মহান বিজয় দিবস আজ

57

কাজিরবাজার ডেস্ক :
‘পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে/জ্বলন্ত ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে, নতুন নিশানা উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগি¦দিক/এই বাংলায়/ তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা।’ দেশের প্রয়াত শ্রেষ্ঠ কবি শামসুর রাহমানের এই কবিতা একাত্তর সালের এই দিনে সত্যি হয়ে দেখা দিয়েছিল বাঙালির জাতীয় জীবনে। বাঙালি আঘাত খেয়েছে বারবার, কিন্তু কখনও আহত পাখির মতো আর্তনাদ করেনি, ভেঙ্গে পড়েনি ব্যর্থতার ক্রন্দনে। সমস্ত আঘাত সে বুক পেতে নিয়েছে, সর্বাঙ্গে রুধির মেখে অবিচারের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। সেই ১৯৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, সেটির উদয় ঘটে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরে। বহু শতাব্দীর স্বপ্ন-স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মাধ্যমে। অবর্ণনীয় দুর্যোগে লন্ডভন্ড হওয়া বাংলাদেশের বঞ্চিত ও শোষিত মানুষ রুখে দাঁড়ায় সর্বশক্তি দিয়ে। আত্মবিস্মৃত বাঙালি আত্মপরিচয় অনুসন্ধানে উৎসর্গ করে নিজ ও স্বজনকে। ছিনিয়ে আনে বিজয়, লাল-সবুজ পতাকা সংবলিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।
রক্তনদী পেরিয়ে আসা আনন্দ-বেদনায় মিশ্র মহান বিজয় দিবস আজ। বাঙালী জাতির হাজার বছরের শৌর্যবীর্য এবং বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় দিবস। বিজয়ের গৌরবেরÑ বাঁধভাঙ্গা আনন্দের দিন। একই সঙ্গে লাখো স্বজন হারানোর শোকে ব্যথাতুর-বিহ্বল হওয়ারও দিন। তীব্র শোষণের কুহেলী জাল ভেদ করে একাত্তরের এই দিনটিতে প্রভাতী সূর্যের আলোয় ঝিকিমিকিয়ে উঠেছিল বাংলার শিশির ভেজা মাটি, অবসান হয়েছিল পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর সাড়ে তেইশ বছরের নির্বিচার শোষণ, বঞ্চনা আর নির্যাতনের কালো অধ্যায়। নয় মাসের জঠর-যন্ত্রণা শেষে এদিন জন্ম নেয় একটি নতুন দেশÑ স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। ঝড়ের ভিতরে বিকশিত অটল বৃক্ষের জীবন্ত প্রতীক স্বাধীনতা নামের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ আজও প্রচ- ঝাঁকি দেয় রক্তে, শাণিত করে চেতনা।
তবে এবারের ডিসেম্বর আমাদের জীবনে নতুন তাৎপর্য নিয়ে এসেছে। আগামী ৩০ ডিসেম্বর চ্যালেঞ্জের নির্বাচন। তাই বাঙালী জাতিকে এ মাসেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পথ ধরে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের পক্ষ শক্তিকেই সমর্থন দেবে, নাকি পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের মতোই সেই পরাজিত পাকিস্তানের প্রেতাত্মাদের আবারও ফিরিয়ে এনে দেশকে অন্ধকারের পথে ঠেলে দেবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি পক্ষে ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তুলে পরাজিত শত্রুদের ফের পরাজিত করে জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাস-দুর্নীতিমুক্ত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের পথেই থাকবে কি না, ৩০ ডিসেম্বর গোটা বাঙালী জাতিকে সেই দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এবার অস্ত্র নয়, ভোটের ব্যালটের মাধ্যমে বিজয়ের মাসে আরেকটি বিজয় অর্জনের এক অন্যরকম চ্যালেঞ্জ নিয়েই বাঙালী জাতি আজ উদযাপন করবে মহান বিজয় দিবস।
পূর্বাচলে আজ উদিত যে-সূর্য, প্রতিদিনের হয়েও সে প্রতিদিনের নয়; তার রক্তিমতায় তিরিশ লাখ শহীদের রক্ত আমাদের মনে পড়বে; আকাশ যে-কোমলতায় আজ উদ্ভাসিত, একাত্তরের সম্ভ্রমহারা দশ লাখ মা-বোন-জায়ার ক্রন্দনধুয়া সে-উদ্ভাস। ভোরের যে-রাঙা আলোটি আজ স্পর্শ করেছে ভূমি, স্বদেশের সেই পবিত্র ভূমি ভিজে আছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর রক্তে; আর সেই রক্তস্রোতে মিশে আছে জাতীয় চার নেতার উষ্ণ শোণিত। দেনদরবার নয়, কারও দয়ার দানে নয়, সাগর-সমান রক্তের দামে বাংলাদেশ অর্জন করেছে স্বাধীনতা, রক্ত-সাগর পেরিয়ে বাঙালী জাতি পৌঁছেছে তার বিজয়ের সোনালি তোরণে। বিজয়ের সাতচল্লিশ বছর পূর্তিতে তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ।
৫৫ হাজার বর্গমাইলের এই সবুজ দেশে ৪৭ বছর আগে আজকের এই দিনে উদয় হয়েছিল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সূর্য। সেদিনের সেই সূর্যের আলোয় ছিল নতুন দিনের স্বপ্ন, যে স্বপ্ন অকাতরে প্রাণ দিয়েছিল এ দেশের ৩০ লাখ মানুষ। ৪৭ বছর পরও সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পায়নি, শেষ হয়নি মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রাম। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর কুয়াশায় জড়ানো হালকা শীতের বিকেলে রমনার রেসকোর্স ময়দানে দাম্ভিক পাকিস্তানি সেনারা যে অস্ত্র দিয়ে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে বাঙালীর বুকে, হাতের সেই অস্ত্র পায়ের কাছে নামিয়ে রেখে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর নেতাদের সামনে।
