কাজিরবাজার ডেস্ক :
মানব পাচারের সঙ্গে জড়িতরা এখনও ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। ২০১২ সালে মানবপাচার আইন হওয়ার পর থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত ৫ হাজার ৭১৬টি মামলা হয়েছে। কিন্ত এই মামলাগুলোর নিষ্পত্তির হার খুবই সামান্য। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, এসব মামলার অধিকাংশেরই এখন পর্যন্ত বিচার হয়নি। পাচার রোধে যথেষ্ট পদক্ষেপ না নেয়ায় গত কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের মানবপাচার প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে ‘টায়ার-২ ওয়াচ লিস্টে’ রেখেছে। মানবপাচারের দিক থেকে বাংলাদেশের স্থান অনেক উপরে। ব্র্যাকের মাইগ্রেশন বিভাগ এ তথ্য জানিয়েছে। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী গত বছর এক পরিসংখ্যানে বলেছে, প্রতি বছর গড়ে ৫০ হাজার নারী ভারতে পাচার হয়। এত বিপুল সংখ্যক নারী পাচার হয় কি না তা নিয়ে সংশয় থাকলেও প্রতিবছর যে নারী পাচার হচ্ছে তা নিয়ে সংশয় নেই। সম্প্রতি শ্রম অভিবাসনের নামেও পাচার বাড়ছে। বিদেশে কাজের চাহিদা থাকায় অনেক নারী কর্মী বিদেশে গিয়ে শ্রম অভিবাসনের আড়ালে পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ছেন। তিন মাস আগেও সাগরপথ দিয়ে হাজারো মানুষের মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশ বিশ্বজুড়ে খবর হয়েছিল। মিয়ানমার থেকে ২০১৭ সালে ফের বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার বাংলাদেশে প্রবেশ পরিস্থিতিকে আরও উদ্বেগজনক করে তুলেছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গত কয়েক মাসে পাচারকালে অনেক নারী ও শিশুকে উদ্ধারও করেছে। দেশের অভ্যন্তরেও মানবপাচার থেমে নেই। সরকার মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমনে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা (এনপিএ ২০১৮-২০২২) গ্রহণ করেছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানবপাচার বিষয়ক মামলাগুলোর নিষ্পত্তি করতে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন বিভাগের প্রধান শরীফুল হাসান বলেন, বাংলাদেশের মানবপাচার নিয়ে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করা উচিত। পাচারকারীদের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে সমস্যার সমাধান হবে না। ইতোমধ্যে পাচারের জন্য আরেকটি উপসর্গ তৈরি হয়েছে। এটা হচ্ছে শ্রম অধিদফতরের নামে মানবপাচার। এতে পাচারের বৈধতা দেয়া হচ্ছে। পাচারকারীরা আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে যে পরিমাণ মানবপাচার হচ্ছে তা পৃথিবীর অন্য কোন দেশেই নেই। তাই সরকারকে এখনই সতর্ক হওয়া উচিত। এজন্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও শ্রম মন্ত্রণালয় যৌথভাবে বিষয়টি নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন। তা না হলে ভবিষ্যতে অবস্থার আরও অবনতি ঘটতে পারে। সূত্র জানিয়েছে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়া শুরু হয় ২০১৫ সালে। তখন বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল। পাচারকারীরা নবেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়টাকে বেছে নেয়। কারণ এই সময়টাতে সাগর অনেকটা শান্ত। সংঘবদ্ধ মানবপাচারকারীরা মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের সাগরপথে নৌকায় পাচার করেছে। থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া অভিমুখী বিপদসঙ্কুল এই যাত্রায় অনেক সময় ছোট নৌকায় অতিরিক্ত লোক থাকায় সেগুলো সাগরে ডুবে যায় এবং অনেকের মৃত্যু হয়। ২০১৫ সালে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে কয়েক শ’ ছোট বড় গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়। পরে সরকার মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। এক পর্যায়ে পাচার কিছু দিনের জন্য থেমে যায়। ওই সময় অনেক পাচারকারী নৌকাবোঝাই রোহিঙ্গাদের আন্দামান সাগরে ফেলে রেখে পালিয়ে গেছে।
কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠনের কর্মকর্তারা জানিয়েছে, মানবপাচার আসলে কোন দিনই বন্ধ হয়নি। কিছু দিনের জন্য পাচার নিয়ন্ত্রণে ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে এখন আবার নতুন করে মানবপাচার শুরু হয়েছে। এবারও একই পথে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় যাচ্ছে। তারা সাগর থেকে উঠেই বন জঙ্গলে দিনের পর দিন মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। দেশে মানবপাচার রোধে কঠোর আইন থাকলেও পাচারকারীরা আইনের ভয় পাচ্ছে না। বিপদজনক পথে পাচার হতে গিয়ে অনেকে মারা পড়ছেন, আবার অনেকে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। পাচারকারীদের প্রলোভনের শিকার হয়ে বহু মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কারাগারে আটক রয়েছেন। পাচারকারী চক্রের খপ্পর থেকে প্রতিনিয়ত অনেক নিরীহ মানুষ পুলিশের হাতে আটক হয়।