কাজিরবাজার ডেস্ক :
নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে …। এই গানের বাণীর মতোই না থেকেও সৃষ্টির আলোয় উজ্জ্বল তিনি। শরীরী অস্তিত্ব না থাকলেও বেঁচে আছেন আপন শিল্প ও সাহিত্যের ভুবনে। সরলরেখার মতোই সহজ লেখায় মোহাবিষ্ট করেছিলেন পাঠক কিংবা দর্শককে। একইসঙ্গে সাহিত্য ও শিল্পকে ধারণ করে হেঁটেছেন বর্ণময় পথে। সমৃদ্ধ করেছেন এদেশের সৃজনশীল প্রকাশনাশিল্পকে। তাঁর গল্প বা উপন্যাসের উদ্দীপক কিংবা রহস্যময় বুনটে বিভোর করে রেখেছিলেন পাঠককেই। বিচিত্র বিষয়ের নাটক কিংবা চলচ্চিত্রের মাধ্যমে শিল্পরসিককে দিয়েছেন অফুরন্ত আনন্দ। এভাবেই ক্রমাগত সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে জননন্দিত সাহিত্যিক হয়ে উঠেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। আজ শুক্রবার বাংলা সাহিত্যের অন্যতম এই জনপ্রিয় লেখক, নাট্যকার ও চলচ্চিত্রকারের সপ্তম প্রয়াণবার্ষিকী। ২০১২ সালে ১৯ জুলাই বর্ষার রাতে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পাড়ি জমান অদেখার ভুবনে। পাঠক, ভক্ত, পরিবার-পরিজন ও শুভানুধ্যায়ীদের অশ্রুধারায় সিক্ত করে বিদায় জানান প্রিয় পৃথিবীকে। বৃষ্টি ও জ্যোৎস্নাপ্রিয় এই সাহিত্যগ্রষ্টা নিজ হাতে গড়া নন্দনকানন নুহাশপল্লীর লিচুতলার ছায়ায় শায়িত হন চিরনিদ্রায়।
আজ লেখকের মৃত্যুদিবসে গাজীপুরের নুহাশপল্লীর লিচুতলায় তাঁর সমাধিক্ষেত্র ভরে উঠবে ফুলে ফুলে। ভক্ত ও অনুরাগীরা ফুলেল শুভেচ্ছা ও দোয়া কামনার মাধ্যমে লেখকের প্রতি জানাবেন শ্রদ্ধা-ভালবাসা।
এদিকে প্রতিটি জাতীয় পত্রিকায় তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী নিয়ে ছাপা হয়েছে প্রতিবেদন। টিভি চ্যানেলগুলোয় দিনভর থাকবে নাটকসহ নানা আয়োজন।
নুহাশপল্লীর ম্যানেজার সাইফুল ইসলাম বুলবুল জানান, নানা কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের প্রয়াণ দিবস পালন করা হবে। পিরুজালি ও এর আশপাশের এতিমখানার অন্তত সাড়ে তিনশ এতিমসহ সহ¯্রাধিক মুসল্লিকে নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। উপস্থিত থাকবেন হুমায়ূন আহমেদের বন্ধুবান্ধব ও স্বজনরা। আসবেন হুমায়ূন আহমেদের প্রকাশকরাও। তবে দেশের বাইরে থাকায় এ আয়োজনে উপস্থিত থাকবেন না হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন, তার দুই ছেলে নিষাদ হুমায়ূন ও নিনিত হুমায়ূন।
হুমায়ূন আহমেদের অনুজ লেখক ও কার্টুনিস্ট আহসান হাবিব জানান, আজ সকালে তিনি ও তার বড় বোন সুফিয়া খাতুনসহ তিন বোন নুহাশপল্লীতে গিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন। পারিবারিকভাবে দোয়া প্রার্থনার আয়োজন করা হবে।
বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি লেখকের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা জানাবেন বলে জানান অন্যপ্রকাশের প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম। হুমায়ূন ভক্তদের গড়া হিমু পরিবহন নামের সংগঠনের পক্ষ থেকে নুহাশপল্লীতে নিবেদনসহ লেখকের প্রয়াণবার্ষিকীতে নেয়া হয়েছে নানা কর্মসূচী।
