মহাসড়কের পাশেই থাকবে চালকের বিশ্রামের ব্যবস্থা – প্রধানমন্ত্রী

20
গণভবনে ভিডিও কনফারেন্সিং এর মাধ্যমে বাঁশি বাজিয়ে এবং পতাকা উড়িয়ে পঞ্চগড়-ঢাকা-পঞ্চগড় রুটে নতুন আন্ত:নগর ট্রেন ‘পঞ্চগড় এক্সপ্রেস’ এর উদ্বোধন করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গণভবনে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সম্মানে আয়োজিত ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, আমরা বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, আরও এগিয়ে নেব। দেশের উন্নয়ন কাজ অব্যাহত থাকবে। দেশবাসী আমাদের ওপর আস্থা-বিশ্বাস রেখে ভোট দিয়েছে। যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম সারাদেশে উন্নয়নের মাধ্যমে তা রক্ষা করছি। সড়ক, নৌ, রেল ও বিমান মিলে সব দিক থেকে সারাদেশে যোগাযোগ নেটওয়ার্ক সহজ করাই আমাদের লক্ষ্য। যাতে প্রতিটি অঞ্চলের মানুষ কম সময়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে পারেন।
শনিবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশবাসীর ঈদ উপহার হিসেবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত দ্বিতীয় মেঘনা সেতু এবং দ্বিতীয় গোমতী সেতুর উদ্বোধনকালে তিনি এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে একই সঙ্গে ঈদযাত্রায় স্বস্তি দিতে কোনাবাড়ী ও চন্দ্রা ফ্লাইওভার, কালিয়াকৈর, দেওহাটা, মির্জাপুর ও ঘারিন্দা আন্ডারপাস এবং কড্ডা-১, সাসেক সংযোগ সড়ক প্রকল্পের আওতায় জয়দেবপুর-চন্দ্রা-টাঙ্গাইল-এলেঙ্গা মহাসড়কে বিমাইল সেতু উদ্বোধন করেন। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বাঁশি বাজিয়ে ও সবুজ পতাকা উড়িয়ে ঢাকা-পঞ্চগড় রুটে ‘পঞ্চগড় এক্সপ্রেস’ নামে স্বল্প বিরতির আন্তঃনগর ট্রেনের উদ্বোধন করেন।
এসব বিশাল কর্মযজ্ঞের উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ এখনও ডিজেলচালিত ট্রেন চালিয়ে যাচ্ছে। ঢাকায় মেট্রোরেলের মাধ্যমে দেশের প্রথম বিদ্যুতচালিত ট্রেনের ব্যবহার শুরু হবে। এরপর দূরপাল্লায়ও বিদ্যুতচালিত ট্রেন চালু করা হবে। ঢাকায় যানজটে জনগণ কষ্ট পাচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভাল কিছু পেতে হলে একটু কষ্ট স্বীকার করতে হবে। মেট্রোরেলের কারণে যে জনদুর্ভোগ তার জন্য একটু কষ্ট হবেই। কিন্তু এর সুফল পরে পাওয়া যাবে। এখানে ষোলো স্টেশন থাকবে। এর মাধ্যমে প্রায় ৬০ হাজার মানুষ চলাচল করতে পারবে। মেট্রোরেল নির্মাণ কাজ শেষ হলে ঢাকায় যানজট কমে যাবে বলে জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের লক্ষ্য কাজের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষের উন্নতি করা। এ লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি। জাতির জনকের দেখানো সেই নীতি ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’, ওই পথেই আমরা হাঁটছি। তিনি বলেন, আজ যে সেতুগুলো উদ্বোধন করা হয়েছে, এগুলো দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নসহ আঞ্চলিক সহযোগিতায় বিরাট অবদান রাখবে। যার কাছ থেকে আমরা উন্নয়ন সহযোগিতা পাচ্ছি তার কাছ থেকে আমরা তা গ্রহণ করছি। এর মাধ্যমে সাউথ এশিয়ান ও সাউথ ইস্ট দেশগুলোর সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করতে পারছি। এখন যেসব সেতুর উন্নয়ন করছি, আশা করি ভবিষ্যতে আরও উন্নতি করতে পারব। আমরা সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিয়েছি।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে নানা পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মহাসড়কগুলোতে চালকের বিশ্রামাগারের ব্যবস্থা নেই। আমরা অদূর ভবিষ্যতে চালকদের বিশ্রামের জন্য মহাসড়কের পাশে আলাদা ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। খাওয়া-দাওয়াসহ যে কোন গাড়িচালক যাতে করে একটা নির্দিষ্ট সময় পর বিশ্রাম নিতে পারে। তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই ট্রাফিক আইন সম্পর্কে আমাদের ছেলেমেয়েদের ধারণা দিতে হবে। স্কুলের সামনে যেসব জেব্রাক্রসিং থাকে সেগুলো সম্পর্কে ধারণা নেয়ার জন্য তিনি ছাত্রছাত্রীদের প্রতি আহ্বান জানান।
