ইসলামী রাষ্ট্র কর্তৃক ভূমি বণ্টন নীতি

33

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

(পূর্ব প্রকাশের পর)
অন্যায় ব্যবহার রোধ : অন্যায়ভাবে ভূমি তথা সম্পদ কুক্ষিগত করা ইসলামে নিষিদ্ধ। অন্যায়ভাবে কারো ভূমি আটকিয়ে রাখা বা মজুদদারী ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। মজুদদারীতে সম্পদকে কাজে না লাগিয়ে অলস রাখা হয় বলেই একে নিষিদ্ধ বিবেচনা করা হয়েছে। আল্লাহর সম্পদ পুঞ্জিভূত করে অপরকে তা ব্যবহারের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার অধিকার কারো নেই। মানুষের সম্পদ ব্যবহার করার সীমিত অধিকার আছে, কিন্তু অন্যায়ভাবে সম্পদ ব্যবহার করার অধিকার তার নেই।
যথার্থ ব্যবহার : ইসলামে যথার্থ ব্যবহারের অধিকার অবাধ নয়, বরং সীমিত। সমাজের কোন শ্রেণীর লোক যদি আশ্রয়হীন থাকে, গৃহহীন অবস্থায় তারা যদি গাছের তলায়, রাস্তায় বা পাহাড়ের গুহায় জীবন কাটায় সে অবস্থায় সম্পদ থাকলেও কেউ তার রুচি ও ইচ্ছানুযায়ী সৌখিন বাড়ি তৈরি করতে পারে না। ইসলাম তা সমর্থন করে না। ইসলাম চায় ভূমিসহ সকল সম্পদের যথার্থ ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজের প্রতিটি নাগরিকের বেঁচে থাকার মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে। সমাজ মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হলে সে ক্ষেত্রে কুরআনুল করীম উদ্বৃত্ত সম্পদের উপর ব্যক্তি মালিকদের অধিকার বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করেছে। কুরআনুল করীমে এসেছে : ‘আল্লাহ জনপদবাসীদের নিকট হতে তাঁর রসূল (স.)কে যা কিছু দিয়েছেন তা আল্লাহর, তাঁর রসূলের, রসূলের স্বজনদের, ইয়াতীমদের, অভাবগ্রস্ত ও পথচারীদের যাতে তোমাদের মধ্যে যারা বিত্তবান কেবল তাদের মধ্যেই ঐশ্বর্য আবর্তন না করে।’
স্থায়ী ব্যবহার : ইসলাম সীমাহীন সময়ের জন্য ভূমি তথা সম্পদের ওপর অধিকার স্বীকার করে না। যে মুহূর্তে সম্পদকে অব্যবহৃত রাখা বা সম্পদের অপব্যবহার করা হয় সেই মুহূর্তেই তা বাজেয়াপ্ত যোগ্য হয়ে যায়। ভূমি মালিক নিজে চাষ করতে না পারলে বা না করালে কিংবা নিজে যে পরিমাণ চাষ করতে পারে তার চেয়ে অধিক পরিমাণ ভূমি থাকলে, তা অন্যের দ্বারা চাষ করাবে। অথচা চাষের কাজে অন্য লোকের সাহায্য গ্রহণ করবে। নিজের ভোগ ও ব্যবহারের প্রয়োজন না হলে, অন্য কথায় কারো প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভূমি থাকলে তা অন্য কোন ভূমিহীনকে চাষাবাদ বা ভোগ করতে দিতে হবে। স্থায়ী ব্যবহারের মূল কথা হল, কুরআনুল করীমে উল্লেখিত এবং মহানবী স. এর নির্দেশিত পথে ভূমি তথা সম্পদ ব্যবহার করতে হবে।
মালিকানা লাভের বৈধ পন্থা : ইসলামে ভূমি তথা সম্পদের ব্যক্তি মালিকানা লাভের কয়েকটি বৈধ পন্থা রয়েছে। যেমন: ক. প্রাকৃতিক উপায় উপাদানের মধ্যে যে সব দ্রব্য ও সম্পদে কারো মালিকানা বা অধিকার প্রতিষ্ঠিত, প্রথম দখলের মাধ্যমে তাতে দখলকারীর মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবে। মহানবী স. বলেছেন : ‘যে ব্যক্তি এমন কোন অনাবাদী জমি আবাদ কবে, যা কারো মালিকানায় নেই, সেই তার মালিক হবে।’ খ. নিজস্ব জ্ঞান বা প্রতিভা কাজে খাটিয়ে কোন জিনিস আবিষ্কার করলে বা কোন যন্ত্র প্রস্তুত করলে, উক্ত জিনিস ব্যবহারে তার স্বত্ব স্বীকৃত ও সংরক্ষিত হবে। কোন ব্যক্তির বৈধ পরিশ্রমলব্ধ অর্থ-সম্পদের ওপর তার মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবে। ঘ. উপযুক্ত বিনিময়ে সম্পদ ক্রয়ের মাধ্যমেও ভূমি তথা সম্পদের মালিকানা লাভ করা যায়। মহান আল্লাহ বলেন : ‘হে মুমিনগণ! তোমরা একে অপরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না, কিন্তু পরস্পর সম্মতির ভিত্তিতে ব্যবসা করা বৈধ।’ ঙ. উত্তরাধিকার সূত্রে কেউ কোন সম্পদ প্রাপ্ত হলে তাতে তার মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবে। মহান আল্লাহ বলেন : ‘পিতা-মাতা এবং আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষের অংশ আছে এবং পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীরও অংশ আছে, তা অল্পই হোক বা বেশিই হোক, নির্ধারিত অংশ।’ চ. রাষ্ট্র বা সরকার কোন নাগরিককে কোন জমি বা সম্পত্তি প্রদান করলে উক্ত ব্যক্তি প্রদত্ত সম্পত্তির মালিক হবে। ইসলামী পদ্ধতিতে একে ‘ইকতা’ পদ্ধতি বলে। ছ. উপহার-উপঢৌকন, হেবা বা অসীয়তের মাধ্যমেও সম্পদের মালিকানা লাভ করা যায়।
