আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন ॥ পদ-পদবী পেতে যাচ্ছেন সাবেক ছাত্র নেতা ও তরুণরা

23

কাজিরবাজার ডেস্ক :
জাতীয় সম্মেলন ঘিরে সর্বত্র ক্লিন ইমেজের তরুণদের আহ্বান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগে। দলে নতুন নেতৃত্ব তৈরি করতে এবার স্বচ্ছ ইমেজের তরুণদের কাছে টানছে দলটি। আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় ও সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনে তরুণদের পদায়নকে অগ্রাধিকার দিয়েই পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন দলের নীতিনির্ধারকরা।
বর্তমান মন্ত্রী সভার মতোই এবারের সম্মেলনে আওয়ামী লীগেরও তরুণ নেতারা প্রাধান্য পেতে যাচ্ছেন। ক্লিন ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তির একঝাঁক তরুণ সাবেক ছাত্রনেতাদের সামনে যেমন কেন্দ্রীয় ও সহযোগী সংগঠনে পদ লাভের হাতছানি, তেমনি গত ১০ বছরে বিতর্কিত ও সাংগঠনিক কর্মকান্ডে ব্যর্থ অনেক কেন্দ্রীয় ও সহযোগী সংগঠনের অনেক নেতাই পদ হারানোর ভয়ে এখন আতঙ্কিত। সব মিলিয়ে কাউন্সিল যতই ঘনিয়ে আসছে, ক্ষমতাসীন দলটিতে নতুন নেতৃত্ব নিয়ে চলছে নতুন মেরুকরণ।
নভেম্বর থেকেই শুরু হবে সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর ধারাবাহিক সম্মেলন। ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ত্রি-বার্ষিক জাতীয় সম্মেলন। দলে নতুন পদ পেতে এবং নিজের পদটুকু অন্তত ধরে রাখতে নেতাদের পদচারণায় এখন মুখরিত আওয়ামী লীগের বঙ্গবন্ধু এভিনিউ ও ধানমন্ডির কার্যালয়। দলের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, নতুন নেতৃত্ব তৈরি এবং যোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্ব বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। দলের গত তিনটি জাতীয় সম্মেলনে এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নতুনদের নেতৃত্বে নিয়ে এসে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এবারও এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। অনেক নতুন মুখ আসবে, বাদ পড়তে পারেন বর্তমান কমিটির অনেকেই।
ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক জাতীয় সম্মেলনের জোর প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। সম্মেলন সফল করতে গঠিত বিভিন্ন উপ-কমিটি দফায় দফায় বৈঠক করে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। তবে সম্মেলনকে ঘিরে দলের সর্বত্রই একই আলোচনা, কেন্দ্রীয় ও সহযোগী সংগঠনগুলোয় কারা স্থান পাচ্ছেন, কাদের কপাল পুড়ছে! দুর্নীতি সন্ত্রাস ও বিতর্কিত কর্মকা-ে জড়িত নেতাদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর অবস্থান ও সারাদেশে চলা শুদ্ধি অভিযানে স্বচ্ছ ও ক্লিন ইমেজে সাবেক ছাত্রনেতাদের এবার মূল নেতৃত্বে আসার পথ মসৃণ করেছে।
দলের সিনিয়র একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনেও এবার বেশকিছু রদবদল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ছাত্রলীগের সাবেক কিছু নেতা, বিশেষ করে যারা সংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক বা শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বে ছিলেন এবং বর্তমানে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ভূমিকা পালন করছেন, তাদের একটি অংশ এবার কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পেতে পারেন। বড় পদ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও বিতর্ক এড়াতে অধিকাংশ ত্যাগী ছাত্রনেতাই সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর পরিবর্তে কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পেতেই দেন-দরবার চালিয়ে যাচ্ছেন।
২০১৬ সালের সর্বশেষ জাতীয় সম্মেলনেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তরুণ ও নতুন মুখ কেন্দ্রীয় কমিটিতে নিয়ে আসা হয় এবং গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয়। তখন পুরান অনেকেই কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বাদ পড়েন। এবারও নতুনদের স্থান করে দিতে বর্তমানে যারা কেন্দ্রীয় কমিটিতে আছেন তাদের মধ্য থেকে অনেকেই বাদ পড়বেন। আবার অনেক সিনিয়র নেতাকে উপদেষ্টা পরিষদে নিয়ে সেখানে বর্তমান মধ্যম সারির বেশ ক’জন নেতার পদোন্নতি পেয়ে সভাপতিমন্ডলীর সদস্য হিসেবে দেখা যেতে পারে। সম্মেলনে নতুন নেতৃত্ব প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, যোগ্যতার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের নেতা নির্বাচিত হবে। সম্মেলন মানেই কিছু নতুন মুখ আসবে। আমরা ক্লিন ইমেজের নেতৃত্ব গড়ে তুলতে চাই। কাউকে আমরা রিটায়ারমেন্ট (অবসর) দিই না, দায়িত্বে পরিবর্তন হয়। দলের সহযোগী সংগঠনগুলোকে আরও শক্তিশালী ও গতিশীল করতে নবীন-প্রবীণ সমন্বয়ে কমিটি করা হবে। আওয়ামী লীগ লুটপাট সন্ত্রাসীদের পার্টি নয়। মানুষের মন জয় করে ক্ষমতায় থাকতে চাই। সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, মাদক কারবারি, ভূমি দখলদার, অপকর্মের সঙ্গে জড়িতদের আওয়ামী লীগে দরকার নেই। তারা সম্মেলনে কোন পদ পাবে না।
দলীয় সূত্র বলছে, দল শক্তিশালী রাখতে সাংগঠনিক ভিত্তি শক্ত করার ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা যাতে সর্বক্ষণিক দলে সময় দিতে পারেন, এ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা এক নেতা একই সময় মন্ত্রী হলে তাঁকে দল ও সরকারে দায়িত্ব পালন করতে হয়। এ অবস্থায় দুই দিকে সময় দিতে গিয়ে কোন কোন ক্ষেত্রে কার্যক্রম ব্যাহত হয়। তাই এ বিষয়টিও আলোচনায় আসছে বেশ জোরালোভাবেই। বিভিন্ন সময় বঙ্গবন্ধুর উদাহরণ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন, মন্ত্রিত্ব ছেড়ে বঙ্গবন্ধু দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের মধ্যে বিষয়টি স্পষ্ট।
এবারের মন্ত্রী সভার সদস্যদের মধ্যে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে রয়েছেন ১০। আগামী সম্মেলনে এটা আরও কমে আসতে পারে। দল ও সরকারকে আলাদা করার দীর্ঘদিনের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই তা করা হতে পারে। এছাড়া গত দুই টার্মে সাংগঠনিক কর্মকান্ডে ব্যর্থ কয়েক বর্তমান কেন্দ্রীয় নেতাও এবারের সম্মেলনে বাদ পড়তে পারেন বলেও আভাস পাওয়া গেছে।
শুধু কেন্দ্রেই নয়, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনেও নতুন নেতৃত্ব নিয়ে চলছে নানামুখী মেরুকরণ। যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ ছাড়াও ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে কে আসছেন সে আলোচনা এখন শীর্ষে। বিশেষ করে যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের বেশ কিছু নেতার সম্পর্কে অনিয়ম ও দুর্নীতির যে অভিযোগ উঠেছে, এর ফলে এ দুটি সংগঠনের নেতৃত্বে ব্যাপক পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা স্পষ্ট। সংগঠন দুটির কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে সদস্য পর্যন্ত অনেকেই এবার বাদ পড়বেন। এর পরিবর্তে নেতৃত্বে আসতে পারেন স্বচ্ছ ভাবমূর্তির বেশ কিছু সাবেক ছাত্রনেতা। অবশ্য সংগঠন দুটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে কে আসছেন এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আগামী ২৩ নভেম্বর বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত যুবলীগের জাতীয় কংগ্রেস। এরইমধ্যে যুবলীগের নেতৃত্বের বয়সসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫ বছর। এই বয়সসীমার ওপরে কেউ দলের নেতৃত্বে আসতে পারবেন না। সংগঠনের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীকে আগেই অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। প্রেসিডিয়াম, সাধারণ সম্পাদক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকের অনেকেই বয়সের কারণে নতুন কমিটি থেকে বাদ পড়বেন। সেক্ষেত্রে বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতাদের সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যুবলীগের সম্মেলনেও একঝাঁক তরুণ সাবেক ছাত্রনেতাদের বিভিন্ন পদে দেখা যেতে পারে। স্বেচ্ছাসেবক লীগে নেতাদের বয়সের বাধ্যবাদকতা না থাকলেও তরুণ ও পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির নেতাদেরই এই সংগঠনের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। এখানেও বিতর্কিত এবং অনিয়ম-অপকর্মের সঙ্গে জড়িত কাউকে কোন পদে রাখা হচ্ছে না। আগামী ১৬ নভেম্বর স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। ইতোমধ্যে সংগঠন সভাপতি মোল্লা আবু কাউছারকে অব্যাহতি এবং সাধারণ সম্পাদক পংকজ দেবনাথকে সম্মেলনের কার্যক্রম থেকে দূরে রাখা হয়েছে। জানা গেছে, আগামী সম্মেলনে স্বেচ্ছাসেবক লীগে সবচেয়ে বেশি সাবেক ছাত্রনেতারা স্থান পেতে পারেন।
সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা না হলেও ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আগেই আন্দোলন-সংগ্রামের সূতিকাগার বলে খ্যাত ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগেরও সম্মেলন হবে। সংগঠন দুটির বর্ধিত সভায় দ্রুত সম্মেলনের প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। জানা গেছে, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের মতো ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের সম্মেলনেও নেতৃত্বে ব্যাপক পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
জানা গেছে, বেশকিছু সাবেক ছাত্রনেতার পাশাপাশি ঢাকা মহানগরে পোড়খাওয়া ত্যাগী ও ক্লিন ইমেজের নেতাদের এবার সংগঠন দুটির বড় বড় পদে দেখা যেতে পারে। সম্মেলন ঘিরে ক্ষমতাসীন দলে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হলেও বড় বড় পদে ঠিক কারা আসছেন তা দেখার জন্য সবাই তাকিয়ে রয়েছেন দলটির দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার দিকে। কারণ সব নেতার অতীত কর্মকান্ডের আমলনামা তার হাতে। সবকিছু বিবেচনা করে আওয়ামী লীগ সভাপতি যাকে মনোনীত করবেন, তিনিই হবেন এসব সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।