সড়কে চলাচল বিষয়ে সবার মাঝে গণসচেতনতা সৃষ্টিতে স্কুলজীবন থেকেই ট্রাফিক আইন প্রশিক্ষণে গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার মনে হয় ট্রাফিক রুলের ওপর স্কুলজীবন থেকেই প্রশিক্ষণ দেয়া দরকার। তাহলে সবার মাঝে সচেতনতাটা গড়ে উঠবে।’ তিনি এ সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটির সময় শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিধানে সচেষ্ট হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কলেজ বা বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান, যাতে কোন কোমলমতি শিক্ষার্থী দুর্ঘটনার শিকার না হয়। অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সুস্থ হয়ে দেশে ফেরায় তাকে দোয়া করার জন্য দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি এ সময় তার দল আওয়ামী লীগকে একটি পরিবার বলে উল্লেখ করেন। শেখ হাসিনা বলেন, ‘রাজনৈতিক দল হিসেবে শুধু রাজনীতিই নয়, আমরা একটা পরিবার। ছোটবেলা থেকে দেখেছি- আমার মা-বাবা এবং রাজনৈতিক নেতাদের আমরা একটা পরিবারের মতোই বড় হয়েছি। যখনই কোন সমস্যা হয় সুখ-দুঃখে আমরা সবসময় সাথী হয়েই চলি। এভাবেই এই সংগঠনটা যেন এগিয়ে যেতে পারে সে বিষয়েও আশাবাদ ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত একটি দেশ হিসেবে গড়ে তোলার। তাঁর আদর্শকে ধারণ করে আমরা বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখছি। বাংলাদেশের মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে মুক্তি দেয়ার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমরা সড়ক পথের যে উন্নয়ন করেছি তাতে আগামী ঈদে কাউকে কষ্ট ভোগ করতে হবে না। নির্বিঘ্নে মানুষ যাতায়াত করতে পারবে। এ জন্য জাপান সরকার এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংককে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী। রাস্তা পারাপারের ক্ষেত্রে যাত্রীসাধারণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শুধু গাড়িচালককে দোষ দেবেন না। ট্রাফিক আইন মেনে চলবেন। গাড়িচালক ও পথচারী কেউই যদি ট্রাফিক আইন না মানে তাহলে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদ্যুত উৎপাদনে একসময় দেশে হাহাকার ছিল। আজকে প্রায় ৯৩ ভাগ মানুষকে বিদ্যুত দিতে পারছি। যেসব মেগা প্রকল্প এবং যেসব বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে, তাতে আমাদের বিদ্যুতের কোন অভাব থাকবে না। রেলের প্রতি মানুষের আস্থা বৃদ্ধির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, যত দিন যাচ্ছে রেল আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। মানুষ এখন রেলে বেশি চড়তে চায়। চাহিদা মেটানোর জন্য আমাদের আরও বেশি যাত্রীবাহী কোচ দরকার। কাজেই আরও বেশি কোচ আমাদের কিনতে হবে।