মালিকানাবিহীন ভূমি উন্নয়ন ও বণ্টন নীতি : ইসলামী অর্থনীতির বিশেষ উল্লেখযোগ্য নীতি হচ্ছে রাষ্ট্র ও সরকারের দখলে যে সব মালিকবিহীন জমি থাকে, এসব ভূমি ঐ সব ভূমিহীন বা স্বল্প ভূমির মালিক লোকদের মধ্যে বণ্টন করতে হবে, যারা এসব ভূমি আবাদ ও চাষোপযোগী করে তুলতে এবং তাতে ফসল ফলাতে ইচ্ছুক ও সক্ষম। এই ভূমিসমূহ নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে আবাদ করার শর্তে তাদেরকে দেয়া হবে। তারা যদি এই নির্দিষ্ট মেয়াদ তথা তিন বছর মেয়াদের মধ্যে আবাদ করে, তবে এই জমি তাদের অধিকারেই থাকবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আবাদ না করলে তা সরকারের নিকট প্রত্যার্পিত হবে এবং সরকার তা অপর ভূমিহীন জনগণের মধ্যে পুনর্বণ্টন করবে। মহানবী (স.) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের আমলে এরূপ ভূমি বণ্টনের নিয়ম প্রচলিত ছিল। এ ভূমি বণ্টনের ব্যাপারে কিছু জরুরি শর্ত রয়েছে : ক. সেই জমি কোন নাগরিকের মালিকানাভুক্ত হবে না। খ. সেই জমি সাধারণ জন-মানুষের কল্যাণের সাথে সম্পর্কিত হবে না। এ ধরনের কোন জমি বিশেষ কোন নাগরিককে ব্যক্তিগতভাবে মালিকানা হিসেবে দান করার সরকারের কোন অধিকার নেই। গ. এ জমি এমন হবে না যেখানে জন-মানবের জন্য অপরিহার্য কোন ধাতু বা সম্পদের খনি অবস্থিত। এরূপ হলে সেই জমি ব্যক্তিগতভাবে কাউকে দেয়া বৈধ হবে না। এই তিন প্রকার ভূমি ছাড়া অন্য সকল প্রকার ভূমি সরকার যাকে ইচ্ছে বণ্টন করে দিতে পারবে। তবে এ ক্ষেত্রে স্বজন প্রীতি, ঘুষ কিংবা অন্য কোন দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করা যাবে না।
ইসলামের আবির্ভাবকালে আরব দেশের ভূমির তিনটি অবস্থা ছিল : ক. অনেক ভূমি ছিল ব্যক্তি মালিকানাভুক্ত। খ. এমন অনেক ভূমি ছিল, যার কেউ মালিক ছিল না। গ. গৃহপালিত পশুর সাধারণ চারণভূমিরূপে নির্দিষ্ট ছিল অনেক ভূমি। মহানবী স. মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর সর্বপ্রথম মালিকানাবিহীন অনাবাদী জমি আবাদ করার উদ্দেশ্যে ঘোষণা করলেন : যে ব্যক্তি এমন কোন জমি আবাদ করে যার মালিক নেই, তাহলে সে ব্যক্তিই (ঐ জমির) সবচেয়ে বেশি অধিকারী।’ লোকেরা তখন সাধ্যানুসারে জমি আবাদ করারও মালিক হবার জন্য চেষ্টা করতে লেগে গেল। এভাবে বহু লোকের মধ্যে মালিকানাবিহীন জমি বণ্টন করা হল।
ইসলামী রাষ্ট্র কর্তৃক ভূমি বণ্টনের এটাই হল মূলনীতি। অনাবাদী ভূমি আবাদ করা অথবা ভূমিহীন কৃষক বা মুহাজিরদের পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে সরকারের পক্ষ হতে কাউকে ভূমি দান করা ইসলামে বৈধ। একে আরবীতে ‘ইকতা’ বলে। মহানবী (স.) ইকতারূপে হযরত আবূ বকর, হযরত উমর, হযরত আলী, হযরত বেলাল, হযরত জুবায়ের (রা.) প্রমুখ সাহাবীগণকে ভূমি দান করেছিলেন। এভাবে খুলাফায়ে রাশেদীনও একাধিক ব্যক্তিকে ইকতারূপে ভূমি দান করেছেন। ‘কিতাবুল খারাজ’-এ উল্লেখ রয়েছে, ‘যদি ইকতার উদ্দেশ্য সাধিত না হয় অথবা যদি অন্যায়রূপে বা অসদুদ্দেশ্যে ইকতা প্রদান করা হয়, তবে এই সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে।’ হযরত উমর (র.) মহানবী (স.) কর্তৃক প্রদত্ত হযরত বেলাল ইবন হারিস মুযানীর র. ইকতার একাংশ এ জন্যই ফেরত নিয়েছিলেন যে, তিনি এই ভূমি যথাযথভাবে আবাদ করতে সক্ষম হননি। অনুরূপভাবে খলীফা উমর ইবন আবদুল আযীয (র.) আপন পরিবারের জন্য প্রাপ্ত লাখেরাজ ভূসম্পত্তি এজন্য বাতিল করেছিলেন যে, এগুলো উমাইয়্যা শাসকবর্গ স্বজনপ্রীতির ভিত্তিতে প্রদান করেছিলেন। (অসমাপ্ত)