মোঃ ফখরুল ইসলাম
(পূর্ব প্রকাশের পর)
তাযকিয়ায়ে নাফস ও রামাদান : এখন আমরা দেখবো রামাদান কিভাবে তায়কিয়ায়ে নাফসে ভূমিকা রাখে। তাযকিয়ায়ে নাফসের মূল কথাই হলো নাফসকে রুহ এর নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। আর এজন্য রুহকে শক্তিশালী করতে হবে। আর এ উপায় আল্লাহ তায়ালাই আমাদের বাতলিয়ে দিয়েছেন। ইতিপূর্বে আমরা সুরা আ‘লার যে আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়েছি তাতে আল্লাহতায়ালা বলেছেন নিজেদের মালিকের নাম স্মরণ আর তাঁর উদ্দেশ্যে সালাত আদায়ের মাধ্যমে তাযকিয়ায়ে নাফস সম্ভব। আর সালাতও মুলত আল্লাহর যিকর। “যে ব্যক্তি (নিজেকে) পরিশুদ্ধ করে নিয়েছে, সে অবশ্যই সফলকাম হয়েছে এবং সে নিজের মালিকের নাম স্মরণ করেছে অতঃপর সে নামাজ আদায় করেছে (৮৭: আ‘লা: ১৪-১৫)।” অর্থাৎ যে রুহ সার্বক্ষণিকভাবে নিজের রবকে স্মরণ রাখবে সে তার নাফসকে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। আর এজন্য সকল মৌলিক এবাদতের মাধ্যমে আমরা মূলত: নিজের রবকেই স্মরণ করি। পার্থক্য হচ্ছে নামায আমাদেরকে দিনে কয়েক ঘন্টা নিজের রবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। অনুরূপ হজ্ব জীবনে একবার অথবা যখন হজ্ব-উমরা করি তখন নিজের রবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যাকাত আমাদেরকে যাকাত আদায়কালে নিজের রবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, আর রামাদান পুরো একমাস ব্যাপী এবং এক সাথে সারা বিশ্বজুড়ে আমাদেরকে আমাদের রবের কথা স্মরণ করে দিয়ে তাযকিয়ায়ে নাফসে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
ঈমান বিল্লাহ ও ঈমান বিল আখিরাতের প্রশিক্ষণ : একমাত্র রামাদান এমন একটি ইবাদত যার কোন বাহ্যিক প্রকাশ নেই।যেখানে কেউ তাকে দেখে না এমন নির্জন স্থানে গিয়েও রোজাদার কোন কিছু পানাহার করে না এ বিশ্বাসে যে, কেউ তাকে না দেখলেও মহান আল্লাহ তায়ালা তাকে দেখছেন এবং আদালতে আখেরাতে এ কাজের জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে তাকে জবাবদিহি করতে হবে। এভাবে দীর্ঘ এক মাস ব্যাপী প্রতিদিন ১৪-১৫ ঘন্টা করে তার এ প্রশিক্ষণ হয়। তার নাফস পানাহার করতে চায়, যৌনাচার করতে চায়, আর রুহ বলে, না হবে না আল্লাহর নিষেধ আছে, আখেরাতে হিসেব দিতে হবে। এভাবে দীর্ঘ এক মাসের প্রশিক্ষণে আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি রুহের ঈমান যত শানিত হতে থাকে সেতার নাফসের উপর তত কর্তৃত্ব অর্জন করতে থাকে।
শরীয়ত মানার দীর্ঘ অভ্যাস সৃষ্টি করা : রামাদানের মত আর কোন ইবাদত এত দীর্ঘ সময় ধরে মানুষের মধ্যে শরীয়ত মানার অভ্যাস সৃষ্টি করে না।এ একমাস আমরা শুধু দীর্ঘ সময় শরীয়ত মানি না, সাথে সাথে অন্য সময়ের তুলনায় বেশী বেশী বিধি-নিষেধও মেনে চলি। অন্য সময় যে বিষয়গুলো হালাল, রামাদানের সময় দিনের বেলায় সেগুলোও হারাম করে দেয়া হয়। আবার রামাদানে দিনে-রাতে যে বিষয়গুলো হালাল তারও কিছু কিছু এতেকাফরত ব্যক্তির জন্য হারাম করে দেয়া হয়। যাতে করে দীর্ঘ সময় ধরে অন্য সমযের তুলনায় বেশী বেশী বিধি-নিষেধ চর্চা করে মানুষের মধ্যে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ তথা শরীয়ত মানার অভ্যাস সৃষ্টি হয়। এ ভাবে দীর্ঘ এক মাস ধরে নাফসকে শরীয়ত মানতে বাধ্য করে রুহ নাফসের উপর তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে থাকে। আর এ কঠোর প্রশিক্ষণ জীবনে মাত্র একবার নয় বরং ঘুরে ঘুরে প্রতি বছর আসে।
