আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ॥ দুর্যোগ মোকাবেলায়ও বাংলাদেশ রোল মডেল

23
আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাকৃতিক ও মানব সৃষ্ট যেকোন ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশ সবসময় প্রস্তুত থাকবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, বিশ্বে এখন আমরা শুধু উন্নয়নের রোল মডেলই নয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায়ও রোল মডেল হিসেবে একটা সম্মান পেয়েছি। বন্যা খরা ঘূর্ণিঝড় অগ্নিকান্ড এসবে ক্ষয়ক্ষতি যাতেহ্রাস পায় তার জন্য যা ব্যবস্থা নেয়ার ইতোমধ্যে আমরা তা নিয়েছি। যা আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে এবং সবাই মনে করে এটাও বাংলাদেশের কাছ থেকে শেখার রয়েছে। অনেকে আমাদের কাছ থেকে এটা এখন জানতে চায়।
রবিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস-২০১৯ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থানের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী যে কোন ধরনের দুর্যোগের জন্য সকলকে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, যেকোন মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগ আসুক আর প্রাকৃতিক দুর্যোগই আসুক সব ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশ সবসময় প্রস্তুত থাকবে সেটাই আমি চাই। আমাদের ভলান্টিয়াররা (স্বেচ্ছাসেবক) নিবেদিত প্রাণ হয়ে কাজ করবে, সেটারই আমি আশা পোষণ করি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, চলতি বছর জুলাই মাসে ঢাকায় গ্লোবাল কমিশন অন এ্যাডাপ্টেশন’র সভা হয়েছে। সেখানে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন দুর্যোগ প্রতিরোধে বাংলাদেশের সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘বিশ্ব অভিযোজন কেন্দ্র- ঢাকা অফিস’ স্থাপনের ঘোষণা দেন। প্রধানমন্ত্রী এ সময় যেকোন ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় জান-মালের ক্ষয়-ক্ষতি কমিয়ে আনার জন্য ত্বরিত পদক্ষেপ গ্রহণেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, আমরা দেশকে গড়ে তুলতে চাই উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে। জাতির পিতা স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন। তাঁর একটা স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশ হবে ক্ষুধা এবং দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ। আমরা সেই সোনার বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি।
দুর্যোগ মোকাবেলায় তাঁর সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ ও সাফল্যগুলো তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর আমরা দুর্যোগ বিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলী- ১৯৯৭ প্রণয়ন করেছিলাম। পরবর্তীতে আমরাই আবার ২০১০ সালে এটি হালনাগাদ করি। জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিল গঠন করি। ২০১২ সালে তার সরকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন প্রণয়ন করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই আইনের আওতায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর গঠন করা হয়েছে, যা দুর্যোগ মোকাবেলা, ঝুঁকি হ্রাস ও ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভ্যন্তরীণ বাস্তুহারা মানুষের দুর্দশার বিষয়গুলো আমলে নিয়ে ২০১৫ সালে আমরা একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করি এবং জাতীয় রিজিলিয়েন্স পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি, যা সেন্দাই ফ্রেমওয়ার্ক ও এসডিজি’র সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এছাড়াও তার সরকার ২০১৫ সালে ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার (এনইওসি) প্রতিষ্ঠা করেছে। বড় ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য পূর্বাচলে একটি স্টেজিং এরিয়া নির্মাণ করা হচ্ছে।
সরকারপ্রধান বলেন, ইতোমধ্যে সৈয়দপুর বিমানবন্দরের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণের কাজ শুরু হয়েছে, যেন জরুরী অবস্থায় এটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোরও প্রয়োজন মেটাতে পারে। মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে সিভিল মিলিটারি সমন্বয়ে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় রিজিওনাল কন্সালটেটিভ গ্রুপের (আরসিজি) মাধ্যমে আমরা আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রও সম্প্রসারিত করেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘূর্ণিঝড় থেকে জনগণের জানমাল রক্ষায় ১৭২টি সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণ করেন। স্থানীয় লোকজন এর নাম দিয়েছিলে মুজিব কেল্লা। তারই আলোকে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। দুর্যোগ মোকাবেলায় বর্তমানে প্রায় ৫৬ হাজার প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে আমাদের। তাছাড়া ৩২ হাজার নগর স্বেচ্ছাসেবক, ২৪ লাখ আনসার ভিডিপি, ১৭ লাখ স্কাউটস, ৪ লাখ বিএনসিসি, গার্লস গাইডের প্রায় ৪ লাখ সদস্য- তারাও এক্ষেত্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। যেকোন দুর্যোগের সময় তারা সকলে সেখানে উপস্থিত হয় এবং কাজ করে।
