স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায় বঙ্গবন্ধু

62

আশরাফ সিদ্দিকী বিটু

বাঙালি জাতি যখন পাক হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসরদের সঙ্গে প্রাণপণ যুদ্ধে লিপ্ত তখন পাকিস্তানের কারাগারে প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ফাঁসির দণ্ডাদেশ দেয়া হয়। কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সেলের পাশে কবরও খোঁড়া হয়েছিল। কিন্তু কখনই ভেঙ্গে পড়েননি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১-এর ডিসেম্বর মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে লায়ালপুর থেকে মিয়ানওয়ালি জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু প্রিয় নেতার খোঁজ খবর, অবস্থান নিয়ে সকল বাঙালিই ছিল উৎকণ্ঠিত। কেমন আছেন, কোথা আছেন তিনি? সমগ্র বিশ্ব বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তির পক্ষ নেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তির আগ পর্যন্ত কেউ জানত না তিনি জীবিত না মৃত। এই কারণেই সবাই ছিলেন শঙ্কিত। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভুট্টো সারা পৃথিবীর চাপে ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি জানায়, শেখ মুজিবকে বিনা শর্তে মুক্তি দেয়া হবে। ৬ জানুয়ারি আরও জানায়, শেখ মুজিবকে ঢাকায় ফেরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভুট্টো মূলত বিশ্ব নেতৃত্ব ও জনগণের চাপের পরিস্থিতি বুঝে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। ভুট্টো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে রাওয়ালপিন্ডি থেকে সেদিন বিদায় জানিয়েছিলেন। তাঁকে বহনকারী পিআইএ’র বিমানটি ৮ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ৬টায় লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছায়। ভোরে লন্ডনে পৌঁছানোর পর তিনি ক্ল্যারিজে’স হোটেলে বিদেশি সাংবাদিকদের সামনে ইংরেজি বিবৃতি দেন এবং সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের জবার দেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও জনগণের মুক্তির কথা ভেবেছেন। তাঁর জীবনের প্রতিটি ক্ষণই আবর্তিত হয়েছে জনগণের কথা ভেবে, মানুষের মুক্তির জন্যই তিনি সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিলেন। আর সে কারণেই তিনি বাংলার জনগণকে কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা এনে দিতে পেরেছিলেন। ৮ জানুয়ারি রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১০, ডাউনিং স্ট্রিটে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথের সাথে বৈঠক করেন। বঙ্গবন্ধু বৈঠকে বাংলাদেশকে ব্রিটেনের স্বীকৃতি ও তার ব্যক্তিগত সমর্থনের বিষয়টি উল্লেখ করেন।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সকালে ব্রিটিশ এক রাজকীয় বিমানে বঙ্গবন্ধু নয়াদিল্লির পালাম বিমানবন্দরে পৌঁছালে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি এবং প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতাকে স্বাগত জানায়।
স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের সকল দুশ্চিন্তা, উৎকন্ঠা ও অনিশ্চয়তার অবসান ঘটিয়ে ১০ জানুয়ারি আনুমানিক তিনটার দিকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বহনকারী ব্রিটিশ কমেট বিমানটি তেজগাঁও বিমানবন্দর স্পর্শ করে। একুশবার তোপধ্বনি ও লাখ লাখ মানুষের আনন্দ-উল্লাসের মধ্য দিয়ে জাতির পিতাকে বরণ করে নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলার মাটিতে পা রেখেই বঙ্গবন্ধু আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। সকাল থেকেই ঢাকায় উৎসবমুখর পরিবেশ। জাতির পিতার শুভাগমন উপলক্ষে সমগ্র ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় আনন্দের বন্যা বইতে থাকে। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় চলে আসেন। বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘ শেখ মুজিব জিন্দাবাদ’ সেøাগানে সেদিন মুখরিত ছিল ঢাকার আকাশ-বাতাস। জাতীয় পতাকা, নানা ফেস্টুন, ব্যানারে ছেয়ে গিয়েছিল সকল রাস্তা। জনগণ আনন্দে, বিজয়োল্লাসে আত্মহারা। যে প্রকৃত বিজয় আজই। জাতির পিতাকে একনজর দেখার জন্য জনতার স্রোত নেমেছিল রাজপথ জুড়ে। যেন আনন্দ স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণকে। মহানায়কের প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে তৃপ্তির অমিয় বাণী ছুটে চলেছিল মানুষের মনে, প্রকৃতিতে! আর সেজন্যই তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত মাত্র এই পাঁচ কিলোমিটার যেতে বঙ্গবন্ধুর খোলা ট্রাক-বহরের লেগে যায় আড়াই ঘণ্টারও বেশি সময়।
স্বদেশের মাটিতে ফিরেই বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শুরু করেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজ, আত্মনিয়োগ করেন বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড় করানোর কঠিন কর্মে। ১২ জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। মাত্র ১০ মাসের মধ্যে জাতিকে সংবিধান উপহার দেন। মাত্র সাড়ে তিন বছর ছিল তাঁর শাসনকাল। এই অল্প সময়ে তিনি বাংলাদেশকে বিশ্বের স্বীকৃতি এনে দিয়েছিলেন। জাতিসংঘ, ওআইসি, কমনওয়েলথসহ পৃথিবীর ১২৬টি রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। সদ্য স্বাধীন দেশকে শক্ত ভিক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করতে জাতি গঠনসহ সব ধরনের কার্যক্রম শুরু করেছিলেন জাতির পিতা। ১৯৭২ সালে এক জনসভায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেনÑ ‘বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই।’ বঙ্গবন্ধুর সেই বক্তব্যের সত্যতা আজ বাস্তবায়িত হয়েছে। তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্ব কেবল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারই করেনি, বঙ্গবন্ধু স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে আজ অনেক দূর এগিয়েছে। তাঁর নেতৃত্বে আজ তা অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও শোষণমুক্ত সোনার বাংলায় রূপান্তরিত হতে চলেছে। এক সময়ের অন্ধকার গ্রামবাংলা আজ আলোকিত।
আজ ১০ জানুয়ারি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে তাঁকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় স্মরণ করছি। বাংলাদেশ তাঁর আদর্শে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে; প্রতিষ্ঠা হবে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ।
লেখক : মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব।