স্বস্তিতে নেই মন্ত্রী-এমপি সহ জেলার নেতারা ॥ সরকারের কঠোর অবস্থানে আতংকিত আওয়ামী লীগে অনৈতিক কাজে জড়িত নেতারা

136

কাজিরবাজার ডেস্ক :
কঠোর এ্যাকশনের মাধ্যমে শুদ্ধি অভিযানে নেমেছে আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর ও অনমনীয় অবস্থানে শুধু রাজধানীকেন্দ্রিক নয়, সারাদেশেই অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত তৃণমূল নেতাদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। স্বস্তিতে নেই কেন্দ্রীয় নেতা, মন্ত্রী এমপি থেকে জেলা পর্যায়ের নেতারাও। মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও অবৈধ কর্মকান্ডে মদদ দেয়া বড় বড় নেতারাও চলমান অভিযান থেকে রেহাই পাবেন এমন নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না কেউ। এরপর কোথায় কোন নেতা বা সংগঠন অভিযানের লক্ষ্যবস্তু হবে- সর্বত্রই এমন আতঙ্কে রয়েছেন দলের বিতর্কিত ও অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত নেতারা। দলের মধ্যে এ শুদ্ধি অভিযান কতদূর বিস্তৃতি হবে- তা নানাভাবে জানার চেষ্টা করছেন অনেকেই। তবে দুর্নীতি অনিয়ম, বিশৃঙ্খলার সঙ্গে যারা জড়িত, যাদের আচরণে পার্টি ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে, ঠিক তাদের বিরুদ্ধেই ‘কেস টু কেস’ খোঁজখবর নিয়ে কঠোর এ্যাকশন নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলের হাইকমান্ড।
দলের মধ্যকার সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে চলমান শুদ্ধি অভিযান অব্যাহত রাখতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে অনড় ও অনমনীয় অবস্থান নিয়েছেন। যেকোনো মূল্যে তিনি বিতর্কিত নেতাকর্মীদের লাগাম টেনে ধরতে চান। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের অভিযান অব্যাহত রাখার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশ দিয়ে গেছেন বলে দলটির একাধিক সূত্রে জানা গেছে। দুর্নীতিবাজ কাউকে না ছাড়ার প্রধানমন্ত্রীর কঠোর হুঁশিয়ারির পর নড়ে চড়ে বসেছে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনও।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাইকমান্ডের কঠোর অবস্থানে দলের সব পর্যায়ের বিতর্কিত নেতাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু রাজধানীই নয়, তৃণমূল পর্যায়েও যারা ক্ষমতায় থাকার সুযোগ নিয়ে অনৈতিক কর্মকা-ে জড়িয়েছে, ক্ষমতা ব্যবহার করে বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছেন- তাদেরও চলমান অভিযানের আওতায় আনার পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। এ অভিযানের কতদিন বা কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃতি ঘটবে, ঢাকার বাইরেও অভিযান চলবে কি না, তা কাছের বড় নেতা-মন্ত্রীদের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করছেন অনেকেই। আতঙ্কে ঢাকাসহ জেলা-মহানগরীর অনেক গডফাদারও চলে গেছেন নিরাপদ অবস্থানে।
সবশেষে আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনৈতিক ও দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণœকারীদের বিরুদ্ধে তার কঠোর অবস্থান এবং শক্তহাতে দমনের আভাস দেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে বৃহস্পতিবার রাতে সাক্ষাত করেন ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারা। সেখানেও প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে তার অনমনীয় ও কঠোর অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় বলেন, কোন নালিশ শুনতে চাই না। ছাত্রলীগের পর যুবলীগকে ধরেছি। একে একে সবাইকে সংশোধন করা হবে। সমাজের অসঙ্গতি দূর করতে হবে। একে একে এসব ধরতে হবে এবং আমি করব। জানি কঠিন কাজ; কিন্তু করব। জানি বাধা আসবে; কিন্তু আমি করবই। সংগঠনকে ব্যবহার করে কেউ অপরাধ করলে তাকে ছাড় দেয়া হবে না।
