলে এ অবস্থার পরিবর্তন করা কঠিন হবে। কেননা, তারা দলের নেতৃত্বে থাকলে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তৃণমূলের একদল বিতর্কিত নেতাকে সরিয়ে দিয়ে অন্য আরেক দল বিতর্কিত নেতাকে নির্বাচিত করবেন। এছাড়া তাদের মাধ্যমেই জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা দলে অনুপ্রবেশ করবে। ফলে তৃণমূলে শুদ্ধি অভিযানের লক্ষ্য ব্যর্থ হবে।
তবে আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের একাধিক নেতার দাবি, তৃণমূলের বিতর্কিত নেতাদের বাদ দেওয়া খুব বেশি কঠিন হবে না। এরইমধ্যে কোথাও কোথাও বিতর্কিত নেতাকর্মীদের সরিয়ে দেয়ার তৎপরতা শুরু হয়েছে। সেখানে এর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। বরং স্থানীয় নেতাকর্মীরা তা সাদরে গ্রহণ করেছেন।
জেলা নেতাদের অনেকের দাবি, জেনেশুনে তারা সন্ত্রাস-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কাউকে তৃণমূল কমিটিতে ঠাঁই দেননি। বরং যোগ্য ব্যক্তিকেই তারা নেতা নির্বাচিত করেছেন। তবে সঠিক নজরদারির অভাবে এদেরই একটি অংশ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে। এছাড়া জামায়াত-শিবিরের কেউ কেউ তথ্য গোপন করে দলে ঢুকেছে। এদের চিহ্নিত করে দল থেকে সরিয়ে দেওয়া হলে নতুন করে নির্বাচিত নেতাদের কর্মকান্ড কেমন হবে তারা তার আগাম বার্তা পেয়ে যাবে। পাশাপাশি পুরান তিক্ত অভিজ্ঞতা বিবেচনায় রেখে জেলা নেতারা তাদের নেতাকর্মীদের সার্বিক কার্যকলাপ মনিটরিংয়ে রাখতে সক্রিয় থাকবে।
তবে আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, তৃণমূলের নেতা নির্বাচনে দলীয় হাইকমান্ড এবার আরও বেশি সতর্ক থাকবে। নতুন কমিটির প্রস্তাব স্থানীয় নেতাদের কাছ থেকে নেওয়া হলেও প্রতিটি নেতার ব্যাপারে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা হবে। দু’পক্ষের তথ্য ক্রসচেক করার পরই তাদের ব্যাপারে গ্রিন সিগন্যাল মিলবে। সন্ত্রাস-দুর্নীতিসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিংবা জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারো নাম জেলা নেতারা প্রস্তাব করলে তা জানা মাত্র কৈফিয়ত তলব করা হবে।
এদিকে তৃণমূলের বিতর্কিত নেতাদের বিরুদ্ধে দলীয় হাইকমান্ডের কঠোর অবস্থানের বার্তা দেশের প্রতিটি মহানগর ও জেলা পর্যায়ে পৌঁছানোর পর বাস্তবিক অর্থে যে বড় ধরনের কোনো প্রভাব পড়েনি তা তৃণমূল নেতাদের অপকর্মের ফিরিস্তি পর্যালোচনায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
গত ২৭ অক্টোবর সাভারের আশুলিয়ায় থানা যুবলীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক মঈনুল ইসলাম ভূঁইয়া ও তার সহযোগীরা মাকসুদা বেগম নামের এক নারীর মালিকানাধীন একটি মার্কেট দখল করেন। এ সময় তারা দোকান-পাট ভাঙচুর করে ৭৬ লাখ ৯২ হাজার টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। এ অভিযোগে মার্কেট মালিক আশুলিয়া থানায় ক্ষমতাসীন দলের ১৪ জনের বিরুদ্ধে দখলবাজি ও লুটপাটের মামলা করেন।
গত ২২ অক্টোবর পঞ্চগড়ের ৩ নং দেবীগঞ্জ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ চাঁদা না দেওয়ায় দেবীডুবা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ সমারু বর্মণকে মারধর করেন। এ ঘটনায় থানায় অভিযোগ করা হয়েছে।
গত ২৪ অক্টোবর রেজাউল করিম রাজা নামের এক ভুক্তভোগী সংবাদ সম্মেলন করে খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগাঠনিক সম্পাদক আশরাফ হোসেনের বিরুদ্ধে বাড়ি দখলের অভিযোগ করেছেন। তিনি জানান, তকদীর বাবু নামে এক চিহ্নিত ভূসিদস্যুকে দিয়ে ব্যাপক দখলবাজি ও আধিপত্য বিস্তার করায় ‘আশরাফ-তকদীর বাবু’ গ্যাং নামে এলাকায় পরিচিত হয়ে উঠেছেন।
গোয়েন্দাদের ভাষ্য, দলীয় হাইকমান্ডের কঠোর নির্দেশনার পরও বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের অপরাধমূলক অপতৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের তৃণমূলের যেসব নেতাকর্মী দীর্ঘদিন ধরে নানা ধরনের দুর্নীতি ও সন্ত্রাসীমূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করে আসছেন, তারা বেশিরভাগই আগের অবস্থানেই রয়েছে। অভিযুক্তদের কারো বিরুদ্ধে দলীয় কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তবে তৃণমূলের বেশকিছু বিতর্কিত নেতা তাদের অপকর্মের বিশাল ফিরিস্তি ফাঁস হওয়ার ভয়ে আপাতত কিছুটা সামলে চলছেন। প্রকাশ্য অপতৎপরতা থেকে সরে থাকলেও গোপনে তারা সক্রিয় রয়েছেন বলে মনে করেন গোয়েন্দারা।