কাজিরবাজার ডেস্ক :
ঢাকার গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক দুই ভাইয়ের ঢাকার বাড়িতে, তাদের এক কর্মচারী ও এক বন্ধুর বাড়িতে অভিযান চালিয়েছে র্যাব। তিনটি পৃথক অভিযানে তিনটি বাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছে পাঁচ কোটি পাঁচ লাখ নগদ টাকা, ৭৩০ ভরি ওজনের স্বর্ণালঙ্কার ও ছয়টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ১৮ রাউন্ড তাজা বুলেট। টাকাগুলো মতিঝিলের ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে চলা জুয়ার বড় আসর হিসেবে পরিচিত ক্যাসিনো থেকে উপার্জিত। জব্দ হওয়া অবৈধ অস্ত্র দিয়ে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ নানা ধরনের কাজে ভয়ভীতি দেখানো হতো। তিনটি পৃথক অভিযানে কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি র্যাব। যেসব বাড়িতে অভিযান চালানো হয়েছে, সেসব অভিযানের পর মনে হচ্ছিল এ যেন বাড়ি নয়, ব্যাংক। ব্যাংকের মতোই ভল্ট তৈরি করে কোটি কোটি টাকা আর শত শত ভরি ওজনের স্বর্ণালঙ্কার রাখা হয়েছে। টাকা আর স্বর্ণালঙ্কারের সঙ্গে রয়েছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রও। যেন সিনেমার খলনায়কের বাড়ি। বাস্তবের এমন ঘটনা সিনেমার কাহিনীকেও হার মানিয়েছে।
সোমবার মধ্যরাতের পর গে-ারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এনামুল হক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রূপন ভূঁইয়ার বাসা পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের ৩১ বানিয়ানগর বাসায় অভিযান চালায় র্যাব-৩ এর সদস্যরা। মঙ্গলবার সকাল থেকেই পুরো বাড়িতে অভিযান শুরু হয়। ছয়তলা বাড়িটির তৃতীয় ও পঞ্চম তলায় তিনটি ভল্ট পাওয়া যায়। সেগুলো পাকা ইস্পাত দিয়ে তৈরি করা। তা ছিল বড় তালা দিয়ে বন্ধ করা। ভারি এসব ভল্ট অনেক কষ্ট করে নিচে নামান র্যাব সদস্যরা।
এরপর র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে ভল্ট ভাঙ্গা হয়। তিনটি ভল্ট থেকে এক কোটি পাঁচ লাখ নগদ টাকা, ৭৩০ ভরি ওজনের স্বর্ণালঙ্কার উদ্ধার হয়। উদ্ধারকৃত স্বর্ণালঙ্কারের আনুমানিক বাজারমূল্য কমপক্ষে চার কোটি টাকা। এছাড়া বাড়িতে অভিযানকালে পাঁচটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়।
এরপর দুপুরে গে-ারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এনামুল হকের কর্মচারী আবুল কালাম আজাদের নারিন্দার লালমোহন সাহা স্ট্রিটের ৮৩/১ নম্বর বাড়িতে অভিযান চালায় র্যাব। বাড়িটি থেকে একটি ভল্ট উদ্ধার হয়। সেখানে থাকা একটি ভল্ট থেকে এক হাজার টাকার অনেক বান্ডিল পাওয়া যায়। তাতে প্রায় দুই কোটি টাকা পাওয়া যায়। বাড়িটি থেকে একটি বিদেশী রিভলভার ও ১৮ রাউন্ড তাজা বুলেট উদ্ধার হয়।
এরপর নারিন্দার শরৎগুপ্ত রোডের ২২/১ নম্বর তিন তলা একটি বাড়িতে অভিযান চালায় র্যাব। বাড়িটি গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এনামুল হকের বন্ধু হারুন-অর-রশীদের। বাড়িটির দ্বিতীয় তলায় পুরনো কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা অবস্থায় একটি ভল্ট উদ্ধার হয়। ভল্টে ছিল নগদ দুই কোটি টাকা।