শেখ হাসিনা তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারের সময় গত সাড়ে ১০ বছরের রেলের উন্নয়নের বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরে বলেন, আমরা রেলের উন্নয়নে ব্যাপক কাজ করে যাচ্ছি। আর যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে একটা দেশের আর্থ-সামাজক উন্নতি সম্ভব। আর সেদিকে লক্ষ্য রেখেই রেল, সড়ক, আকাশ, নৌপথ সবদিকেই আমরা দৃষ্টি দিয়েছি এবং উন্নয়ন করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক, লাভজনক নয় বলে বিএনপি সরকারের আমলে পুরো রেল যোগাযোগটাই বন্ধ করে দিতে চেয়েছিল। অনেক ট্রেন ও লাইনগুলো বন্ধ করে দেয়। রেলটাকে সম্পূর্ণভাবে তারা ধ্বংস করতে চেয়েছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর আলাদা মন্ত্রণালয় গড়ে তুলে সার্বিকভাবে রেলকে যোগাযোগ ব্যবস্থার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে ৩ বছরের মধ্যে জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা হরা হয়। সেই হত্যার পরে বাংলাদেশের মানুষের যে অগ্রযাত্রা হওয়ার কথা ছিল বা স্বাধীন জাতি হিসেবে যে মর্যাদা পাওয়ার কথা ছিল বা দেশটা যতটা উন্নত হওয়ার কথা ছিল, সেটি হয়নি। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। তিনি বলেন, ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। আর আওয়ামী লীগ সরকার আসার পরই আমরা বাংলাদেশের মানুষের জীবনে উন্নয়নের ছোঁয়া পৌঁছে দিতে পেরেছি। এজন্য দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা, যে তারা আমাদের ওপর বিশ্বাস ও আস্থা রেখেছেন এবং আমাদের ভোট দিয়ে সেবা করার সুযোগ দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে ঈদের আগাম শুভেচ্ছা জানিয়ে উল্লিখিত উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর উদ্বোধন ঘোষণা করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তৃতায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের উদ্বোধন হওয়া এসব প্রকল্পকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৃষ্টিশীল নেতৃত্বের সফল ফসল হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, এতে এবার ঈদযাত্রায় কিছুটা হলেও স্বস্তি এনে দেবে। নিজের অসুস্থতার কথা তুলে ধরে ওবায়দুল কাদের বলেন, আমি যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল, তখন অনেকে আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমি বেঁচে থাকব এটা অনেকে আশাই করতে পারেননি। আমাকে সুস্থ করে তুলতে মমতাময়ী মায়ের মতো সেই সময় ভূমিকা পালন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এতে তার কাছে ঋণের বোঝা বেড়ে গেল। এর আগে কাঁচপুর, দ্বিতীয় মেঘনা, গোমতী সেতু নির্মাণ প্রকল্প পরিচালক আবু সালেহ মোঃ নুরুজ্জামান জানান, নবনির্মিত কাঁচপুর ব্রিজ ইতোমধ্যেই যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। নতুন দুটি সেতু চালু হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বিশেষ করে ঈদে ঘরমুখো মানুষের যাত্রা কিছুটা হলেও আরামদায়ক হবে।
প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কুমিল্লা, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের উপকারভোগীদের সঙ্গে কথা বলেন। শুরুতেই শুভেচ্ছা বক্তব্যে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত হিরোইয়াসু ইজুমি বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্ক আরও অনেকদূর এগিয়ে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামসহ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ঊর্ধতন কর্মকর্তা, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সংক্ষিপ্ত সূচনা বক্তব্য রাখেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলাম। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব নজিবুর রহমান। ‘পঞ্চগড় এক্সপ্রেস’ উদ্বোধনকালে পঞ্চগড় প্রান্ত থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত ছিলেন রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন।