ওলীউর রহমান
শা’বান মাসের ১৫তম রাত্রি হলো লাইলাতুল বারাত বা শবে বরাত। এ রাতে আল্লাহর বান্দাগণ এবাদত বন্দেগির মাধ্যমে আল্লাহর গযব এবং জাহান্নামের আযাব থেকে মুক্তিও নিস্কৃতি লাভ করতে সক্ষম হয়। এ কারণে এ রাত কে শবে বরাত বা লাইলাতুল বারাত বলা হয়। -তাফসীরে কবীর-২৭,২৮
ইমাম বগভী বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ তায়ালা সারা বছরের তাকদীর সংক্রান্ত বিষয়াদির ফায়সালা শবে বরাতে সম্পন্ন করেন এবং শবে কদরে এসব ফায়সালা সংশ্লিষ্ট ফেরেশতাগণের কাছে সোপর্দ করেন।- মাযহারী
হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন, তুমি কি জান এ রাতে অর্থাৎ শা’বানের ১৫তম রাতে কি হয়? আমি আরয করলাম- ইয়া রাসূলাল্লাহ! বলুন কি হয়। তিনি বললেন, এ রাতে এমন প্রত্যেক শিশুর নাম লিখে দেয়া হয়, যে পরবর্তী বছরে জন্ম গ্রহণ করবে। এছাড়া প্রত্যেক এমন ব্যক্তির নাম লিখে দেয়া হয় যে পরবর্তী বছর ইন্তেকাল করবে। এ রাতে নেক আমল সমূহ উপরে তুলে নেয়া হয় এবং এ রাতে মানুষের রিযিক বিতরণ করা হয়।- মেশকাত শরীফ
শবে বরাত হচ্ছে এমন এক রাত যে রাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অসংখ্য-অগণিত বান্দাদেরকে ক্ষমা করে দেন। হযরত মু’আজ বিন জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহ পাক শা’বান মাসের ১৫তম রজনীতে স্বীয় সৃষ্টিকুলের দিকে তাকিয়ে মুশরিক এবং বিদ্বেষভাবাপন্ন লোক ব্যতিত আপন বান্দাগণকে ক্ষমা করে দেন। -শুআবুল ঈমান ৩/৩৮২, তারগীব তারহীব ২/২৪১
বাইহাকী শরীফের বর্ণনায় আছে যে, কিছু সংখ্যক মানুষকে শবে বরাতেও ক্ষমা করা হয় না। যেমন- ১. মানুষের প্রতি অন্যায় বিদ্বেষ পোষণ কারী, ২.আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী, ৩. লুঙ্গি কিংবা পাজামা টাখনোর নিচে পরিধান কারী, ৪. পিতা-মাতার অবাধ্য ব্যক্তি, ৫. মদ্যপানে অভ্যস্ত ব্যক্তি এবং ৫. অন্যায় খুনী ব্যক্তি।
শবে বরাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষের সমস্যাসমূহকে উল্লেখ করে করে ফজর পর্যন্ত ডাকতে থাকেন। হযরত আলী (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, যখন শা’বানের ১৫তম রাত আসে, তখন তোমরা নামাজে দন্ডায়মান থাকো এবং এর দিনের বেলায় রোযা রাখো। আল্লাহ তায়ালা এ রাতে সূর্যাস্তের সময় থেকেই নিকটতম আকাশের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেন এবং বলেন, কোন ক্ষমা প্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব, কোন রিযিক প্রার্থী আছে কি? আমি তাকে রিযিক দান করব, কোন বিপদগ্রস্ত আছে কি? আমি তাকে বিপদ থেকে মুক্তি দান করব। কেউ অমুক বস্তুর প্রার্থনাকারী আছে কি? কেউ অমুক বস্তুর প্রার্থনাকারী আছে কি? এমনিভাবে আল্লাহ তায়ালা সুবহে সাদিক পর্যন্ত বলতে থাকেন। – ইবনে মাজাহ
শবে বরাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবর জিয়ারত করেছেন বলে হাদীসে উল্লেখ আছে। তবে সেখানে কোন মেলা বসত না, আলোক সজ্জাও করা হত না এবং অনেক মানুষের সমাগম ও সেখানে হতনা। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, এ রাতে আমার নিদ্রাভঙ্গ হলে আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিছানায় পেলাম না, আমি তাঁর তালাশে বের হলাম এবং মদীনার কবরস্থান বাক্বীতে গিয়ে তাঁকে পেয়ে গেলাম। তিনি সেখানে মুসলমান নর-নারীদের জন্য মাগফিরাতের দোয়া করছেন। তিনি আমাকে দেখে বললেন, তুমি কি শংকিত হয়ে পড়েছ যে, আল্লাহও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমার প্রতি অবিচার করবেন? আমি আরয করলাম হ্যাঁ, আমার তাই ধারণা হয়েছিল যে, আপনি অন্য কোন বিবির কাছে চলে গেছেন। তিনি বললেন, আল্লাহ তায়ালা শা’বানের ১৫তম রাতে নিকটতম আকাশের দিকে বিশেষ মনোযোগ দেন এবং কলব গোত্রের ছাগলের চুলের চেয়েও অধিক সংখ্যক মানুষকে মাগফেরাত দান করেন। -তিরমিযি শরীফ
