সিলেট বিভাগের ৩২ নেতা সহ আওয়ামী লীগের দুই শতাধিক নেতার সামনে ঝুলছে বহিষ্কারের খড়গ ॥ আজ থেকে শোকজ নোটিশ পাঠানো হবে

18

কাজিরবাজার ডেস্ক :
শুধু হুমকি বা কথার কথা নয়, এবার বাস্তবে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর এ্যাকশনে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। আগামী জাতীয় সম্মেলন সামনে রেখে এ শুদ্ধি অভিযান শুরু করছে দলটি। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে সারাদেশের দুই শতাধিক নেতার সামনে ঝুলছে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কারের খড়গ। শুধু বিদ্রোহী প্রার্থীই নয়, তাদের সহযোগী ও মদদদাতা এমপি-মন্ত্রী ও দু’একজন কেন্দ্রীয় নেতার কপালও পুড়তে পারে এবার। আজ রবিবার থেকেই দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী চিহ্নিত এসব প্রার্থী-নেতাদের বিরুদ্ধে কেন্দ্র থেকে পাঠানো হচ্ছে দল থেকে বহিষ্কারের শোকজ নোটিস।
দলে শুদ্ধি অভিযানের পাশাপাশি এ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে একগুচ্ছ সাংগঠনিক কর্মসূচী নিয়ে মাঠে নামছেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা। ভয়াবহ বন্যা, ডেঙ্গু এবং শোকের মাস আগস্টের কারণে প্রায় তিন মাস ধরে স্থবির থাকা সাংগঠনিক কার্যক্রম বেগবান এবং দলের কেন্দ্রীয় ত্রি-বার্ষিক জাতীয় সম্মেলন করতে প্রয়োজনীয় সকল প্রস্তুতির কাজও শুরু করবে দলটি। আগামী ১৪ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। আর ওই বৈঠকেই দেশব্যাপী সাংগঠনিক সফরসহ আগামী জাতীয় কাউন্সিল এবং দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বহিষ্কারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে। সংগঠনকে চাঙ্গা করে তুলতে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দেবেন বৈঠকের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ ব্যাপারে শনিবার ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সভা শেষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দলটির সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ও মদদদাতা দেড় শতাধিক ব্যক্তিকে শোকজ করা হচ্ছে। উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে যারা বিদ্রোহী ছিল, তাদের শোকজ করার সিদ্ধান্ত আগে থেকেই ছিল। শনিবার দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত কিভাবে বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করা যায়, সেটা আলোচনা করেছি। আজ রবিবার থেকে দলীয় সিদ্ধান্ত ভঙ্গকারীদের ১৫০ জনের বিরুদ্ধে শোকজ নোটিশ ইস্যু করা হবে।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরও জানান, শোকজের জবাবের জন্য তিন সপ্তাহ সময় দেয়া হবে। এছাড়া উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের মদদদাতা এমপি-মন্ত্রীরাও শোকজ নোটিশ পাবেন। মদদদাতাদের মধ্যে কেন্দ্রীয় নেতাও থাকতে পারেন। যাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও মদদ দেয়ার অভিযোগ আছে, তারা সবাই শোকজ নোটিশ পাবেন।
সাংগঠনিক এ্যাকশন ও শুদ্ধি অভিযানের প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে দেড় শ’ জনের বিরুদ্ধে শোকজ নোটিশ পাঠানোর প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হলেও তা বেড়ে দুই শতাধিক হতে পারে। এর মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী (বিদ্রোহী) হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হওয়া ১৪০ উপজেলা চেয়ারম্যানের নামও রয়েছে। জানা গেছে, এই ২০০ নেতাকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কারের পাশাপাশি কেন তাদের দল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হবে না, এই মর্মে আগামী তিন মাসের মধ্যে কারণ দর্শানোর জন্যও বলা হবে। আজ রবিবার থেকে ডাকযোগে শোকজ নোটিশ পাঠানো শুরু হচ্ছে।
সূত্রগুলো জানায়, শোকজ নোটিশের জবাব পাওয়ার পর আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড তা যাচাই-বাছাই করে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী ও দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্যকারীদের চূড়ান্তভাবে দল থেকে বহিষ্কারের জন্য একটি তালিকা প্রস্তুত করে তা দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের পরবর্তী করবে। বৈঠকে উপস্থাপন করবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠেয় ওই বৈঠকে আলোচনা শেষে চূড়ান্ত বহিষ্কার হওয়া বিদ্রোহী প্রার্থী ও তাদের মদদদাতাদের তালিকা গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হবে।
