জিএম কাদের-রওশন বিরোধ তুঙ্গে, ভাঙ্গনের মুখে জাতীয় পার্টি

80

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বড় ধরনের ভাঙ্গনের সম্মুখীন সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। দলের মধ্যে এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদ এবং ভাই জিএম কাদেরের বিরোধ এখন তুঙ্গে। নেতাকর্মীরাও দুই শিবিরে ভাগ হয়ে পড়েছেন। রংপুর তিন আসনের উপনির্বাচন এবং জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা হওয়া নিয়ে রওশন এরশাদ ও চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসা জিএম কাদেরের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। ইতোমধ্যে পার্টির একাংশ বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে রওশন এরশাদকে দলের চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পরে জিএম কাদের পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে নিজেকে দলের বৈধ চেয়ারম্যান হিসেবে দাবি করেছেন। একই সঙ্গে চেয়ারম্যান ঘোষণা করা রওশন এরশাদকেও দলের গণতন্ত্র অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
জানা গেছে, দলের মধ্যে আগ থেকেই রওশন এরশাদ এবং জিএম কাদেরে মধ্যে বিরোধ চলে এলেও এটি চরম আকার ধারণ করে গত মঙ্গলবার। ওইদিন জিএম কাদের জাতীয় পার্টির প্যাডে স্পীকার শিরিন শারমিনকে সংসদের বিরোধী দলের নেতা করার জন্য চিঠি দেন। এতেই রওশনপন্থীরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। বুধবার রওশন এরশাদ স্পীকারের কাছে পাল্টা চিটি দিয়ে জিএম কাদেরকে বিরোধী দলের নেতা না বানাতে আহ্বান জানান। তিনি চিঠিতে উল্লেখ করেন, দলীয় ফোরামে কোন সিদ্ধান্ত ছাড়াই জিএম কাদের নিজেকে বিরোধীদলীয় নেতা করতে বলেছেন। এর একদিন পরেই একাংশ রওশন এরশাদকে দলের চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা করে।
জানা গেছে, রংপুর তিন আসনের উপনির্বাচন নিয়ে দু’জনের মধ্যে এই বিরোধের সূত্রপাত। গত ১৪ জুলাই সাবেক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর ইতোমধ্যে তার আসন শূন্য ঘোষণা করে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। আগামী ৫ অক্টোবর এই আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই আসনের উপনির্বাচনে প্রার্থী বাছাই নিয়ে রওশন এরশাদ এবং জিএম কাদের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। রওশন এরশাদ এই নির্বাচনে তার কর্তৃত্ব বজায় রাখতে নিজের প্রার্থী এরশাদের ছেলে শাদ এরশাদকে দল থেকে মনোনয়ন দেয়ার চেষ্টা চালান। অপরদিকে জিএম কাদের চেয়েছেন স্থানীয় কোন নেতার মধ্য থেকে কাউকে দলের মনোনয়ন দিতে চান। এই চেষ্টায় তিনি ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত রওশনের প্রার্থী শাদ এরশাদকে এই আসনে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে।
উপনির্বাচনে নিজের প্রভাব ক্ষুন্ন হওয়ায় জিএম কাদের জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা হওয়ার জন্য স্পীকারকে চিঠি দেন। রওশনপন্থীরা এই চিঠি দেয়াকে ভালোভাবে গ্রহণ করেননি। ফলে বিরোধ চরমে ওঠে। শেষ পর্যন্ত বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে দলের একাংশ রওশন এরশাদকে দলের চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা করেন। দেবর-ভাবির এই দ্বন্দ্ব এখন দলের ওপর এসে পড়ছে। আগে একাধিকবার জাতীয় পার্টি ভাঙ্গলেও এরশাদের মৃত্যুর পর আবারও বড় ধরনের ভাঙ্গনের সম্মুখীন হয়েছে দলটি।
এদিকে রংপুর তিন আসনের নির্বাচনে সব দল অংশ নিতে প্রার্থী বাছাই করছে। জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে এরশাদের ছেলে শাদ এরশাদের নাম ঘোষণা করার পর থেকে স্থানীয় নেতাকর্মীরা রওশনপন্থী এবং জিএম কাদেরপন্থী হিসেবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। শাদ এরশাদের নাম ঘোষণার পর থেকেই রংপুরে কাদেরপন্থীরা শাদ এরশাদকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন। তারা দাবি করেছেন, শাদ এলাকায় রাজনীতিতে কোনদিন সক্রিয় ছিলেন না। তাকে এলাকার কেউ চেনে না। তাকে দল থেকে মনোনয়ন দেয়ার পর তার মনোনয়নের বিরুদ্ধে এলাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করাও হয়েছে। প্রার্থী পরিবর্তন করে স্থানীয় জনপ্রিয় কাউকে এই আসনে মনোনয়ন দেয়ার দাবিও জানিয়েছেন তারা।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদের মৃত্যুর পর জিএম কাদের দলের চেয়ারম্যান হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দেয়ার পর থেকেই দলের মধ্যে অসন্তোষ চলে আসছে। যদিও জিএম কাদের উল্লেখ করেছিলেন দলের সবার সম্মতি নিয়ে তিনি চেয়ারম্যান ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু প্রথম থেকে বেগম রওশনপন্থীরা জিএম কাদেরকে চেয়ারম্যান হিসেবে মেনে নিতে পারেনি।
