কাজিরবাজার ডেস্ক :
সাজা ও জরিমানা বৃদ্ধির বিধান থাকায় সড়ক পরিবহন আইন- ২০১৮ বাস্তবায়নে মালিক-শ্রমিকরা বাধা দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছে একটি বেসরকারী সংগঠন। তাছাড়া সড়ক পরিবহন ঘিরে গড়ে ওঠা চাঁদাবাজ চক্র এই ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আনতে বাধা হিসেবে কাজ করছে বলে মনে করে সংগঠনটি। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, গত বছর নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সড়কে শৃঙ্খলা আনতে প্রধানমন্ত্রী যে নির্দেশনাগুলো দিয়েছিলেন, তাও আলোর মুখ দেখেনি এই চক্রের কারণে।
শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ বাস্তবায়নে বিলম্ব : জনমনে হতাশা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন করে সংগঠনটি। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান।
লিখিত বক্তব্যে সাইদুর বলেন, দীর্ঘকাল ধরে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা চাঁদাবাজ-সিন্ডিকেট গণপরিবহনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় প্রধান বাধা। ২০১৮ সালে প্রণীত সড়ক পরিবহন আইনে জামিন অযোগ্য ধারা, সাজা ও জরিমানা বৃদ্ধির বিধান থাকায় পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা তা বাস্তবায়নে বাধা দিচ্ছেন। সড়ক পরিবহনমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের আপত্তির কারণে সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। মালিক-শ্রমিকরা কি সরকারের চেয়ে শক্তিশালী? রাষ্ট্রের চেয়ে বড়? তাহলে সরকার তাদের কেন আস্কারা দিচ্ছে?
তিনি বলেন, পরিবহন খাতে চাঁদাবাজির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা আবার পুলিশের বিরুদ্ধেও চাঁদাবাজির অভিযোগ করে আসছে।
সংবাদ সম্মেলনে বাসদ নেতা রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, আইন ও ফাইন দিয়ে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো যাবে না। এজন্য চালকদের অধিকার ও দাবিগুলোর প্রতিও নজর দিতে হবে। তাদের জন্য কোন কর্মঘণ্টা নেই, বিশ্রামের ব্যবস্থা নেই। তাদের অনেক না পাওয়ার হতাশা আছে, প্রতিদিনের গ্লানি আছে। আমরা সড়ক পরিবহন আইন করতে গিয়ে তাদের যেন প্রতিপক্ষ মনে না করি।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান, রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবদুল হামিদ শরীফ, মোহাম্মদ শাহজাহান সিদ্দিকী, অধ্যাপক হাসিনা বেগম উপস্থিত ছিলেন।
নতুন সড়ক পরিবহন আইনে বেশ কিছু অসঙ্গতি আছে বলে মনে করেন মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, এ আইনে আদালতের জুরিসডিকশনকে অস্বীকার করা হয়েছে। দুর্ঘটনায় নিহত বা আহত হওয়া ব্যক্তি ক্ষতিপূরণের জন্য আদালতে যেন যেতে না পারে, তা এই আইনে নিশ্চিত করা হয়েছে। এ আইনে ক্ষতিপূরণের জন্য একটি আর্থিক সহায়তা তহবিল গঠনের কথা বলা হয়েছে। আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ যেন দুর্ঘটনায় পতিত ব্যক্তির অধিকার নয়, সরকারের দয়া দাক্ষিণ্যের বিষয়। জনগণের কল্যাণে কাজ করা সরকারের সাংবিধানিক ও নৈতিক দায়িত্ব। এই দায়িত্ববোধ থেকেই সরকারকে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ বাস্তবায়ন করে নিরাপদ জনবান্ধব সড়ক ও গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
সাইদুর রহমান বলেন, সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ অনুযায়ী, অবহেলা বা বেপরোয়া মোটরযান চালানোর কারণে প্রাণহানি হলে চালকের বিরুদ্ধে দ-বিধির ৩০৪ ধারায় মামলা ও তার অপরাধ জামিন অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে এবং বিচারে ৫ বছরের কারাদ- বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দন্ডে দন্ডিত করা হবে। উদ্দেশ্যমূলক বা ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে প্রাণহানি করলে তদন্ত ও প্রমাণ সাপেক্ষে দন্ডবিধির ৩০২ ধারা অনুযায়ী চালকের মৃত্যুদন্ডেরও বিধান রাখা হয়েছে। মূলত এই আইনে জামিন অযোগ্য ধারা, সাজা ও জরিমানা বাড়ানোর বিধান থাকায় পরিবহন মালিক শ্রমিকরা আইনটি বাস্তবায়নে বাধা দিচ্ছেন।
সাইদুর রহমান আরও বলেন, পৃথিবীর সব দেশে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তরা ক্ষতিপূরণ পান। বাংলাদেশে মোটরযান অর্ডিন্যান্স এ্যাক্ট ১৯৮৩-তে থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্সের মাধ্যমে এই সুবিধাপ্রাপ্তির বিধান ছিল। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত কেউ কোনদিন ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন এমনটি শোনা যায়নি। অর্থাৎ ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কোন ব্যবস্থাই করা হয়নি।
এই আইনে দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য একটা ট্রাস্ট ফান্ড গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। এই ফান্ড গঠন ও পরিচালনায় যে প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে, তা গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজিকে উৎসাহিত করবে বলে আমরা আশঙ্কা করছি। আমরা আইনে থার্ড পার্টির ক্ষতিপূরণ বীমা বাধ্যতামূলক করে ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি।
বক্তারা বলেন, সব জেলায় আমাদের এই মেসেজটি পৌঁছানো খুবই জরুরী যে, যারা দুর্ঘটনার শিকার হবেন তারা যেন অন্তত জেলা আদালতে গিয়ে মামলা করেন। ভারতে সড়ক দুর্ঘটনা আইনে নিহতের পরিবারকে ২৫ হাজার রুপী ও গুরুতর আহতদের সাড়ে ১২ হাজার রুপী ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিধান আছে। আমাদের দেশে অন্তত এতটুকু বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।