প্রধানমন্ত্রীর এমন কঠোর অবস্থানের পরেই এ্যাকশনে নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। একযোগে জুয়ার আসন বলে পরিচিত ক্যাসিনো এবং বিভিন্ন স্পোর্টস ক্লাবে অভিযান চালাতে থাকে র‌্যাব ও পুলিশ। যুবলীগ দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেফতারের পর অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ-মাদকসহ গ্রেফতার করা হয় আগে যুবদলের ক্যাডার পরে যুবলীগে যোগ দেয়া চিহ্নিত টেন্ডারবাজ জি কে শামীমকে। এরপরই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে আওয়ামী লীগের নাম ভাঙ্গিয়ে অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত হয়ে অর্থ-বিত্তের মালিক হওয়া নেতা ও তাদের গডফাদারদের।
সরকারের এ কঠোর অবস্থানের পর চিহ্নিত তোলাবাজ ও তাদের গডফাদাররা নাখোশ হলেও আওয়ামী লীগের আদর্শিক ও ত্যাগী নেতারা এ ব্যাপারে ভীষণ খুশি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ ক’জন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দলের নাম ভাঙ্গিয়ে চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িত গুটিকয়েক নেতার কারণে পুরো আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি এখন প্রশ্নের মুখোমুখি। শুধু দলের ত্যাগী নেতারাই নন, সারাদেশের মানুষও চলমান শুদ্ধি অভিযানে সরকারের ওপর খুশি। এতে সরকারের ইমেজও বাড়ছে। তাদের মতে, এই শুদ্ধি অভিযান এখনই বন্ধ করে দিলে জনগণের কাছে ভিন্ন বার্তা যাবে, যা আওয়ামী লীগ ও সরকারের জন্য ইতিবাচক হবে না। হাতেগোনা কিছু দলীয় গডফাদারদের শক্তহাতে দমন করলে আওয়ামী লীগের ন্যূনতম ক্ষতি তো হবেই না, বরং সবক্ষেত্রে দলের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল ও শক্তিশালী হবে।
তবে চলমান আওয়ামী লীগের এই এ্যাকশন কর্মসূচী শুধু রাজধানীতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, এটি স্পষ্ট করে দিয়েছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ছাত্রলীগ-যুবলীগই শুধু নয়, আওয়ামী লীগের যারা অপকর্মে জড়িত তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে। আওয়ামী লীগেও এসব অপকর্ম যদি কেউ করে সেটারও খোঁজখবর তিনি (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) নিচ্ছেন। দুর্নীতি, অপকর্ম, শৃঙ্খলাভঙ্গ-এসবের জন্য কিন্তু অনেকেই নজরদারিতে আছেন এবং সময়মতো ব্যবস্থা নেয়া হবে। যত বড় রাঘববোয়াল, গডফাদারই হোন না কেন, কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না। আমাদের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্যায়, অনিয়ম, দুর্নীতি ও অপকর্মের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি নিয়েই অগ্রসর হচ্ছেন।
শুধু ঢাকার নেতাদের বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থা কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের আরও জানান, শুধু রাজধানীকেন্দ্রিক এটা ঠিক নয়, সারাদেশে যেখানেই অপকর্ম, দুর্নীতি, অনিয়ম হবে, শৃঙ্খলাভঙ্গ হবে- সর্বত্রই একই নিয়মে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা কার্যকর হবে। এখানে দুর্নীতি, অনিয়ম, বিশৃঙ্খলার সঙ্গে যারা জড়িত, যাদের আচরণে পার্টি এবং সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, ঠিক তাদের বিরুদ্ধেই ‘কেস টু কেস’ খোঁজখবর নিয়ে এ্যাকশন নেয়া হচ্ছে এবং হবে।