বৃহস্পতিবার বেলা ১২টায় সংবাদ সম্মেলন করে দলের একাংশ রওশন এরশাদকে তাদের দলের চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা করার কয়েক ঘণ্টা পরই আরেক অংশ জিএম কাদেরকে তাদের বৈধ চেয়ারম্যান হিসেবে দাবি করেছেন। এই ঘোষণার পরই দলটি আবারও ভাঙ্গনের মুখে পড়েছে। বেলা ১২টায় গুলশানে রওশনের বাস ভবনে এক সংবাদ সম্মেলন করে দলের একাংশের নেতারা রওশন এরশাদকে চেয়ারম্যান ঘোষণার পাশাপাশি জিএম কাদেরকে দলের কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। সংবাদ সম্মেলনে রওশন এরশাদ পার্টির ঐক্য ধরে রাখতে নেতাকর্মীদের আহ্বান জানিয়ে বলেন, এরশাদ তিল তিল করে জাতীয় পার্টিকে গড়ে তুলেছেন। এখন আমরা এই ঐক্য ধরে রাখব। আসুন পার্টির ঐক্য অটুট রাখি। পুরনো যারা পার্টি থেকে চলে গেছেন তাদের বলব ফিরে আসুন। মান-অভিমান নিয়ে থাকবেন না। আসুন এক সঙ্গে দলকে গড়ে তুলি।
এই সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডিয়াম সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী রওশন এরশাকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হয়েছে। ‘গঠনতন্ত্রে বলা আছে, যদি চেয়ারম্যানের মৃত্যু হয়, তাহলে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান-১ চেয়ারম্যান হবেন। এখানে রওশন এরশাদ সিনিয়র। এটা ২০এর উপধারা ২(ক)এ আছে। সুতরাং সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করছি, রওশন এরশাদ দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন। আগামী ছয় মাসের মধ্যে কাউন্সিল করে নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হবে। তিনি জানান, দলের মহাসচিব মসিউর রহমানই থাকবেন। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, দল ভাঙ্গেনি। পার্লামেন্টারি বোর্ডে সিদ্ধান্ত হবে দলীয় উপনেতার বিষয়ে। জি এম কাদের এ সিদ্ধান্ত মেনে নেবেন কিনা, প্রশ্নের জবাবে তিনি আশা করে বলেন, মেনে নেবেন এবং দল ভাঙ্গবে না।
জীবিত থাকতে এইচএম এরশাদ জিএম কাদেরকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করে যাওয়ার বিষয়ে বলেন, ওই সময়ে এরশাদকে ঘুম থেকে তুলে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। তিনি তখনকার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং বলেন, জি এম কাদেরকে একবার অযোগ্যতার জন্য পদ থেকে সরিয়েও দেয়া হয়। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন মুজিবুল হক চুন্নু, সোহেল রানা, ফখরুল ইসলাম, আবদুস সবুর প্রমুখ।
এদিকে রওশন এরশাদের সংবাদ সম্মেলনের পরই পাল্টা সংবাদ সম্মেলনে জিএম কাদের নিজেকে দলের বৈধ চেয়ারম্যান হিসেবে দাবি করেছেন। তিনি বলেন, দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মাদ এরশাদ তাকে এই দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। সেই হিসেবে তিনিই পার্টির বৈধ চেয়ারম্যান। পার্টির ভাঙ্গন সম্পর্কে তিনি বলেন, কেউ নিজেকে চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা দিলেই দল ভেঙ্গে যায় না।
তিনি বলেন, প্রেসিডিয়াম সদস্যদের অধিকাংশের সমর্থন নিয়েই তাকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হয়েছে এবং দলীয় এমপিদের অধিকাংশের সমর্থন নিয়েই সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে নাম ঘোষণার জন্য স্পীকারকে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
বনানীতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে পাল্টা সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, রওশন এরশাদ আমার মায়ের মতো। তিনি নিজ মুখে তো আর বলেননি যে তিনি চেয়ারম্যান। তাকে সম্মান করি। আশা করি, তিনি এমন কিছু করবেন না, যাতে তার সম্মান নষ্ট হয়। দল ভাঙ্গনের মুখে পড়েনি দাবি করে কাদের বলেন, যে কোন লোক যে কোন জায়গায় বলে দিল, তিনি রাজা। রাজার তো রাজত্ব থাকতে হবে, প্রজা থাকতে হবে। জিএম কাদেরের সংবাদ সম্মেলনের সময় জিয়াউদ্দিন বাবলু, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলাসহ নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।