স্মৃতিতে পঁচাত্তরের ১৫ আগষ্ট

39

প্রফেসর ড. কামাল উদ্দিন আহাম্মদ

ধন ধান্য পুষ্প ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা। সাড়ে পাঁচ হাজার বছরের পুরাতন হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো সভ্যতার উৎকর্ষতা কালের বিবর্তনে সারা বিশ্বে সুনামের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছিল। এর সংস্কৃতি, সম্পদ, শিল্প, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সবই ছিল উচ্চমানের। সে জন্য বিভিন্ন সময়ে এ ভূমি বাণিজ্যের উৎকৃষ্ট স্থান হয়েছিল। বিভিন্ন আগ্রাসী শক্তি বারবার এ ভূমির সম্পদ লুণ্ঠনে ও ক্ষমতা দখলে তৎপর হয়েছে এবং ফলস্বরূপ শোষণও করেছে বিভিন্ন সময়ে। শেষ দুটি শোষকগোষ্ঠী ছিল ইংরেজ ও পাকিস্তানি। বাংলার বহু সন্তান ও রাজনীতিবিদ শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন, জীবন দিয়েছেন, পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে এ ভূমিকে রক্ষা করার জন্য। সর্বশেষ পাকিস্তানিরা যখন নানা কায়দায় পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলাকে শোষণ করছিল, তখনই এক ত্রাণ কর্তার জন্ম হয় এ বঙ্গে। এ দেশের জনগণের মায়ের ভাষা বাংলাকে হরণ করা, এ দেশের সম্পদ নানা উপায়ে লুণ্ঠন করা, জনগণের অধিকার হরণ করা, চাকরির ক্ষেত্রে বঞ্চিত করা, বাঙালিদের নানাভাবে অবদমিত করে পরাধীন এক জাতিতে পরিণত করার কাজে যখন পাকিস্তানিরা লিপ্ত ছিল ঠিক তখনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালি জাতি জেগে উঠে এবং মহাসংগ্রামের শুরু হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা, ১৯৬৯ সালের ১১ দফার আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এ সবই বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও নির্দেশনায় পরিচালিত হয়। ৩০ লাখ শহীদ ও ৩ লাখ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ও নির্দেশনায় কোটি কোটি লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে নয় মাসে দেশকে স্বাধীন করেন। এ ঘটনা বিরল। পৃথিবীর ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর সমতুল্য আর কোনো নেতা নেই- যার ত্যাগ ও সাহস বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তুলনা করা যায়। সে জন্য তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। তিনি মৃত্যুর মুখ থেকে পাকিস্তান হতে ফিরে এসে দেশকে গড়ে তুলেছিলেন এক ধ্বংসস্তূপ থেকে। কিন্তু এ দেশের বিশ্বাসঘাতক, দেশদ্রোহী, নিমকহারাম ও পাকিস্তানপন্থি ব্যক্তিরা আন্তর্জাতিক চক্রের সঙ্গে মিলিত হয়ে গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের ১৮ জনকে নির্মমভাবে হত্যার মাধ্যমে জাতিকে কলঙ্কিত করে।
১৯৭৫ সাল। এইচএসসি পাস করে মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি। থাকতাম মানিকগঞ্জ মহকুমা পশুপালন কর্মকর্তা কাকা ডা. মিনহাজ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে। দিনটি ছিল শুক্রবার। ১৫ আগষ্ট। খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখলাম কাকার বিষণ্ন মুখ, প্রিয়জন হারানোর বেদনায় বিমর্ষ, তিনি কাঁদছেন আর রেডিওর সংবাদ শুনছেন। রেডিওতে ততক্ষণে মেজর ডালিমের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে : ‘আমি মেজর ডালিম বলছি- শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে! বলে কী? এ-ও হতে পারে? পাকিস্তানি জালেমরা অনেক ষড়যন্ত্র করে, বিচারের নামে প্রহসন করে যাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করতে চেয়ে সফল হতে পারেনি, তারই স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে- এটা বিশ্বাস হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল- স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শত্রম্নরা কোনো গোপন বেতার থেকে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। হ্যাঁ, প্রথম যখন শুনি বঙ্গবন্ধুর হত্যার কথা তখন প্রাথমিকভাবে আমার মতো অনেকের এরকমই মনে হয়েছিল। কারণ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর ছিল অবিশ্বাস্য। আকাশ ভেঙে মাটিতে পড়তে পারে, কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা কিভাবে সম্ভব হতে পারে!