পানাহারে সংযম সৃষ্টি করা : নাফসের খায়েশাতের অন্যতম হচ্ছে পানাহার বা যে কোন উপায়ে ক্ষুণিœবৃত্তি করা। নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে এটি একটি অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। মানুষের জীবন ধারণের জন্য পানাহারের বিকল্প নেই। কিন্তু যে নাফসের উপর রুহের আকাংখিত নিয়ন্ত্রণ নেই সে নাফস বৈধ বা অবৈধ যে কোন উপায়েই এ দাবী পূরণ করতে চায়। সে একদিকে যেমন হারাম জিনিস দিয়ে ক্ষুণিœবৃত্তি করতে চায় ঠিক তেমনি হারাম উপায়ে অর্জিত হালাল জিনিষ দিয়েও ক্ষুণিœবৃত্তি করতে চায়। রামাদান মাসে দীর্ঘ সময় ধরে দিনের বেলায় হালাল-হারাম সকল খাদ্য-পানীয় বর্জন এবং রাতের বেলায় পরিমিত খাদ্য-পানীয় গ্রহণের মাধ্যমে খাদ্য-পানীয় গ্রহণের বিষয়ে নাফসের মধ্যে রুহের কর্তৃত্ব মেনে নেয়ার অভ্যাস সৃষ্টি করা হয়।
যৌনাচারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা : নাফসের খায়েশাতের অন্যতম আরেকটি হচ্ছে যৌনাচার। মানুষের জৈবিক চাহিদা পূরণ ও মানব বংশ সংরক্ষণের জন্য এটি একটি অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। কিন্তু নাফসের মধ্যে যেহেতু নৈতিকতার বালাই নেই তাই সে যেনতেনভাবে এ চাহিদা পূরণ করতে চায়। আর এজন্যই আজকের বিশ্বের অপরাধ জগতের এক বিরাট অংশ দখল করে আছে অবাধ যৌনাচার। দিনের বেলায় বৈধ যৌনাচার স্বীকৃত। কিন্তু রামাদানে দিনের বেলায় তা নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। যাতে করে দীর্ঘ এক মাসের প্রশিক্ষণের ফলে বাকী এগার মাসে রুহ নাফসকে অন্তত: অবৈধ যৌনাচার থেকে বিরত রাখতে পারে।
আরামপ্রিয়তা/অলসতা বর্জন : প্রকৃতিগতভাবে নাফস পশুবৃত্তিক। আর এ জন্য সে স্বভাবজাতভাবেই আরামপ্রিয়, অলস প্রকৃতির। পরিমিত বিশ্রাম পরবর্তী কাজের জন্য উদ্দীপনা সৃষ্টি করে, তবে অতিরিক্ত অলসতা-আরামপ্রিয়তা দুনিয়ায় যেকোন ভাল কাজ সম্পাদনের ক্ষেত্রে একটি প্রতিবন্ধকতা। এ জন্য মহানবী (সা.) আমাদেরকে এভাবে দোয়া করতে শিখিয়েছেন -“হে আল্লাহ আমি তোমার নিকট আশ্রয় চাইঅক্ষমতা, অলসতা, কাপুরুষতা, বার্ধক্য ও কৃপণতা থেকে (বুখারী-৬৩৬৭, মুসলিম-২৭০৬)।” রামাদান আমাদেরকে এ আরামপ্রিয়তা ও অলসতা বর্জনের শিক্ষা দেয়। চিন্তা করুন ভোর বেলা আরামের ঘুম ত্যাগ করে উঠে সেহরী খেতে হয়। পারলে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তে বলা হয়। ঢুলু ঢুলু চোখে সেহরী শেষ করে যখন নাফস ঘুমাতে চায় তখন রুহ বলে, ঘুমাতে পারবে না মসজিদে গিয়ে ফজরের নামাজ পড়। সারাদিন কষ্ট করে রোজা রেখে ইফতারের পর নাফস যখন একটু আরাম করতে চায় তখন রুহ বলে, উঠো এবং অন্য সময়ের চেয়ে আরও দীর্ঘ নামাজ পড়। অবশেষে সে যখন ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে বিছানায় যায় তখন রুহ বলে, অন্য সময়ের মত ইচ্ছামত ঘুমাতে পারবে না, উঠো সেহরী খাও। এভাবে একদিন নয়, দীর্ঘ এক মাস নাফসকে ট্রেনিং দেয়া হয় যাতে বাকী এগার মাস সে রুহের নির্দেশনা অনুযায়ী আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে নেক কাজ সম্পাদন করতে পারে। আর প্রতি বছরই এ ট্রেনিং দেয়া হয়।
দানশীল নাফস : অর্থলিপ্সুতা ও কৃপণতা নাফসের আরেকটা খায়েশাত। রামাদান আমাদের দানশীল হতে শিখায়। হাদীসে আছে, রাসূল (সা.) সকল মানুষের চেয়ে বেশী দানশীল ছিলেন। আর রমযান মাসে যখন জিবরীল (আ.) তাঁর সাথে সাক্ষাতে মিলিত হতেন তখন তিনি বেগবান বায়ুর চেয়েও বেশী দানশীল হয়ে উঠতেন (বুখারী-৩০৪৮)। এ ছাড়া সাদকাতুল ফিতর আমাদের জন্য ওয়াজিব করে দেয়া হয়েছে। অন্যকে ইফতার করানোর প্রচুর ফজীলত হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এভাবে রামাদান আমাদের অর্থলিপ্সু ও কৃপণ নাফসকে দানশীল নাফসে রুপান্তরে সাহায্য করে।
