সাপ্তাহিক ঈদ জুম্মার দিন

41

মো: শামসুল ইসলাম সাদিক

জুম্মার দিন মুসলমানদের জন্য শ্রেষ্ঠ, ফাজিলত এবং মর্যাদাপূর্ণ দিন। জুম্মার দিনের জন্য রাসূল (সা:)-এর উম্মতগণ অন্য নবীর উম্মতদের আগে জান্নাতে যাবেন। কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে- হে মুমিনগণ! জুম্মার দিনে যখন নামাজের আযান দেওয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের দিকে এসো এবং বেচা-কেনা বন্ধ কর, এটা তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা বুঝ। অতঃপর নামাজ সমাপ্ত হলে ভূপৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) তালাশ কর ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর যাতে তোমরা সফলকাম হও (সূরা: জুম্মা, আয়াত- ৯,১০)। আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা:) ইরশাদ করেছেন- আমরা শেষে এসেছি কিন্তু কেয়ামতের দিন সকলের আগে থাকবো। যদিও অন্য সকল জাতিগুলো (ইহুদী ও খৃষ্টান)কে গ্রন্থ দেয়া হয়েছে আমাদের পূর্বে, আমাদের গ্রন্থ দেয়া হয়েছে তাদের পরে। অত:পর জেনে রাখো এই (জুম্মার) দিনটি আল্লাহ আমাদের দান করেছেন। তিনি এ ব্যাপারে আমাদের সঠিক পথে দিশা দিয়েছেন। আর অন্য লোকেরা এ ব্যাপারে আমাদের পিছনে আছে। ইহুদীরা জুম্মার পরের দিন (শনিবার) উদযাপন করে আর খৃষ্টানেরা তার পরের দিন (রবিবার) উদযাপন করে (বুখারী ও মুসলিম)। আবু লুবাবা ইবনে আবদুল মুনযির (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা:) ইরশাদ করেছেন- জুম্মার দিন সকল দিনের সরদার বা শ্রেষ্ঠ। আল্লাহর নিকট সকল দিনের চেয়ে জুম্মার দিন মর্যাদাবান। কোরবানীর দিন ও ঈদুল ফিতরের দিনের চেয়েও বেশী মর্যাদাশীল। আউস বিন আউস আস সাকাফী (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা:) ইরশাদ করেছেন-জুম্মার দিন যে ব্যাক্তি গোসল করে, পূর্বাহ্নে মসজিদে আগমন করে, পায়ে হেঁটে মসজিদে যায় (অর্থাৎ কোন কিছুতে আরোহন করে নয়), ইমামের কাছাকাছি গিয়ে বসে, মনোযোগ সহকারে খুৎবা শোনে, কোন কিছু দ্বারা খেল তামাশা করে না, এবং সে ব্যাক্তি আদব রক্ষা করে জুম্মার সালাত আদায় করে তার প্রতিটি পদক্ষেপের বিনিময়ে তার জন্য সারা বছরের রোজা পালন এবং রাত জেগে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার সমান সওয়াব আমলনামায় লিখা হয় (মুসনাদে আহমাদ)।
হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে যে, জুম্মার দিন আগে ভাগে মসজিদে যাওয়ার অনেক ফজিলত রয়েছে, যেমন দান-খয়রাত বা পশু কুরবানী করার সমতুল্য সওয়াব পাওয়া যায়। আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা:) ইরশাদ করেছেন- যে ব্যক্তি জুম্মার দিন ফরজ গোসলের মত গোসল করে প্রথম দিকে মসজিদে হাজির হয়, সে যেন একটি উট কুরবানী করল, দ্বিতীয় সময়ে যে ব্যাক্তি মসজিদে প্রবেশ করে সে যেন একটি গরু কুরবানী করল, তৃতীয় সময়ে যে ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করল সে যেন একটি ছাগল কুরবানী করল। অতঃপর চতুর্থ সময়ে যে ব্যক্তি মসজিদে গেল সে যেন একটি মুরগী কুরবানী করল। আর পঞ্চম সময়ে যে ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করল সে যেন একটি ডিম কুরবানী করল। অতঃপর ইমাম যখন বেরিয়ে এসে মিম্বরে বসে গেলেন খুৎবার জন্য, তখন ফেরেশতারা লেখা বন্ধ করে খুৎবা শুনতে বসে যান (বুখারী, ইফা, আধুনিক)।