ক্লিন ইমেজের মানুষ বলে পরিচিত বেশ কয়েক কেন্দ্রীয় নেতাও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, গুটিকয়েক মানুষের জন্য গোটা পার্টি তো বদনামের ভাগিদার হবে না। এসব অপকর্ম করছে গুটিকয়েক লোক। তারা ছাত্রলীগ-যুবলীগ কিংবা আওয়ামী লীগের হোক, গুটিকয়েক এসব লোক নানা অপকর্ম করে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে, সরকারের বিশাল অর্জনকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করছে। জনগণের কাছেও দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। অনেকেই নীরবে হয়তো অনেক কিছু হজম করছে। কিন্তু এই এ্যাকশনটা হওয়ার পর সারাদেশে সাধারণ মানুষ খুব খুশি। যারা এমন কর্মকান্ড করবে, সতর্ক হবে না, প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। আর এ এ্যাকশন অভিযান সারাদেশে চালাতে হবে। এতে সরকারের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের ইমেজও অনেক বাড়বে। এসব নেতাদের শক্তহাতে দমন ও ছেঁটে ফেললে দলের কোন ক্ষতি হবে না, বরং উপকারই হবে।
দলের মাঠ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলে অনুপ্রবেশকারীর মাশুল গুনতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে। একসময় যারা ফ্রিডম পার্টি, বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তারাই ২০০৯ সালের পর নানা কৌশলে ভোলপাল্টিয়ে ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণে আওয়ামী লীগে যোগদান শুরু করেন। কেউ কেউ আওয়ামী লীগের অনেক বড় নেতা, মন্ত্রী-এমপিদের হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে নিজেদের নামের পাশে ‘লীগ’ শব্দটি জুড়ে নিয়ে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। আবার অনেকে সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পদ-পদবিও বাগিয়ে নেন। দলে অনুপ্রবেশকারী এসব চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী, ঠিকাদার সবাই এখন ‘লীগপন্থী’। আর এসব অনুপ্রবেশকারীর মাশুল দিতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলমান অভিযানে বিপুল পরিমাণ অর্থ, অস্ত্র ও মাদকসহ গ্রেফতার হওয়া দুই কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা কেউ-ই আগে আওয়ামী লীগের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না। যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়া ও যুবলীগের কথিত সমবায় বিষয়ক সম্পাদক জি কে শামীম দু’জনই অনুপ্রবেশকারী। ফ্রিডম পার্টির হাত ধরে উত্থান যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদের। তিনি বিএনপি আমলে ছিলেন মির্জা আব্বাসের অন্যতম সহযোগী। একই অবস্থা বিপুল অর্থসহ গ্রেফতার হওয়া জি কে শামীমের ক্ষেত্রেও। বিএনপি আমলে গণপূর্ত ভবনের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত তৎকালীন যুবদল নেতা শামীম। তিনি সে সময় যুবদলের সহ-সম্পাদকও ছিলেন। পরে যুবলীগে অনুপ্রবেশ করে নিজেকে সমবায় সম্পাদক পরিচয় দিয়ে আগের মতোই অবাধে চালিয়ে যান ঠিকাদারিসহ সব ধরনের অপকর্ম। ফলে এসব অনুপ্রবেশকারী বিতর্কিত এসব নেতার সব অপকর্মের দায় পড়ছে আওয়ামী লীগের ঘাড়ে।
জানা গেছে, আর কোন ছাড় নয়, ঢাকাসহ সারাদেশেই এবার বড় ধরনের শুদ্ধি অভিযান চালাবে আওয়ামী লীগ। সংগঠনকে ব্যবহার করে অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত কাউকেই এবার ছাড় দিতে নারাজ দলের হাইকমান্ড। ঢাকায় শুদ্ধি অভিযানের সঙ্গে সঙ্গে দেশের সব জেলা মহানগরেও দল ব্যবহার করে অনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে বিত্ত-ভৈববের মালিক হওয়া সব নেতা ও তাদের গডফাদারকে আনা হবে আইনের আওতায়। আর এসব বিতর্কিত নেতার পক্ষে সাফাই কিংবা পক্ষে দাঁড়ানো যত বড় নেতাই হোন না কেন, তাদেরও কোন ছাড় দেয়া হবে না। আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের এমন শক্ত ও অনমনীয় অভিযান ঠিক কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়, তা দেখার জন্যই এখন অধীর অপেক্ষায় দলের সারাদেশের ত্যাগী ও আদর্শিক নেতারা।