হারুনের বাসায় থাকা খাট ও ওয়ারড্রবের মাঝামাঝি জায়গায় একটি সিন্দুক রাখা। যেটি ভল্টের আদলে তৈরি করা। ভল্ট ভাঙ্গার পর দেখা যায় শুধু টাকা আর টাকা। সেগুলো বান্ডিলে বান্ডিলে সাজানো। সেখানে প্রায় দুই কোটি টাকা পাওয়া যায়। অভিযানের বিষয়টি অনুমান করতে পেরে হারুন আগেই পালিয়ে যায়।
স্থানীয়রা জানান, হারুন নারিন্দা মোড়ে থাকা ট্রাকস্ট্যান্ডের কর্মচারী ছিল। হারুনের স্ত্রী দাবি করেন, তারা উদ্ধারকৃত টাকার বিষয়ে কিছুই জানতেন না। কয়েক দিন আগে এনামুল হক সিন্দুকটি তাদের বাসায় রেখে যান।
অভিযান শেষে র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল শাফিউল্লাহ বুলবুল সাংবাদিকদের বলেন, গে-ারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এনামুল হক ও সাধারণ সম্পাদক রূপন ভূঁইয়া ক্যাসিনোর লাভের টাকা বাসায় নিয়ে রাখতেন। টাকা রাখলে বেশি জায়গা লাগে তাই তারা স্বর্ণ কিনে সেগুলো ভল্টে রাখতেন। তাদের বাসা থেকে পাঁচটি অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, কয়েক দিন আগে ইংলিশ রোডে পাঁচটি ভল্ট বানানোর অর্ডার দেন এনামুল হক ও রূপন ভূঁইয়া। ভল্টগুলো তৈরি করে তারা লুকিয়ে বাসায় নিয়ে যান। যার মধ্যে তিনটি ভল্ট তারা তাদের বাসায় রেখেছিলেন। এনামুল হক ওরফে এনু ও রূপন ভূঁইয়া ক্যাসিনোর শেয়ারহোল্ডার। ক্যাসিনোর লাভের টাকা তারা বাসায় নিয়ে রাখতেন। নগদ টাকা রাখলে অনেক জায়গা লাগে। এজন্য তারা টাকা দিয়ে স্বর্ণালঙ্কার কিনে রাখতেন। যাতে জায়গা কম লাগে। এনামুল হক কয়েক দিন আগে থাইল্যান্ডে গেছেন। আর অভিযান শুরুর পর থেকেই রূপন পলাতক। উদ্ধারকৃত অস্ত্র গোলাবারুদ চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও ক্যাসিনো চালানোর সময় ঝামেলা হলে, যারা ঝামেলা করত তাদের ভয়ভীতি দেখানোর জন্য ব্যবহৃত হতো।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, এনামুল ও রূপনরা ছয় ভাই। ১৯৮৫ সাল থেকেই এনামুল ওয়ান্ডারার্স ক্লাব ও রূপন আরামবাগ ক্লাবে জুয়া খেলত। প্রায় চার বছর আগে হঠাৎ করেই তারা ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি কেনা শুরু করে। যে বাড়িটি থেকে র্যাব এক কোটি নগদ টাকা ও ৭৩০ ভরি ওজনের স্বর্ণালঙ্কার উদ্ধার করেছে, সেটি দেড় বছর আগে হারুন-অর-রশীদ নামের একজনের কাছ থেকে কিনেছে।
স্থানীয়রা জানান, ওয়ারী, সূত্রাপুর, গেন্ডারিয়া, বংশাল, কোতোয়ালি থানা এলাকায় এই পরিবারের কমপক্ষে ৫০টি বাড়ি আছে। তবে তারা দুই ভাই কোন বাড়িতে থাকে, তা কেউ জানে না।
থানা আওয়ামী লীগের দুই নেতার গ্রেফতারের বিষয়ে ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ সাংবাদিকদের বলেন, এনামুল হক ও রূপন ভূঁইয়া গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের দুই নেতা। গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত জাহান জানান, এনামুল হক থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আর রূপন ভূইয়া যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ প্রমাণিত হলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।