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি দেখেছি সংগ্রাম, দেখেছি হত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞ, মনে আছে বাড়ি ছেড়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পের সঙ্গে থাকার দিনগুলোর কথা। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কত মিছিল কত মিটিং। ১৯৭১ সালে ছোট-বড় সবাই দেখেছে শেখ মুজিব আর নৌকার জয়জয়কার। এ ছাড়াও শুনেছিলাম বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। স্কুলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানেরর্ যালিতে অংশগ্রহণ করে ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে স্স্নোগান দিয়ে বড়দের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলাতাম, মিছিল করতাম। আগষ্ট ট্র্যাজেডির সকাল বেলা বাড়িভরা মানুষ আর ভয় ভয় চোখে সবার চোখে জল দেখে নিজেও উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে মানুষ ছিল বিপন্ন ভারাক্রান্ত জনক হারানোর শোকের মাতমে স্তম্ভিত।
পনেরোই আগষ্ট ছিল আমাদের জাতির জন্য সত্যিই একটি বিয়োগান্তক ঘটনা। নৃশংস হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে আমাদের স্বাধীনতার বিজয়ের মূলে আঘাত করা হয়েছিল। একজন মুক্তিযোদ্ধা প্রত্যক্ষ সহযোগী হিসেবে এ মৃত্যুকে কোনোভাবে মেনে নিতে পারছিলাম না। মানসিকভাবে আর একটা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে লাগলাম। কোথাও কোথাও বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ হলেও তা আর বেশি দূর যেতে পারেনি। শেষ ভরসা ছিল সাভার রক্ষী বাহিনীর ক্যাম্প। কিন্তু বিদ্রোহীদের অনুগতরা সাভার ক্যান্টনমেন্ট থেকে গিয়ে রক্ষী বাহিনীর সেনাদের অবরোধ করে ফেলেছিল। সেদিন বঙ্গবন্ধুকে কেউ মেরে ফেলতে পারে সেটা যেমন ছিল ভাবনার বাইরে, তেমনি তাকে হত্যা করলে কী করণীয় সেটাও যেন কারও ভাবনার মধ্যেই নেই। সেদিন আশা করেছিলাম অনেক নেতা প্রতিবাদ করবে, কিন্তু ঘটনা ঘটল তার উল্টো। জাতীয় চার নেতা তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান এবং তোফায়েল আহমদ, আব্দুর রাজ্জাক ছাড়া অনেকেই মন্ত্রিসভায় শপথ নিয়েছিল। আসলেই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করে পাকিস্তানি মূল্যবোধ সম্পৃক্ত একটি দেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যা সেই ষড়যন্ত্রেরই অংশ বিশেষ। ১৫ আগষ্টের পরপরই স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকরা ঝাঁপিয়ে পরেছিল স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ওপর, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ আর সংখ্যালঘুদের ওপর। নির্বিচারে হত্যা-ধর্ষণ-সংখ্যালঘু নির্যাতন শুরু হয় চোখের পলকে। বুঝে উঠার আগেই প্রশাসনের সব ক্ষেত্র বদলে যায়। পাকিস্তানপন্থিরা শুরু করে স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের ওপর নির্মম অত্যাচার।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের মাত্র ৩/৪ দিন পর দেখেছি সর্বত্র নামকরা রাজাকারদের উত্থান, দেখেছি তাদের আক্রমণে কী করে নির্যাতিত হয়েছিল স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকরা। মনে আছে এখনো, হোমনা থানা আওয়ামী লীগ নেতা দক্ষিণ ইউনিয়নের তৎকালীন ভাইস-চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম ও নিলখী ইউনিয়নের ভাইস-চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম রুক্কু মিয়াকে হত্যা করা হয়েছিল। এটা শুধু একটি এলাকার কথা তুলে ধরলাম, এভাবে সারাদেশে আতঙ্ক সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগকে নিঃশেষ করার জন্য খুনিরা মেতে উঠেছিল। যা বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে চলছিল। তাদের নির্যাতনের ভয়ে এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছিল, তাদের অপরাধ ছিল তারা মুক্তিযোদ্ধা। দেখেছিলাম কী করে রাতারাতি ভারত বিদ্বেষী উসকানিমূলক কর্মকান্ড, ভারতীয় কোনো পণ্যের জন্য স্থানীয় হিন্দুদের বাসাবাড়িতে তলস্নাশির নামে নির্যাতন চলে।