যে সকল মুসলমান জুম্মার নামাজ অত্যন্ত আদবের প্রতি লক্ষ্য রেখে আদায় করে, সেই সকল আদায় কারীদের জন্য দুই জুম্মার মধ্যবর্তী সময় গুনাহের কাফফারা স্বরূপ। রাসূল (সা:) ইরশাদ করেন- পাঁচ বেলা সালাত আদায়, এক জুম্মা থেকে পরবর্তী জুম্মা, এক রমজান থেকে পরবর্তী রমজানের মধ্যবর্তী সময়ে হয়ে যাওয়া সকল (সগীরা) গুনাহের কাফফারা স্বরূপ, এই শর্তে, বান্দা কবীরা গুনাহ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবে (মুসলিম)। রাসুল (সা:) ইরশাদ করেন- জুম্মার সালাতে তিন ধরনের লোক হাজির হয়। এক ধরনের লোক আছে যারা মসজিদে প্রবেশের পর খেল-তামাশা করে, তারা বিনিময় তামাশা ছাড়া কিছুই পাবে না। দ্বিতীয় ধরনের লোক আছে যারা জুম্মায় হাজির হয় সেখানে দু’আ মুনাজাত করে, ফলে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে কিছু দেন আর যাকে ইচ্ছা দেন না। তৃতীয় প্রকার হল যারা জুম্মায় হাজির হয়, চুপচাপ থাকে, মনোযোগ দিয়ে খুৎবা শোনে, কাউকে ডিঙ্গিয়ে সামনে আগায় না, কাউকে কষ্ট দেয় না, তারা দুই জুম্মার মধ্যবর্তী ৭ দিন সহ আরও তিনদিন যোগ করে মোট দশ দিনের গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করে দেন (আবু দাউদ)। জুম্মার নামাজ প্রতিটি মুিক্বম (বাড়িতে অবস্থানকারী), স্বাধীন, বালিগ (প্রাপ্ত বয়স্ক) মুসলমানের উপর ওয়াজিব। রাসূল (সা:) নিয়মিত জুম্মার নামাজ আদায় করেছেন এবং তিনি জুম্মার নামাজ পরিত্যাগকারী সম্পর্কে কঠোর উক্তি পেশ করে ইরশাদ করেছেন- যারা জুম্মার নামাজ পরিত্যাগ করে তাদের অবশ্যই ক্ষান্ত হওয়া উচিত, অন্যথায় আল্লাহ নিশ্চয় তাদের অন্তরে মোহর মেরে দেবেন। ফলে তারা গাফেলদের অন্তর্ভুক্ত হবে নিশ্চিতরূপেই (মুসলিম)। রাসূল (সা:) আরও ইরশাদ করেন- যে ব্যক্তি অবহেলা বা ইচ্ছা করে তিন জুম্মার নামাজ পরিত্যাগ করবে আল্লাহ তার অন্তরে মোহর মেরে দেবেন।
সপ্তাহিক ঈদের দিনের পূর্বে এবং পরে কতিপয় আমল- জুম্মার দিন গোসল করা (বুখারী ও মুসলিম)। জুম্মার সালাতে তাড়াতাড়ি উপস্থিত হওয়া (বুখারী ও মুসলিম)। পায়ে হেঁটে মসজিদে গমন করা (তিরমিজি)। মনোযোগ সহকারে জুম্মার খুৎবা শ্রবণ করা (বুখারী ও মুসলিম)। জুম্মার দিন দুয়া কবুল হবার সেই মুহূর্তটির অনুসন্ধান করুন (বুখারী ও মুসলিম)। সূরা কাহাফ তেলাওয়াত করা (আল-হাকিম ও বায়হাকী)।
বেশি বেশি রাসূল (সা:)-এর উপর দুরূদ পাঠ করা (ইবনে মাজাহ ও আবু দাউদ)।
এছাড়াও কিছু করণীয় কাজ হলো- ফজরের আগে গোসল করা। ফজরের ফরজ নামাজে সূরা সিজদা ও সূরা দাহর অথবা ইনসান তেলাওয়াত করা। উত্তম পোষাক পরিধান করা। সুগন্ধি আতর লাগানো। প্রথম ওয়াক্তে মসজিদে যাওয়া। সূরা কাহফ তিলাওয়াত করা। মসজিদে গিয়ে কমপক্ষে দুই রাকা’আত সুন্নত আদায় করা। ইমামের কাছাকাছি গিয়ে বসা। মনযোগ দিয়ে খুৎবাহ শ্রবণ করা। খুৎবাহ চলাকালীন সময়ে কোন ধরনের কথা না বলা; এমনকি কাউকে কথা বলতে দেখলে তাকে কথা বলতে বারণ করাও কথা বলার অন্তভুক্ত। দুই খুৎবাহের মধ্যভর্তি সময়ে দু’আ করা। অন্য সময়ে দু’আ করা। কারণ এদিন দু’আ কবুল হবার দিন। বেশি বেশি রাসূল (সা:)-এর উপর দুরূদ পাঠ করা।
জুম্মার দিনের পাঁচটি বৈশিষ্ট্য- এই দিনে আদম (আ:)-কে সৃষ্টি করা হয়েছিল। এই দিনে আল্লাহ আদম (আ:)-কে পৃথিবীতে প্রেরণ করে দিয়েছেন। এই দিনে আদম (আ:) ইতিকাল করেছেন। এই দিনে এমন একটি সময় রয়েছে, যে সময়ে হারাম ছাড়া যে কোন জিনিস প্রার্থনা করলে আল্লাহ তা প্রদান করেন। এই দিনে কিয়ামত সংঘটিত হবে। তাই আসমান, যমীন ও আল্লাহর সকল নৈকট্যশীল ফেরেশতা জম্মার দিনকে ভয় করে (ইবনে মাজাহ্, মুসনাদে আহমদ)। জুম্মার দিনের ফজিলতের কথা জানার পরেও বিভিন্ন কারণে কাজগুলি করার কথা আমাদের মনে থাকেনা। বহু বরকত ও ফজিলত নিহিত জুম্মার দিনটিতে রাব্বে কারিম আমাদের যথাযথভাবে ইবাদত করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: সহ-মুদ্রণ ব্যবস্থাপক, দৈনিক সিলেটের ডাক।