শুধু নির্বাচনের চ্যালেঞ্জই নয়, বাঙালী জাতি এবার এক অন্যরকম স্বস্তিতে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মদিন পালন করবে। বিজয়ের দীর্ঘ সময় পরে হলেও ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং দ-াদেশ কার্যকর হয়েছে। সারা দেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের মানুষের মনে একটা স্বস্তি এসেছে। জাতির কলঙ্ক কিছুটা হলেও মোচন হয়েছে। পাকিস্তান ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে এক অন্যরকম গণজাগরণ ও আবহে এবার বিজয় দিবস পালন করছে গোটা জাতি। এবারের বিজয় দিবস মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মৌলবাদ, জঙ্গীবাদের মিলনস্থল বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে নির্বাচনে পরাজিত করে রাজাকার-জঙ্গীমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন বাস্তবায়নের অঙ্গীকারের পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা নিয়ে এসেছে।
কর্মসূচী : আজ রবিবার প্রত্যুষে ঢাকায় ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে মহান বিজয় দিবসের সূচনা হবে। সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে নামবে কৃতজ্ঞ জনতার ঢল। বীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মহান ত্যাগের কথা স্মরণ করে কৃতজ্ঞ জাতি শহীদ বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করবেন। দেশব্যাপী আজ সকল ভবনের শীর্ষে উড্ডীন থাকবে রক্তস্নাত জাতীয় পতাকা। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণীতে দেশবাসীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
এদিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় মহান বিজয় দিবস-২০১৮ উদযাপনের লক্ষ্যে এবার জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। আজ সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর নেতৃত্বে উপস্থিত বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশী কূটনীতিকবৃন্দ, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের জনগণ পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন।
আজ সরকারী ছুটির দিন। সকল সরকারী, আধাসরকারী, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারী ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনাসমূহ আলোক সজ্জায় সজ্জিত করা হবে। ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপসমূহ জাতীয় পতাকা ও অন্যান্য পতাকায় সজ্জিত করা হবে। ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিভিন্ন বাহিনীর বাদক দল বাদ্য বাজাবেন। দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে আজ সংবাদপত্রসমূহ বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে। এ উপলক্ষে ইলেকট্রনিক মিডিয়াসমূহ মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা প্রচার করছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বাংলাদেশ শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শিশুদের চিত্রাঙ্কন, রচনা ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনের আয়োজন করবে।
এছাড়া মহানগর, জেলা ও উপজেলায় বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ স্মারক ডাক টিকেট প্রকাশ করবে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে দেশের শান্তি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি কামনা করে বিশেষ দোয়া ও উপাসনার আয়োজন করা হবে এবং এতিমখানা, বৃদ্ধাশ্রম, হাসপাতাল, জেলখানা, সরকারী শিশুসদনসহ অনুরূপ প্রতিষ্ঠানসমূহে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হবে। দেশের সব শিশুপার্ক ও জাদুঘরসমূহ বিনা টিকেটে প্রবেশের জন্য উন্মুক্ত রাখা হবে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এবং বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসও দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে অনুরূপ বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করা হবে। এ বছর ঢাকাস্থ জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে সম্মিলিত বাহিনীর কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হবে না, তবে দেশের সকল জেলা ও উপজেলা সদরে কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হবে।