নিজের অজান্তেই সেই ১৫ আগষ্টের ইতিহাসের ভয়াবহ কলঙ্কিত সেই ভোর আমার বিবেককে দংশিত করেছিল, আমার যৌবনের দুঃসহ স্মৃতি আমাকে পীড়িত করে আমার মনে যে ক্ষত হয়েছিল তা থেকেই আমাকে ধাবিত করেছিল সেদিনের সেই শোককে শক্তি হিসেবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ফলে ক্রমান্বয়ে সত্যিকারের বঙ্গবন্ধু প্রেমিক হয়ে ছাত্র রাজনীতি থেকে শুরু করে শিক্ষক রাজনীতিতে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলার কারণে চাকরিচ্যুত করার হুমকি দিয়েছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। নানা অত্যাচার-হয়রানি শিকার হয়েও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিন্দু পরিমাণ বিচ্যুত হইনি।
বঙ্গবন্ধুর ছোট ছেলে শেখ রাসেলের কণ্ঠে বাঁচার আকুতি পত্রিকায় পড়ে আমি কতবার যে কেঁদেছি। সেই বেদনাবিধুর কথাগুলো মনে পড়লেই আপস্নুত হয়ে যাই। ‘কী বীভৎসতা! প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে নিথর পড়ে আছে ঘাতকের বুলেটে ঝাঁঝরা হওয়া চেক লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরা স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর লাশ। তলপেট ও বুক ছিল বুলেটে ঝাঁঝরা। নিথর দেহের পাশেই তার ভাঙা চশমা ও অতিপ্রিয় তামাকের পাইপটি। অভ্যর্থনা কক্ষে শেখ কামাল, টেলিফোন অপারেটর, মূল বেডরুমের সামনে বেগম মুজিব, বেডরুমে সুলতানা কামাল, শেখ জামাল, রোজী জামাল, নিচতলার সিঁড়িসংলগ্ন বাথরুমে শেখ নাসের এবং মূল বেডরুমে দুই ভাবির ঠিক মাঝখানে বুলেটে ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত অবস্থায় পড়েছিল ছোট্ট শিশু শেখ রাসেলের লাশ। শিশু রাসেলের রক্তভেজা লাশ দেখে খুনিদের প্রতি চরম ঘৃণা-ধিক্কার জানানোর ভাষা পায় না মানবতাবাদী বিশ্বের কোনো মানুষ। সেদিন ওই ঘাতকরা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে হত্যার এক জঘন্য উলস্নাসে মেতে উঠেছিল। হত্যা করেছিল বিভিন্ন ঘরে ও একাধিক বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার এবং নিকটাত্মীয়সহ মোট ২৬ জনকে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সে সময় পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করার কারণে তারা প্রাণে বেঁচে যান। তাদের বাংলাদেশে ফিরে আসার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল।
খুনিদের বাঁচানোর জন্য ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন। ‘দি বাংলাদেশ গেজেট, পাবলিশড বাই অথোরিটি’ লেখা অধ্যাদেশটিতে খন্দকার মোশতাকের স্বাক্ষর আছে। মোশতাকের স্বাক্ষরের পর আধ্যাদেশে তৎকালীন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এইচ রহমানের স্বাক্ষর আছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট ভোরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর মোশতাক নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দেন। এরপর ক্ষমতায় আসে সামরিক শাসক মেজর জিয়া। সেদিন জিয়াউর রহমান ঘোষণা করেছিলেন ৩ মাসের মধ্যে ব্যারাকে ফিরে যাবেন, কিন্তু এটি বাস্তবে হয়নি। তিনি হ্যাঁ-না ভোট দিয়ে রাষ্ট্রপতি হন। যা ছিল একটি প্রহসনের নির্বাচন। ক্ষমতা দখল করে জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা দেন। এভাবেই মোশতাক-জিয়া-খালেদা গংরা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রক্ষা করার ষোলকলা পূর্ণ করেন। শুধু তাদের রক্ষা করেই ক্ষান্ত হয় নাই। তারা ওই খুনি চক্রদের অনেককে ভালোভবে পুরস্কৃত করেছিল। দিয়েছিল বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে গুরুত্বপূর্ণ পদ, কূটনীতিক পদ, মন্ত্রিত্ব, দেশদ্রোহী গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব। পাকিস্তানপন্থি শাহ আজিজুর রহমানকেও প্রধানমন্ত্রী করা হয়েছিল।
দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ” বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ উন্মুক্ত করা হয়। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর নিম্ন আদালত বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায় ঘোষণা করে ১৫ জন সাবেক সেনা সদস্যের মৃত্যুদন্ডাদেশ দেন। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল উচ্চ আদালত ১২ জনের মৃত্যুদন্ড অনুমোদন করেন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পাঁচ বছরেও বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের আপিল শুনানির ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তবে ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ সালের ৬ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা আদালতে ওঠে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতাসীন হলে সেই চূড়ান্ত বিচারের কাজটি শুরু হয়। বিচার শেষে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি কারাগারে আটক ৫ খুনি লে. কর্নেল (বরখাস্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল (অব.) মহিউদ্দিন আহমদ, লে. কর্নেল (অব.) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর (অব.) বজলুল হুদা এবং মেজর (অব.) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। আর যাদের এখনও ফাঁসি কার্যকর হয়নি তাদের দেশে ফেরত এনে অবিলম্বে রায় কার্যকর এই সরকারকেই করতে হবে। তা না হলে এ নিয়ে আর একটি ইনডেমনিটি হতে পারে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা ওদের ফাঁসির রায় বাস্তবায়ন চাই। সঙ্গে সঙ্গে এই শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে ওই অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করার শপথ নিতে হবে আজই।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস নতুন প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে নিজেদের সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হবে এবং দেশপ্রেম ও সততা দিয়ে সুখীসমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়তে অবদান রাখবে। নতুন প্রজন্মের প্রতি আহ্বান, সত্যকে জানো, সত্য পথে চলো, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তার সুযোগ্য কন্যা কৃষকরতœ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এ দেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করতে ব্রতী হও। এ ব্রত নিয়ে আমরা এগিয়ে চলছি। ফলস্বরূপ দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৯০৯ মার্কিন ডলার। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। দেশ আজ স্বল্পোন্নত (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালনের প্রস্তুতি লগ্নে সবাইকে আহ্বান জানাই মনে প্রাণে কাজে কর্মে তার আদর্শকে অনুসরণ করার। বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে দেশ প্রেম, সততা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত একটি দেশ গড়তে হবে। তবেই জাতির পিতার সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে এবং তার রক্তের ঋণ কিছুটা হলেও শোধ হবে। এ দিনে জাতির পিতাসহ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টে শাহাদাতবরণকারী বঙ্গবন্ধু পরিবারের সব শহীদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
লেখক : ভাইস-চ্যান্সেলর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।