পাঠক বিবেচনায় হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। উপন্যাসে নিজের প্রতিভার বিস্তার ঘটলেও তার শুরুটা ছিল কবিতা দিয়ে। এরপর নাটক, শিশুসাহিত্য, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, চলচ্চিত্র পরিচালনা থেকে শিল্প-সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি রেখে গেছেন নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর। লিখেছেন বেশ কিছু জনপ্রিয় গান। আর সাহিত্যের যে ক্ষেত্রেই নিজের পদচিহ্ন এঁকেছেন প্রত্যেকটিতেই দেখা পেয়েছেন সাফল্যের। বাংলা সাহিত্যে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর জনকও হুমায়ূন আহমেদ। ১৯৭২ সালে প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশের পরই ছড়িয়ে পড়ে তাঁর খ্যাতি। উপন্যাসে ও নাটকে তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলো বিশেষ করে ‘হিমু’, ‘মিসির আলী’, ‘শুভ্র’ তরুণ-তরুণীদের কাছে হয়ে ওঠে অনুকরণীয়। বলা হয়, তাঁর লেখা পছন্দ করেন না এমন মানুষও তাঁর লেখাটি ‘গোপনে’ পড়ে ফেলেন। দেশে এমন মানুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়, যারা তাঁর অন্তত একটি নাটক বা চলচ্চিত্র দেখেনি কিংবা তাঁর কোন বই পড়েনি। জনপ্রিয়তার জগতে এখনও তিনি একক ও অনন্য।
হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ সালের ১৩ নবেম্বর নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন। ডাক নাম কাজল। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ও মা আয়েশা ফয়েজের প্রথম সন্তান তিনি। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা, আর মা ছিলেন গৃহিণী। তিন ভাই দুই বোনের মাঝে তিনি ছিলেন সবার বড়। খ্যাতিমান কম্পিউটার বিজ্ঞানী, শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক জাফর ইকবাল তাঁর ছোট ভাই। সবার ছোট ভাই আহসান হাবীবও খ্যাতিমান কার্টুনিস্ট ও রম্যলেখক।
১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রী গ্রহণ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। নব্বই দশকের মাঝামাঝি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করে লেখালেখিতে পুরোপুরি মনোযোগ দেন। হুমায়ুন আহমেদের লেখা উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে নন্দিত নরকে, লীলাবতী, কবি, শঙ্খনীল কারাগার, গৌরীপুর জংশন, নৃপতি, বহুব্রীহি, এইসব দিনরাত্রি, দারুচিনি দ্বীপ, শুভ্র, নক্ষত্রের রাত, কোথাও কেউ নেই, আগুনের পরশমনি, শ্রাবণ মেঘের দিন, দেয়াল, জোছনা ও জননীর গল্প প্রভৃতি। তার পরিচালিত চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে আগুনের পরশমনি, শ্যামল ছায়া, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, নয় নম্বর বিপদ সংকেত ও ঘেটুপুত্র কমলা। টিভি নাট্যকার হিসেবেও হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন সমানভাবে সমাদৃত। আশির দশকের মাঝামাঝি তাঁর প্রথম টিভি নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’ তাঁকে এনে দিয়েছিল তুমুল জনপ্রিয়তা। তাঁর হাসির নাটক ‘বহুব্রীহি’ এবং ঐতিহাসিক নাটক ‘অয়োময়’ বাংলা টিভি নাটকের ইতিহাসে অনন্য সংযোজন। নাগরিক ধারাবাহিক ‘কোথাও কেউ নেই’ এর চরিত্র বাকের ভাই যেন বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছিল টিভি দর্শকদের কাছে।