কাজিরবাজার ডেস্ক :
ঢাকাসহ সারাদেশে একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। মহানগর থেকে শুরু করে হাইওয়ে, আঞ্চলিক ও ফিডার সড়কেও ঘটছে দুর্ঘটনা। বাড়ছে লাশের সারি। দুর্ঘটনার প্রতিকার নিয়েও আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই। অর্থাৎ দুর্ঘটনা রোধে সরকারের পক্ষ থেকে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয় এর বেশিরভাগই কার্যকর হয় না। এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, মোট পরিবহনের মধ্যে ফিটনেসবিহীন যানের সংখ্যা প্রকৃত অর্থেই কত।
রাষ্ট্রীয় পরিবহন নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) হিসাবে দেখা গেছে, সারাদেশে তালিকাভুক্ত যানবাহনের তিনভাগের একভাগ চলছে রাজধানী ঢাকায়। আর মোট যানবাহনের মধ্যে ৭১ হাজার আছে চলাচলের অযোগ্য। যদিও এসব পরিবহন দিব্যি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে সড়কে চলছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেপরোয়া গাড়ি চালানোর পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ ফিটনেস ছাড়া গাড়ি। বিআরটিএ বলছে, সড়কে নৈরাজ্য থামাতে ঢাকাসহ সারাদেশে অভিযান চলমান। গত এক জানুয়ারি থেকে ১৯ মার্চ পর্যন্ত ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানে সাত হাজার ১২৮টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় জরিমানা আদায় হয়েছে এক কোটি ২৩ লাখ ছাপ্পান্ন হাজার ১০০টাকা। এছাড়া নানা অপরাধে ১৫ চালককে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দেয়ার কথা জানিয়েছে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ।
সড়ক দুর্ঘটনারোধে গঠিত কমিটি ইতোমধ্যে চার স্তরে বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়ে ১১১টি সুপারিশ তৈরি করেছে। খসড়া প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করছে সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খানের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি। এপ্রিলের শুরুতেই সুপারিশ সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়ার কথা রয়েছে। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন করবে টাস্কফোর্স। একটি পৃথক টাস্কফোর্সকে এজন্য দায়িত্ব দেয়া হবে। ট্রাফিক পুলিশ, মহানগর পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ, বিআরটিএ, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে সুপারিশ বাস্তবায়নে দায়িত্ব দেয়ার কথা জানিয়েছেন তারা। তবে আশঙ্কার কথা হলো বিগত দিনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন না হওয়ায় সর্বশেষ কমিটির সুপারিশ টাস্কফোর্সের মাধ্যমে কতটুকু আলোর মুখ দেখবে তাই এখন দেখার বিষয়।
নবায়ন ছাড়া চলছে ৭১ হাজার গাড়ি : বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে এখন রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ৩৮ লাখ। ঢাকা শহরে তালিকাভুক্ত যানবাহন হলো ১৩ লাখ ৯৫ হাজার ৯১৯টি। যার মধ্যে ৩৩ হাজার ৪৭০টি বাস ও ১০ হাজার ৫৯২টি মিনিবাসের রেজিস্ট্রেশন রয়েছে। মোট যানবাহনের প্রায় অর্ধেক হলো মোটরসাইকেল। এর সংখ্যা ৬ লাখ ৩১হাজার ৩৪০। মোট পরিবহনের মধ্যে নবায়ন ছাড়াই ৭১ হাজার ২১৮টি যান এখনও সড়কে চলছে বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআরটিএ।
মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ অনুযায়ী প্রতিবছর গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট নবায়ন করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও বিআরটিএ জানিয়েছে, ২০০৯ সালের জানুয়ারির পর এসব যানবাহনের ফিটনেস সনদ আর নবায়ন করা হয়নি। বিআরটিএর ডেটাবেজে ফিটনেস ছাড়া কত যানবাহন আছে, তা যাচাই করতে গিয়ে ১০ বছর ধরে এসব যানবাহনের ফিটনেস নবায়ন না করার বিষয়টি বেরিয়ে আসে, বলছে সংস্থাটি।