১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি এবং তখনকার ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারের উদাসীনতার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটা সরকার যদি সচেতন না থাকে, সজাগ না থাকে তাহলে কত বড় ক্ষতি হতে পারে সেটা একানব্বই সালের ঘূর্ণিঝড়ে আমরা দেখেছি। আমাদের সরকার ইতোমধ্যে ৩৭৮টি মুজিব কেল্লা নির্মাণ করেছে। আর উপকূলে ৩ হাজার ৮৬৮টি বহুমুখী সাইক্লোন শেল্টার সেন্টার নির্মাণ করা হয়েছে এবং আরও ১ হাজার ৬৫০টি সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করবার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা সব সময় যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এলে পূর্বাভাস দেয়া, যারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে সেই লোকগুলোকে সাইক্লোন শেল্টারে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করি। দুর্যোগকালীন সময়ে করণীয় বিষয়ে তাদের প্রশিক্ষণ ও সচেতন করা হয়। এরফলে এখন ঘূর্ণিঝড়ে মৃতের সংখ্যা একেবারে নাই। এছাড়া হেলিকপ্টারে করে পাহাড় ও দ্বীপ অঞ্চলে ‘ব্যাপক হারে’ বীজ ছড়িয়ে বনাঞ্চল সৃষ্টির কথাও উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে খাদ্য সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। আপতকালীন সময়ে গৃহস্থালিতে খাদ্য সংরক্ষণের জন্য হাউজহোল্ড সাইলো সরবরাহ করে যাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৯ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত আমরা ৩ লাখ ২৮ হাজার পরিবারে সাইলো বিতরণ করেছি। মোট আমরা ৫ লাখ পরিবারকে এই সাইলো দেব। এছাড়া বিভিন্ন জেলায় আমরা ৫ লাখ মেট্রিক টন ক্ষমতাসম্পন্ন ৮টি সাইলো কমপ্লেক্স নির্মাণ করছি। দুই বছর যাতে খাদ্য সংরক্ষণ করা যায় সে ধরনের খাদ্য গুদামও আমরা নির্মাণ করে যাচ্ছি। বাংলাদেশ নামের ব-দ্বীপকে টিকিয়ে রাখা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যাতে এটি ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ প্রণয়নের কথাও উল্লেখ করে তিনি বলেন, সদুরপ্রসারী, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়েছি। আগামী প্রজন্মর জীবন যেন সুন্দর হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমাদের এ পরিকল্পনা।
নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোতে আমরা মানুষকে দুর্যোগসহনীয় বাসগৃহ নির্মাণ করে দিচ্ছি। আমাদের লক্ষ্য আছে বাংলাদেশে একটা গৃহহারা মানুষও থাকবে না। বাংলাদেশ যে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছে সেখান থেকেও দুর্যোগকালীন সময়ে সুবিধা নেয়ার কথা জানান তিনি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডাঃ এনামুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান এ বি তাজুল ইসলাম এবং সিনিয়র সচিব মোঃ শাহ কামাল অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। ‘দুর্যোগ সহনীয় বাসগৃহ নির্মাণ’ প্রকল্পের আওতায় দুজন ‘দুর্যোগ সহনীয় বাসগৃহ’ প্রাপ্ত ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলার শিউলি রানী শীল এবং কুড়িগ্রামের মোঃ শহীদুল ইসলাম অনুষ্ঠানে নিজস্ব অনুভূতি ব্যক্ত করেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সেরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে এ বছর ৮২ জনকে ‘সিপিপি’ পুরস্কার দেয়া হয়। এরমধ্যে প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে তিনজনের হাতে সম্মাননা তুলে দেন। তারা হচ্ছেন- কক্সবাজারের চকোরিয়ার বুলবুল জান্নাত, ভোলার লালমোহনের এ কে এম কামরুল ইসলাম এবং খুলনার মোংলার সুস্মিতা মন্ডল। অনুষ্ঠানের শুরুতে বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন অগ্রগতি তুলে ধরে ভিডিও প্রদর্শন করা হয়। অনুষ্ঠান থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নবনির্মিত ১০০টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র এবং ১১ হাজার ৬০৪টি দুর্যোগসহনীয় বাড়ি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।