কাজিরবাজার ডেস্ক :
একজন পরিচ্ছন্ন, শুদ্ধ মানুষের নাম সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন- ‘জীবন বলে আমি তোমার মরণ তরী বাই’। সেই তরীর যাত্রী হয়ে অজানা-অচেনা এক জগতে পাড়ি দেয়া সৈয়দ আশরাফ শুধু একটি নাম নয়, একটি প্রতিষ্ঠানও বটে। তার জীবনগল্প থেকে যে কেউ রাজনীতি, আদর্শ, সততা ও নৈতিকতার শিক্ষা সহজেই পাঠ করতে পারেন। ছোটবেলায় বাবা-মা, শিক্ষক সবাইকে শেখাতেন ‘এমন জীবন তুমি করিবে গঠন/মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন।’ সততার মূর্ত প্রতীক এই ক্ষণজন্মা রাজনীতিকের অকাল প্রয়াণে সত্যিই আজ দেশের মানুষের চোখে জল। সবাইকে কাঁদাতেই শনিবার সন্ধ্যায় জাতীয় পতাকায় মোড়ানো কফিনে শুয়ে প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরলেন সৈয়দ আশরাফ। বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সন্তান সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বাবার পথেই হেঁটেছেন রাজনীতির দীর্ঘ সময়। অথচ এত সমৃদ্ধময় জীবনগল্পে আত্মঅহমিকার লেশমাত্র ছিল না। বিনয়ী, মৃদুভাষী, সততা, আদর্শিক দৃঢ়তা আর বিচক্ষণতার মধ্য দিয়েই তিনি সকলের আশরাফ ভাই বলে পরিচিতি পান। সকল মহলে অসম্ভব জনপ্রিয় আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে একটু চোখের দেখা দেখতে এবং শ্রদ্ধা জানাতে বিমানবন্দরে শোকার্ত মানুষের ঢল তা আবারও প্রমাণ করেছে।
থাইল্যান্ডের ব্যাঙ্কক থেকে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মরদেহ নিয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মেঘদূত উড়োজাহাজ সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামে। উড়োজাহাজ থেকে নামানোর পর মরদেহ গ্রহণ করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও সৈয়দ আশরাফের ভাই সাফায়েত উল ইসলাম। এ সময় জাতীয় পতাকা ও আওয়ামী লীগের দলীয় পতাকায় তার কফিন মোড়ানো হয়। মরদেহের সঙ্গে তার পরিবারের সদস্যরাও দেশে ফিরেছেন। সেখানে শোকার্ত নেতাকর্মীরা তার কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান এবং রুহের মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাত করেন। বিমানবন্দরে আনুষ্ঠানিকতা শেষে তার মরদেহ পূর্ণ প্রটোকল দিয়ে নেয়া হয় ২১ বেইলী রোডে তার সরকারী বাসভবনে। আজ রবিবার রাষ্ট্রীয় মর্যাায় রণাঙ্গনের এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হবে।
সৈয়দ আশরাফের মরদেহ বিমানবন্দরে পৌঁছলে সেখানে নেমে আসে শোকের ছায়া। রাজনীতির বাতিঘর সৈয়দ আশরাফের মৃত্যু যেন কেউই মেনে নিতে পারেননি। সবার চোখেই ছিল স্বজন হারানোর অশ্রু। এ সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ছাড়াও কেন্দ্রীয় নেতা আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, বেগম মতিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিম, ড. আবদুর রাজ্জাক, রমেশ চন্দ্র সেন, আবদুল মতিন খসরু, মাহবুবউল আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, ডাঃ দীপু মনি, আবদুর রহমান, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, এনামুল হক শামীম, ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান নওফেল, ড. হাছান মাহমুদ, হাবিবুর রহমান সিরাজ, সুজিত রায় নন্দী, দেলোয়ার হোসেন, ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, মন্ত্রী আনিসুল হক, নুরুল ইসলাম নাহিদ, মুজিবুল হক, শাজাহান খান, এডভোকেট কামরুল ইসলাম, সংসদ সদস্য শেখ হেলাল, একেএম রহমতুল্লাহ, সাদেক খান, পংকজ দেবনাথ, আসলামুল হকসহ অগণিত নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। এ সময় সবার চোখেই ছিল বেদনাশ্রু।
বিমানবন্দরে আনুষ্ঠানিকতা শেষে একটি এ্যাম্বুলেন্সে সৈয়দ আশরাফের মরদেহ রাজধানীর বেইলী রোডে সৈয়দ আশরাফের সরকারী বাসভবনে নেয়া হয়। সন্ধ্যা সাতটার দিকে বেইলী রোডের দীর্ঘদিনের সেই পরিচিত বাসায় ফেরেন কফিনে বন্দী হয়ে। সে সময় শোকার্ত মানুষের কান্নায় পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। সেখানে একটি শোক বই খোলা হয়েছে। শোকার্ত মানুষের ঢল থাকায় তার লাশ নামানো সম্ভব হয়নি। দীর্ঘ সময় ধরে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং শ্রেণী-পেশার অজস্র মানুষ বেইলী রোডের বাসভবনে গিয়ে প্রয়াত এ নেতার গাড়িতে থাকা কফিনে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, গণফোরামের মোস্তফা মহসিন মন্টুসহ শীর্ষ সকল নেতাই ছিলেন শোকে মুহ্যমান। পরে তার নিথর দেহ রাখা হয় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) হিমঘরে।
আজ রবিবার সকাল সাড়ে ১০টায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় একাধিকবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে তার বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। এর পর হেলিকপ্টারযোগে মরদেহ তার নির্বাচনী এলাকা কিশোরগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হবে। দুপুর ১২টায় দেশের বৃহত্তম শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে দ্বিতীয় দফা জানাজা এবং দুপুর ২টায় ময়মনসিংহ আঞ্জুমান ঈদগাহ মাঠে তৃতীয় দফা জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এর পর মরদেহ ঢাকায় এনে বাদ আছর বনানী কবরস্থানে সৈয়দ আশরাফকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হবে।