কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেশে মজুদ গ্যাসের পরিমাণ দ্রুত কমে আসছে। গ্যাস মজুদের পরিমাণ ২৮ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন ঘনফুট)-এরমধ্যে মাত্র ১৬ টিসিএফ ব্যবহার করা হয়েছে। কমতে কমতে এখন বাকি আছে মাত্র ১২ টিসিএফ। জ্বালানি খাতের বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান হাইড্রো কার্বন ইউনিট আগামী ২০ বছরেই শেষ হবে দেশের গ্যাসের মজুদ। প্রতিষ্ঠানটির সবশেষ প্রতিবেদনে বলছে, ২০৩০ সাল থেকে ৪০ সালের মধ্যে দেশের অধিকাংশ খনির গ্যাস ফুরিয়ে যাবে। ফলে দুই-তিন বছরের মধ্যেই দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন কমতে শুরু করবে।
বাংলাদেশে এখন মোট ২৬টি খনি থেকে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। খনিগুলো আবিষ্কারের সময় যে পরিমাণ গ্যাস ছিল, এখন তা অনেক কমে গেছে। এছাড়া, গত কয়েক বছরে দেশের স্থলভাগ ও সমুদ্রে বড় কোনও গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের ঘোষণা আসেনি। সূত্র জানায়, গত ১০ বছরে যেসব খনি আবিষ্কৃত হয়েছে বলে প্রচার চালানো হয়েছে, তার ফল হতাশ করেছে। সঙ্গতকারণে দেশের চাহিদা মেটাতে পুরনো ক্ষেত্রে নতুন কূপ খনন করে উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে।
হাইড্রো কার্বন ইউনিটের প্রতিবেদন বলছে, বাপেক্সের অধীন মোট ৮টি গ্যাসক্ষেত্র আছে। এরমধ্যে এই ক্ষেত্রেগুলোর প্রাথমিক মজুদ ছিল এক হাজার ৪৬০ দশমিক ৮ বিলিয়ন ঘনফুট (বিসিএফ)। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৩৮ দশমিক ৯ বিলিয়ন ঘনফুট। ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে বেগমগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্রের মজুদ ছিল ৩৩ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এসে দেখা গেছে, এই ক্ষেত্রের বর্তমান মজুদ এখন আছে ৩১ দশমিক ২ বিলিয়ন ঘনফুট। শাহজিবাজার গ্যাসক্ষেত্রের মজুদ ছিল ২৬১ বিলিয়ন ঘনফুট। এখন তা কমে ২০০ দশমিক ৪ বিলিয়ন ঘনফুটে দাঁড়িয়েছে। সেমুতাংয়ে ৩১৮ বিলিয়ন ঘনফুট ছিল, এখন ৩০৪ দশমিক ৯ বিলিয়ন ঘনফুট। ফেঞ্চুগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্রের মজুদ ছিল ৩২৯ বিলিয়ন ঘনফুট, এখন ১৭০ দশমিক ৪ বিলিয়ন ঘনফুট। সালদা নদী ২৭৫ থেকে কমে ১৮৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ঘনফুট। শ্রীকাইল ১৬১ থেকে কমে ৭৭ দশমিক ৭ বিলিয়ন ঘনফুট। সুন্দলপুর ৫০ দশমিক ২ থেকে কমে এখন ৩৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ঘনফুট। রূপগঞ্জ ৩৩ দশমিক ৬ থেকে কমে ৩২ দশমিক ৯ বিসিএফ গ্যাস আছে।
বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেডের অধীন গ্যাসক্ষেত্র আছে ৬টি। এরমধ্যে মেঘনায় ছিল ১০১ বিলিয়ন ঘনফুট, এখন আছে মাত্র ৩১ দশমিক ৩ ঘনফুট। নরসিংদীতে ছিল ৩৪৫, এখন আছে ১৪৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ঘনফুট। কামতায় ছিল ৫০, আছে ২৮ দশমিক ৯বিলিয়ন ঘনফুট। হবিগঞ্জে দুই হাজার ৭৪৭ বিলিয়ন থেকে কমে এখন ৩৪৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ঘনফুট। বাখরাবাদে এক হাজার ৩৮৭ থেকে কমে এখন ৫৭৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ঘনফুট। তিতাসে সাত হাজার ৫৮২ থেকে কমে এখন দুই হাজার ৯০০ বিলিয়ন ঘনফুট।
কেয়ার্নের অধীন সাঙ্গুর মজুদ ছিল ৭৭১ বিলিয়ন ঘনফুট। এখন তা কমে হয়েছে ২৮১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ঘনফুট। যদিও সাঙ্গুতে কোনও গ্যাস পাওয়ার যাচ্ছে না বলে ঘোষণা দিয়ে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করেছে কেয়ার্ন। পরে কেয়ার্ন তাদের শেয়ার অস্ট্রেলিয়ার একটি কোম্পানি সান্তোসের কাছে বিক্রি করে চলে যায়। কূপ খনন করে আর গ্যাস পায়নি সান্তোস। এরপর তারাও শেয়ার বিক্রি করে চলে যায়। ফলে সমুদ্রবক্ষের একমাত্র আবিষ্কৃত গ্যাস ক্ষেত্রটি এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
শেভরনের অধীন তিনটি গ্যাসক্ষেত্রে মোট মজুদ ছিল ছয় হাজার ৩৭২ বিলিয়ন ঘনফুট। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৮৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ঘনফুট। এরমধ্যে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের মজুদ ছিল চার হাজার ৫৩২, এবং তা ৮৬৩ বিলিয়ন ঘনফুট; মৌলভীবাজারে ছিল ৪৯৪, এখন তা ১৭০ দশমিক ৫ ঘনফুটে দাঁড়িয়েছে। জালালাবাদে ছিল এক হাজার ৩৪৬ বিলিয়ন ঘনফুট; এখন কমে মাত্র ৫৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন ঘনফুটে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে, নাইকোর অধীন ফেনী গ্যাসক্ষেত্রের মজুদ ছিল ১৩০ বিলিয়ন ঘনফুট, এখন তা মাত্র ৬৭ বিলিয়ন ঘনফুটে নেমে এসেছে।
সিলেট গ্যাসফিল্ড লিমিটেডের অধীন ৫টি ক্ষেত্রের মজুদ ছিল সাত হাজার ৩৩ বিলিয়ন ঘনফুট। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৩৩৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন ঘনফুটে। এরমধ্যে কৈলাশটিলায় মজুদ ছিল দুই হাজার ৮৮০ বিলিয়ন ঘনফুট, এখন তা কমে দুই হাজার ১৪৯ দশমিক ৫ বিলিয়ন ঘনফুট। সিলেটে ছিল ৪০৮ বিলিয়ন ঘনফুট, এখন তা ১৯৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ঘনফুট। রশিদপুরে ছিল তিন হাজার ১৩৪ বিলিয়ন ঘনফুট, এখন দুই হাজার ৫০৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন ঘনফুট। ছাতকে ছিল ৪৭৪ বিলিয়ন ঘনফুট, এখন তা ৪৪৮ দশমিক ২ বিলিয়ন ঘনফুট। বিয়ানীবাজারে ছিল ১৩৭ বিলিয়ন ঘনফুট, এখন তা মাত্র ৪১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ঘনফুট হয়েছে।
তাল্লোর গ্যাসক্ষেত্র বাঙ্গুরার মজুদ ছিল ৬২১ বিলিয়ন ঘনফুট, এখন তা ১৯০ বিলিয়ন ঘনফুট। এছাড়া কুতুবদিয়ায় আরও ৪৬ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া গেছে।
সবমিলিয়ে ২৬টি গ্যাসক্ষেত্রের সম্ভাব্য মোট মজুদ ধরা হয়েছিল ২৮ হাজার ৬৮৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন ঘনফুট। যা এখন কমে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৭০ বিলিয়ন ঘনফুটে।
গ্যাস কমে যাওয়ার বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ শামসুল আলম বলেন, ‘গ্যাসের টাকা দ্রুত উঠিয়ে আনতে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি করে গ্যাস তুলছে আন্তর্জাতিক গ্যাস কোম্পানিগুলো (আইওসি)। অন্যদিকে দেশীয় কোম্পানি বাপেক্সকে বসিয়ে রাখায় গ্যাস অনুসন্ধানের কাজও হচ্ছে না। ফলে হঠাৎ করেই গ্যাসের মজুদ এত কমে যেতে পারে যে, কেউই আর গ্যাস পাবে না।’ তিনি বলেন, ‘এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। তবে এখনই সব ফেলে শুধু গ্যাস অনুসন্ধানে মনোযোগ দেওয়া গেলে আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। আমাদের সাগর, পাবর্ত্য এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধান করাই হয়নি। অন্যদিকে স্থলভাগেরও অনেক এলাকা এখনও অনুসন্ধান করা হয়নি।’
এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞা আরও বলেন, ‘এখনই অনুসন্ধানের উদ্যোগ না নিলে আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়তেই থাকবে। আর সঙ্গে সঙ্গে এই অজুহাতে সরকার গ্যাসের দামও বাড়াতে থাকবে।’
জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম বলেন, ‘এরইমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আরও আগেই নতুন গ্যাস অনুসন্ধানে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হতো। এজন্য সবার আগে সাগরের তেল গ্যাস অনুসন্ধানের কাজগুলো দ্রুততার সঙ্গে শুরু করা দরকার।’ তিনি বলেন, ‘২০১৪ সালে আমরা সাগরে নতুন ব্লক পেয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনও উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। এই বছর মাত্র মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভের অনুমোদন দেওয়া হলো। অন্যদিকে সাগরের পুরনো ব্লকগুলোর মধ্যে কিছু ইজারা দেওয়ার আলোচনা করা হলেও শেষ পর্যন্ত কোনোটিই চূড়ান্ত হয়নি। একদিকে নতুন অনুসন্ধান হচ্ছে, না অন্যদিকে কমতে শুরু করেছে গ্যাসের মজুদ। যা বাংলাদেশের জন্য একটি আশঙ্কাজনক অবস্থা সৃষ্টি করছে।’
সরকার গ্যাস আমদানির দিকে ঝুঁকে পড়েছে অভিযোগ করে ম. তামিম বলেন, ‘এতে যে পরিমাণ টাকা খরচ হচ্ছে, তার চেয়ে অনেক কম খরচ হয় তেল আমদানিতে। নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কার না হলে আমদানি খরচ আরও বাড়বে। এই খরচ ওঠাতে গিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়বে।’ গ্যাসের পাশাপাশি কয়লার বিষয়ে সরকারকে সিদ্ধান্ত নেওয়ারও পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এখনই কয়লার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’ পরে এই কয়লা উঠিয়ে আর কাজে লাগানো যাবে না বলেও এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ মনে করেন।