এর আগে গত ১২ জুলাই সন্ধ্যায় গণভবনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত দলটির উপদেষ্টা পরিষদ ও কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় ওইসব নেতাকে সাময়িক বহিষ্কার ও শোকজের সিদ্ধান্ত হয়। জানা গেছে, বহিষ্কৃতদের কয়েক ধাপে চিঠি দেয়া হবে। নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর বিপক্ষে কাজ করা অর্ধশতাধিক মন্ত্রী-এমপি-জেলার নেতাদের ভাগ্যে জুটতে পারে এই শোকজ নোটিশ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাঁচ ধাপে অনুষ্ঠিত ৪৭৩টি উপজেলার নির্বাচনে ১৪৯টিতে চেয়ারম্যান পদে জিতেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ১৪০ জনই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে তাকে দলের বিদ্রোহী হিসেবে ধরে নেয় আওয়ামী লীগ। দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কাউকে দল থেকে চূড়ান্ত বহিষ্কারের আগে শোকজ নোটিশ জারি করে দোষী নেতাদের কাছ থেকে জবাব চাওয়া হয়। জবাব সন্তোষজনক না হলে তাদের দল থেকে চূড়ান্ত বহিষ্কারের বিধান রয়েছে। আর দল থেকে চূড়ান্ত বহিষ্কারের একমাত্র এখতিয়ার দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের।
সূত্র জানায়, দল থেকে সাময়িক বহিষ্কারের জন্য যাদের কেন্দ্র থেকে শোকজের নোটিস জারি করা হচ্ছে তাদের মধ্যে খুলনা বিভাগে ৪১ জন, রাজশাহী বিভাগে ২০ জন, সিলেট বিভাগে ৩২ জন, রংপুর বিভাগে ২৫ জন, বরিশাল বিভাগে ১৭ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ২০ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৭ জন এবং ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ ৪৫ জন রয়েছে। প্রায় দুই মাস নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, তৃণমূল থেকে আসা লিখিত অভিযোগ এবং তদন্ত করে এসব বিদ্রোহী ও তাদের মদদদাতাদের চিহ্নিত করেছেন আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।
ওবায়দুল কাদেরের সভাপতিত্বে শনিবারের বৈঠকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আবদুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, বিএম মোজাম্মেল হক, একেএম এনামুল হক শামীম, ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এবং উপ দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া উপস্থিত ছিলেন। এ বৈঠকে প্রাথমিকভাবে শোকজ নোটিশ জারি করার জন্য নেতাদের তালিকা চূড়ান্ত করা হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, বিদ্রোহী প্রার্থীদের শোকজের জবাবের মধ্য থেকেই তাদের মদদদাতাদের চিহ্নিত করতে চায় আওয়ামী লীগ। শোকজের জবাবের মধ্যেই জানতে চাওয়া হবে কোন কোন কেন্দ্রীয় নেতা, মন্ত্রী-এমপি কিংবা জেলার নেতারা তাদের উৎসাহিত করেছে বিদ্রোহী প্রার্থী হতে। কারা কারা তাদের মদদ কিংবা সমর্থন দিয়েছে। এসব বিষয় শোকজ পাওয়া বিদ্রোহী প্রার্থীদের জবাবের মধ্য থেকেই সংগ্রহ করে পুনরায় তা যাচাই-বাছাই করে মদদদাতাদের বিরুদ্ধেও সাংগঠনিক কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পথে যাবে আওয়ামী লীগ।
প্রথমে দেশের বিভিন্নস্থানে বন্যা, পরবর্তীতে দেশজুড়ে ভয়াবহ ডেঙ্গুর প্রভাব এবং সবশেষ শোকের মাস আগস্টের মাসব্যাপী কর্মসূচী থাকায় প্রায় তিন মাস সব ধরনের সাংগঠনিক কার্যক্রম বন্ধ ছিল আওয়ামী লীগের। এ কারণে সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ থেকেই পুরনো কর্মসূচী নিয়ে নতুন করে মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি। এ কর্মসূচীগুলোর মধ্যে রয়েছে- তৃণমূলকে ঢেলে সাজাতে উপজেলা সম্মেলন, অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন, দলের শৃঙ্খলাভঙ্গকারী ও অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সদস্য সংগ্রহ অভিযান জোরদারকরণ।
দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী ১৪ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে সাংগঠনিক বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের পর পরই সারাদেশে সাংগঠনিক সফরে নামবেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা। যেখানে সাংগঠনিক অচলাবস্থা, কোন্দল, দ্বন্দ্ব কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি রয়েছে, সাংগঠনিক সফরে গিয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা তা দ্রুত নিরসন করে দলকে চাঙ্গা ও শক্তিশালী করে গড়ে তুলবেন। এছাড়া কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকেই দলের জাতীয় সম্মেলনের দিনক্ষণ নির্ধারণের বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত আসত পারে বলে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানায়, গত ১৯ এপ্রিল আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ ও কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের যৌথ সভায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে বেশকিছু কড়া নির্দেশনা দিয়েছেন। ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তৃণমূলে অনেক কোন্দল ও গ্রুপিং আছে। যে কারণে উপজেলা নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী হেরে গেছে অনেক জায়গায়। অতীতে আওয়ামী লীগ যখনই বিপদে পড়েছে এ তৃণমূলই কিন্তু দলকে রক্ষা করেছে। সেই কারণে যত দ্বন্দ্ব, সংঘাত বা গ্রুপিং থাকুক না কেন সবকিছু মিটিয়ে ফেলে আওয়ামী লীগকে তৃণমূল পর্যায়ে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। আওয়ামী লীগের আসন্ন জাতীয় সম্মেলন, মুজিব বর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের আগেই তৃণমূল আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন শেখ হাসিনা। তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ীই সাংগঠনিক সফর শুরু হচ্ছে।