মুত্তাকী নাফস : রামাদান ফরজের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কুরআনে পাকে বলা হয়েছে –“আশা করা যায় তোমারা (এর মাধ্যমে) তাকওয়া অর্জন করতে পারবে (২: বাকারা: ১৮৩)।” উপরে বর্ণিত পন্থায় এবং এছাড়াও আরও নানাবিধ পন্থায় (কলেবর স্বল্পতার জন্য তার সব এখানে বর্ণনা করা সম্ভব হয়নি) রামাদান আমাদের রুহকে আমাদের নাফসের উপর প্রাধান্য বিস্তারে সাহায্য করে। ক্রমান্বয়ে সে রুহ আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সকল আদেশ মানা ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে দুরে থাকার যোগ্যতা অর্জন করে।ফলে সে রুহ ধীরে ধীরে মুত্তাকী রুহতে পরিণত হয়।
সারাটা রামাদান মাস হচ্ছে তাযকিয়ায়ে নাফসের প্রশিক্ষণ। কিন্তু পরিতাপের বিষয় অন্যান্য ইবাদতের মত রামাদানকেও আমরা একটা আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত করেছি। প্রত্যেক ইবাদত এক বা একাধিক সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে আল্লাহ তায়ালা আমাদের উপর ফরজ করেছেন। আমাদের বিবেচনা করতে হবে, যে ইবাদত যে উদ্দেশ্যে আল্লাহ তায়ালা আমাদের উপর ফরয় করেছেন আমরা তা হাসিল করতে পারছি কিনা। অথবা একটি ইবাদত আমার মাঝে যে অবস্থার সৃষ্টি করতে চায় ঐ ইবাদত সম্পাদনের মাধ্যমে আমার মধ্যে সে অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে কিনা। এটিই হচ্ছে ইহতেসাব। এ জন্যই আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, যে লোক রমযান মাসের রোযা রাখবে ঈমান ও ইহতেসাব সহকারে, তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী গুনাহ মাফ হয়ে যাবে (বুখারি-২০১৪, মুসলিম-১৮১৭)। অর্থাৎ রামাদান আমাদের নাফসের যে পরিমান তাযকিয়া করতে চায় আমরা যদি তা হাসিল করতে পারি তাহলেই আমরা রামাদানের পুরো ফায়দা অর্জন করতে পারবো। এজন্য নবীজী (সা.) অন্য হাদীসে বলেছেন, যে লোক মিথ্যা কথা এবং তদনুযায়ী আমল করা ও মুর্খতা পরিত্যাগ করল না তার খাদ্য ও পানীয় পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই (বুখারী-১৯০৩)। ইসলাম ব্যতীত বাকী সব কথা, কাজই মুর্খতা ও মিথ্যা। সুতরাং সিয়াম সাধনার পর কেউ যদি তার নাফসকে এমন অবস্থায় নিয়ে যেতে না পারে যাতে সে ইসলাম ছাড়া আর বাকী সব মিথ্যা কাজ, কথা, মুর্খতা ত্যাগ করতে পারল তাহলে তার এ সিয়ামে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। এ কথাই পেয়ারা হাবীব (সা.) অন্য হাদীসে বলেছেন এভাবে, এমন বহু রোযাদার রয়েছে যার রোযা ক্ষুধা ও পিপাসায় কষ্ট পাওয়া ছাড়া আর কোন লাভ হয় না। আর নামাজ পড়ুয়াদেরমধ্যেও এমন অনেক রয়েছে যাদের তারাবীহ থেকে বিনিদ্র রাত কাটানো ছাড়া আর কিছুই অর্জিত হয় না(আহমদ -৯০৯১, দারামী-২৭২০)।
আসুন ! আসন্ন রামাদানকে আমরা তাযকিয়ায়ে নাফসের প্রশিক্ষণ হিসেবে নেই। চেষ্টা করি আমাদের মুলহামা নাফসকে লাউয়ামাহ স্তর পেরিয়ে মুৎমাইন্নাহ স্তরে পৌছিয়ে দিতে। আর এর মধ্যই রয়েছে আমাদের সিয়াম সাধনার সার্থকতা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তৌফিক দিন! আমীন!!
লেখক- উপপরিচালক, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, সিলেট।