যানবাহনের ফিটনেস সনদ নবায়নের অনুরোধ জানিয়ে গত ১০ ফেব্রুয়ারি বিআরটিএর একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ১০ বছরের বেশি সময় ধরে বেশকিছু যানবাহন তাদের ফিটনেস নবায়ন করছে না। এতে বোঝা যায়, ওই সব যানবাহন হয় ফিটনেস সার্টিফিকেট ছাড়াই চলাচল করছে অথবা ধ্বংস বা চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
এই সব যানবাহন মালিকদের হুঁশিয়ার করে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ফিটনেস ছাড়া চলাচলকারী যানবাহনের আগামী ৩১ মের মধ্যে ফিটনেস নবায়ন করতে হবে। ফিটনেস সার্টিফিকেট নবায়ন অথবা ইতোমধ্যে যানবাহন ধ্বংস করা হয়ে থাকলে যানবাহনের মালিককে সে তথ্য জানানোর অনুরোধও করেছে সংস্থাটি।
তা না করলে এসব যানবাহনের নিবন্ধন বাতিল ও জরিমানার কথাও বলছে যানবাহন নিয়ন্ত্রক সরকারী এ সংস্থা।
জানতে চাইলে, বিআরটিএর পরিচালক (অপারেশন) সিতাংশু শেখর বিশ্বাস বলেন, নোটিস দেয়ার পরও ফিটনেস সনদ নবায়ন না করলে এসব যানবাহনের নিবন্ধন বাতিল করা হবে। তিনি বলেন, তাদের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করব। বকেয়া টাকাপয়সা আদায়ের জন্য তাদের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা করব। যদি এসব যানবাহন ঠিক থাকে তাহলে কাগজপত্র নবায়ন করা উচিত। কোন গাড়ি অফরোড হয়ে গেলে সেটাও আমাদের জানাতে হবে। কিন্তু কেউই আমাদের জানায়নি।
মালিক-শ্রমিকদের সহযোগিতা চায় বিআরটিএ : বিআরটিএ পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী জানান, ১৯ মার্চ বসুন্ধরা এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনার প্রেক্ষিতে সুপ্রভাত পরিবহনের রেজিস্ট্রেশন, রুট পারমিট ও চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স সাময়িকভাবে বাতিল করা হয়েছে। পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা রক্ষার্থে এবং এ ধরনের মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে রুট পারমিট ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলতে না দেয়া, উপযুক্ত ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি না চালানো, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা না করা, বেপরোয়া ও প্রতিযোগিতামূলকভাবে গাড়ি না চালাতে পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের আন্তরিক ও সক্রিয় সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরী। এ সংক্রান্ত সহযোগিতা চেয়ে ইতোমধ্যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, এসব অনিয়ম বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান জোরদার করা হয়েছে।
ফিটনেস ছাড়া যানবাহনের ছড়াছড়ি : বিআরটিএর হিসাবে রাজধানী ঢাকায় ১৪ হাজারের বেশি ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল করছে। সড়কে ফিটনেস ছাড়াই চলাচল করা এসব যানবাহনের তালিকায় রয়েছে তিন হাজার ৭০২টি বাস, দুই হাজার ৭৯৮টি মিনিবাস এবং আট হাজার ৪৮২টি ট্রাক। এছাড়া ১৬ হাজার ৬১৮টি অটোরিক্সা, ছয় হাজার ২১১টি অটোটেম্পো, দুই হাজার ৫৯৬টি ডেলিভারি ভ্যান, দুই হাজার ৪৩৪টি হিউম্যান হলার, তিন হাজার ৩৪টি জিপ, তিন হাজার ৩৬৪টি মাইক্রোবাস, তিন হাজার ২৪৫ পিকআপ, পাঁচ হাজার ৭৯৫টি ব্যক্তিগত গাড়ি, ১২৮টি কার্গো ভ্যান। এছাড়া ৩৪৩টি এ্যাম্বুলেন্স, ৫৮টি কভার্ডভ্যান, ৯৬৬টি বিশেষায়িত যান, ১৮০টি ট্যাঙ্কার, ছয় হাজার ৬২০টি ট্রাক্টর এবং চার হাজার ৬৪৪টি অন্যান্য যানবাহন।
সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, আমরা সব মালিককে বৈধ কাগজপত্র ছাড়া গাড়ি বের না করতে সতর্ক করেছি অনেক আগে থেকেই। অনেকেই বারণ শুনছেন না। তারা নিজের মতো করেই গাড়ি চালানোর চেষ্টা করছেন। আমরা সম্মিলিতভাবে পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফেরাতে কাজ করে যাচ্ছি। আশা করি, নগরবাসী সুফল পাবেন।
জানতে চাইলে নৌ সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, পরিবহন সেক্টরে নৈরাজ্যের জন্য মালিক-শ্রমিক-যাত্রী থেকে শুরু করে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় দায়ী। কেউ ইচ্ছা করলেই দায় এড়াতে পারবে না। তাই সম্মিলিত সিদ্ধান্তে পরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার দাবি জানান তিনি।