শা’বান মাসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অধিক হারে নফল রোজা রাখতেন। শা’বানের ১৫তম রাত নফল এবাদত যেমন- নফল নামাজ, তাসবীহ পাঠ, দোয়া, কোরআন তেলাওয়াত, দান খয়রাত করা, কবর জিয়ারত ইত্যাদি এবাদতের মাধ্যমে অতিবাহিত করা এবং দিনের বেলা রোযা রাখা সুন্নত। এ রাতে আল্লাহ তায়ালা পরবর্তী বছরে জন্ম গ্রহণকারী এবং মৃত্যুবরণকারীদের সম্পর্কে ফায়সালা করেন এবং এ রাতে মানুষের সৎকর্মসমূহ কবুলিয়াত বা গ্রহণযোগ্যতার স্তরে উন্নীত করা হয় এবং এ রাতে রিযিকবণ্টন করা হয়। অর্থাৎ, সারা বছরে কে কতটুকু রিযিক পাবে তা ফেরেশতাদেরকে জানিয়ে দেয়া হয়। তাই এ রাতে নিতান্ত একাগ্রচিত্তে কাকুতি-মিনতির সাথে নিজের মনের ব্যাথা-বেদনার কথা মহান রবের কাছে পেশ করা, পাপসমূহের জন্য অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাওয়া, ইহকাল-পরকালের কল্যাণ কামনা করা এবং জীবিত-মৃত সকলের জন্য ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে অতিবাহিত করা উচিত।
শবে বরাত সম্পর্কে আমাদের মাঝে কিছু বিভ্রান্তি রয়েছে। শবে বরাত উপলক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের সমাজে কিছু দোয়া-দুরুদ ও কোরআন খানি ইত্যাদির আয়োজন করা হয়। কেউ কেউ এসবের গুরুত্ব দিতে গিয়ে এসবকে অত্যাবশ্যকীয় মনে করেন। আবার কেউ কেউ এসব দোয়া-দুরুদকে বিদআত তথা অগ্রহণযোগ্য এবং নিন্দনীয় মনে করেন। অবশ্য উভয় ধারণাই অগ্রহণযোগ্য। মধ্যপন্থা অবলম্বন করাই শ্রেয়। অর্থাৎ এসব সম্মিলিত দোয়া-দুরুদ ইসলামের আবশ্যকীয় কোন বিধান নয়। আবার এগুলো অনর্থক এবং গর্হিত কোন কাজও না। হয়ত প্রক্রিয়াগত বা পদ্ধতিগত এবং পরিভাষাগত কিছু ভুল-ভ্রান্তি আছে, এসব সংশোধন করে বিতর্ক, বিভ্রান্তি এবং বিদ্বেষ ছড়ানো থেকে বিরত থাকা উচিৎ। আর ইসলামের কোন বিধান বর্ণনার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরী। ইসলামের কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যোগ্য আলেম ছাড়া মন্তব্য করা ঠিক না।
শবে বরাত উপলক্ষে কিছু অশুভ প্রবণতাও মাঝে মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। যেমন, আতশবাজী, শবে বরাতকে কেন্দ্র করে আলোক সজ্জা করা, মসজিদ অথবা বাসগৃহে অতিরিক্ত আলো-বাতি লাগানো, রাস্তার পাশে বা দেয়ালের উপর অথবা গোরস্থানে বাতি জ্বালিয়ে রাখা, পটকা ফোটানো, ফুলঝুরি জ্বালানো ইত্যাদি। এগুলো হচ্ছে অপসংস্কৃতি বা বিজাতীয় সংস্কৃতি। উপমহাদেশের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা আব্দুল হক্ব মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) এ সম্পর্কে বলেন যে, এই আলোকসজ্জা এবং আতশবাজী অগ্নি পুজকদের সংস্কৃতি, পরিতাপের বিষয় হলো যে, মুসলমানরা এই সংস্কৃতিকে গ্রহণ করে নিয়েছে যা স¤পূর্ণ হারাম। -মাসাবাতা বিস সুন্নাহ। সুতরাং এসব থেকে আমাদের বিরত থাকা প্রয়োজন।