ইসলামে জনসংখ্যা সমস্যা নয়, দেশের সম্পদ

121

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

(পূর্ব প্রকাশের পর)
আল্লাহ তাআলার ইবাদত যেমন ফরজ, ইসলামে জীবিকা উপার্জনকে তেমন ফরজ করা হয়েছে। কুরআন মাজীদে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, এরপর যখন সালাত আদায় শেষ হবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে, আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ করবে এবং আল্লাহর বেশি বেশি যিকর করবে, এতে তোমরা সফল হবে। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, তোমরা উত্তম ও পবিত্র বস্তু আহার করো, যা আমি তোমাদের জীবিকারূপে দিয়েছি এবং কৃতজ্ঞতা আদায় করো আল্লাহর, যদি তোমরা একান্তই তাঁর ইবাদাত করো। ‘আল-কুরআন, ০২ : ১৭২’। আল্লাহর রাসূল (সা.) এ প্রেক্ষাপটেই বলেছেন, হারাম সম্পদে তৈরি গোশত ও রক্ত জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং হারাম সম্পদে তৈরি প্রতি টুকরো গোশত ও প্রতি ফোটা রক্তের জন্যে নরকই যথোপযুক্ত আবাস। ইসলামে কেউ কারো গলগ্রহ হয়ে থাকাকে সমর্থন করা হয়নি। ব্যক্তি নিজে উপার্জন করবে, নিজের আয়ের উপর নির্ভর করবে। অন্য কারো আয়ে ভাগ বসাবে না। রাসূলুল্লাহ (সা.) সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, পবিত্রতম উপার্জন হলো মানুষের নিজের হাতের পরিশ্রম এবং প্রত্যেক বিশুদ্ধ ব্যবসায় (এর উপার্জন)। শ্রমিককে যেন তার প্রাপ্য মজুরির জন্য নিয়োগকর্তার পেছনে ঘুরতে না হয় এবং শ্রমের ন্যায্য মূল্য নিয়ে নিয়োগকর্তা ও শ্রমিকের মধ্যে যেন অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে তা নিশ্চিত করার জন্য আল্লাহর রাসূল (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন, শ্রমিককে তার ঘাম শুকানোর আগেই পারিশ্রমিক পরিশোধ করে দাও।
ইসলাম সাধারণভাবে সকল মানুষকে কর্তব্যপরায়ণ হিসেবে ঘোষণা করেছে। সকলের জন্য অর্পিত কর্তব্য পালন আবশ্যিক করেছে এবং এ ক্ষেত্রে যে কোন অবহেলাকে আল্লাহ তাআলার নিকট জবাবদিহিতার বিষয় বলে সতর্ক করেছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। ইসলামের এ নীতি একান্তভাবে দায়িত্ব সচেতন করে এবং দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করে। এ নীতি মানুষকে এমনভাবে ভাবতে শেখায় যে, কেউ অন্য কারো কবরে যাবে না। কেউ অন্য কারো কাজের জবাবদিহিতা করবে না। সাধারণভাবে কেউ অন্য কারো কাজের সুফল বা দায় ভোগ করবে না। বরং প্রত্যেককে নিজ নিজ কাজের সুফল বা কুফল ভোগ করতে হবে। এ শিক্ষার ফলে মানুষ নিজেকে দায়িত্বশীল, কর্তব্যপরায়ণ হিসেবে গড়ে তোলে। এটি তার ব্যক্তি সত্তার উন্নতি বিধান করে। সাধারণভাবে সকল মানুষকে এভাবে সমান ঘোষণার পর কুরআন ও হাদীসে মানুষের উপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও কর্তৃত্বের জন্য বিশেষ যোগ্যতা অর্জনের তাগিদ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সে ব্যক্তিই সবচেয়ে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে সবেচেয়ে বেশি তাকওয়াবান। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু জানেন, সবকিছুর খবর রাখেন।
দুনিয়া ও আখিরাতের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার্থে আল্লাহ তাআলা বলেন, আল্লাহ তোমাকে যা দিয়েছেন তা দিয়ে আখিরাতের আবাস অনুসন্ধান কর, তবে তোমার দুনিয়ার অংশ ভুলে যেয়ো না। কিয়ামাতের দিন মানুষের মধ্যে প্রথম যার বিচার হবে সে হবে একজন শহীদ। তাকে আল্লাহর দরবারে নিয়ে আসা হবে। আল্লাহ তাকে তাঁর নিআমতসমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। সেও তা সম্মরণ করবে। আল্লাহ তাকে জিজ্ঞাসা করবেন, তুমি দুনিয়াতে এর বিনিময়ে কী কাজ করেছো? সে উত্তর দেবে- আমি তোমার পথে যুদ্ধ করেছি; এমনকি শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়েছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছো। বরং তুমি এ জন্যে যুদ্ধ করেছো যেনো তোমাকে বীরপুরুষ বলা হয়। আর তা তোমাকে বলা হয়েছে। এরপর তার ব্যাপারে ফেরেশতাগণকে আদেশ করা হবে। তারা তাকে উপুড় করে টেনে টেনে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে।
দ্বিতীয়ত যার বিচার হবে সে হবে একজন আলিম। সে নিজে শিক্ষা লাভ করেছে, অপরকে তা শিখিয়েছে এবং কুরআন পড়েছে। তাকে আল্লাহর দরবারে নিয়ে আসা হবে। আল্লাহ তাকে তাঁর নিআমতসমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। সেও তা স্মরণ করবে। আল্লাহ তাকে জিজ্ঞাসা করবেন, তুমি দুনিয়াতে এর বিনিময় কী কাজ করেছো? সে উত্তর দেবে, দুনিয়াতে আমি শিক্ষা লাভ করেছি, অন্যকে শিখিয়েছি এবং তোমার সন্তুষ্টি লাভের জন্য কুরআন মাজীদ তেলাওয়াত করছি। আল্লাহ বলবেন- তুমি মিথ্যা বলছো। বরং তুমি এ জন্যে জ্ঞান অর্জন করেছিলে যেনো তোমাকে জ্ঞানী বলা হয়। কুরআন মাজীদ এ জন্যে তেলাওয়াত করেছি যেনো তোমাকে ক্বারী বলা হয়। আর তোমাকে তা বলা হয়েছে। এরপর তার ব্যাপারে ফেরেশতাগণকে আদেশ করা হবে। তারা তাকে উপুড় করে টেনে টেনে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে।
তৃতীয়ত যার বিচার হবে সে হবে একজন সম্পদশালী ব্যক্তি। আল্লাহ তাকে স্বচ্ছল করেছেন এবং বিপুল সম্পদ দিয়েছেন। তাকে আল্লাহর দরবারে নিয়ে আসা হবে। আল্লাহ তাকে তাঁর নিআমতসমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। সেও তা স্মরণ করবে। আল্লাহ তাকে জিজ্ঞাসা করবেন, তুমি দুনিয়াতে এর বিনিময়ে কী কাজ করেছো? সে উত্তর দেবে, যে পথে খরচ করলে তুমি খুশি হও, সে জাতীয় সব পথেই তোমার সন্তুষ্টির জন্য আশি খরচ করেছি। আল্লাহ বলবেনÑ তুমি মিথ্যা বলছো। বরং তুমিতো এগুলো এ জন্যে করেছো যেনো তোমাকে দানবীর বলা হয়। আর তোমাকে তা বলা হয়েছে। এরপর তার ব্যাপারে ফেরেশতাকে আদেশ করা হবে। তারা তাকে উপুর করে টেনে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে।
ইসলাম যে বিষয়গুলোকে চরিত্রের সুন্দর দিক এবং অবশ্য অর্জনীয় গুণ হিসেবে ঘোষণা করে সেগুলোকে আত্মার গুণ হিসেবে আত্মস্থ করা, নৈতিক বৈশিষ্ট্যের পরিণত করা এবং জীবনাদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা গেলে স্বভাবতই মানুষ সম্পদে পরিণত হবে। যে সম্পদ দুনিয়ায় ব্যক্তির নিজের এবং অপরাপর সকলের কল্যাণ ও মুক্তি নিশ্চিত করবে। কুরআন হচ্ছে মুমিনের গাইড লাইন, জীবন বিধান। এর মধ্যে আল্লাহ তাআলা মানুষের করণীয়-বর্জনীয় সম্পর্কে বিস্তারিত নির্দেশনা দিয়েছেন। সুন্দর চরিত্র গড়ে তোলার জন্য সবার আগে তাই কুরআন অধ্যয়ন করা প্রয়োজন। একজন ব্যক্তি যদি দাবি আদায় করে আল-কুরআন তিলাওয়াত করেন, তাহলে কুরআনই তাকে পথ দেখিয়ে দেবে। আর কুরআন মাজীদের শিক্ষা ব্যক্তির আত্মিক-আচরণিক ও বৈষয়িক উন্নতিতে সন্দেহাতীতভাবে ইতিবাচক প্রভাব রাখতে সক্ষম হবে।
আল-কুরআনের ব্যাখা হলো হাদীস। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা যে কোনো হুকুমের মূলনীতি বর্ণনা করেছেন। হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) সে মূলনীতি বাস্তবায়নের পথনির্দেশ করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে থেকে কোনো কথা বা তত্ত্ব হাদীসের মাধ্যমে পেশ করেননি। আল্লাহ তাআলা বলেছেন। আর তিনি (মুহাম্মাদ সা.) নিজে প্রবৃত্তি থেকে কোনো কথা বলেন না। তাঁর নিকট প্রেরিত ওহী ছাড়া এগুলো আর কিছু নয়। অন্যত্র সকল মানুষকে আল্লাহ তাআলা আদেশ দিয়েছেন। রাসূল তোমাদেরকে যা দেন (অর্থাৎ যা করতে নির্দেশ দেন) তা গ্রহণ করো আর যা থেকে তিনি বিরত থাকতে বলেন, তা থেকে বিরত থাকো। সত্য কথা বলা সুন্দর চরিত্রের শ্রেষ্ঠতম প্রকাশ। সত্যবাদী হওয়া ছাড়া মুমিন হওয়া যায় না। ইসলাম সত্য, বাকী সবকিছু মিথ্যা। এখন কেউ যদি সত্যকে ধারণ করে সে ধারণ করবে ইসলামকে। আর কেউ যদি মিথ্যা বলার অভ্যাস করে, সে অবশ্যই ইসলাম বর্জনকারী হবে। ত্য মানুষকে সততার পথে পরিচালিত করে, আর মিথ্যা পাপের পথে পরিচালিত করে।
সবর বা ধৈর্য ধারণ করা সুন্দর চরিত্রের একটি অনিবার্য দিক। ধৈর্যধারণ ছাড়া সুন্দর চরিত্র সার্থক ও অর্থবহ হয় না। সুন্দর চরিত্রের অধিকারী হতে হলে তাই ধৈর্যের অনুশীলন করতে হবে। কুরআন মাজীদে এসেছে, আল্লাহ তা’আলা ভালোবাসেন ধৈর্যশীলদের। অন্য আয়াতে তিনি বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ আছেন ধৈর্যশীলদের সাথে। ধৈর্যশীল মানুষ নিঃসন্দেহে অনন্য গুণের অধিকারী। মানবকে সম্পদে পরিণত করার অন্যতম মৌলিক এ গুণটি অর্ঝন করা ইসলাম মুমিনের জন্য আবশ্যিক করেছে। আল্লাহ তাআলা মানুষকে অসংখ্য নিআমাত দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলার এ নিআমতসমূহের বিনিময়ে তাঁর আদের্শ পালন করা হলো কৃতজ্ঞা জানানো। আল্লাহ তাআলার আদেশ মেনে চললে মানুষ কোনো খারাপ কাজ করতে পারবে না। ফলে তার চরিত্র সুন্দর হবে। আল্লাহ তাঁর নিআমত আরো অধিকাহারে শোকরকারীকে দান করবেন। যেমন তিনি বলেছেন, যদি তোমরা শোকর করো, তাহলে অবশ্যই আমি তোমাদের নিআমত বাড়িয়ে দেবো।
মানুষের নৈতিক উন্নয়ন অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রকাশ আমানতদারিতা। আমানতদারিতা এক মহান নৈতিক গুণ। এ গুণ মানুষের কাছে মানুষকে বিশ্বাসভাজন ও ভালোবাসার পাত্র করে তোলে। মানুষ অবলীলায় তার কথা শোনে। তার কাছে তাদের সম্পদ এমনকি সম্মান পর্যন্ত আমানত রাখতে দ্বিধাবোধ করে না। ঈমান ও আমানতদারিতা অবিচ্ছেদ্য বিষয়। ওয়াদা এক ধরনের আমানত। কাউকে কথা দিলে তা রাখতে হয়। ওয়াদা করলে তা পালন করতে হয়। আল্লাহ তাআলা ওয়াদালঙ্ঘনকারীকে ভালোবাসেন না। সুন্দর চরিত্রের অধিকারী হওয়ার প্রধান উপায় হলো হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করা। হিংসা, অহঙ্কার, ঘৃণা, নিজেকে বড় এবং অন্যকে নীচ মনে করার হীনমানসিকতা সুন্দর চরিত্রের সম্পূর্ণ বিরোধী বিষয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) হিংসা-অহঙ্কারকে পুণ্য ধ্বংসের কারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমরা হিংসা-বিদ্বেষ থেকে বেঁচে থাকো। কেননা আগুন যেমন কাঠ ভস্মীভূত করে, হিংসা-বিদ্বেষও তেমনি সৎ আমল নষ্ট করে।
মানবসম্পদ ধ্বংসের ক্ষেত্রে ধূমপান ও মাদকাসক্তির কুপ্রভাব অত্যন্ত কার্যকর। ইসলাম তাই ধূমপান ও মাদকাসক্তি ত্যাগের নির্দেশনা দিয়েছে। ধূমপানে অর্থ-সম্পদের অপচয় হয়, ব্যক্তির নিজের ও অন্যের ক্ষতি হয়। অন্যদিকে আল্লাহ তাআলা মাদক সেবনকে সরাসরি হারাম ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদী এবং ভাগ্য নির্ধারক তীর অবশ্যই শয়তানের অপবিত্র ও ঘৃণ্য কাজের অন্তর্ভুক্ত। কাজেই তোমরা তা বর্জন করো, তাহলে তোমরা কল্যাণ লাভ করবে। মানবসম্পদের প্রকৃত উন্নয়ন সাধনের জন্য কথা ও কাজের মিল থাকা আবশ্যক। কারণ কথা ও কাজের বৈপরীত্ব থাকলে মানুষকে প্রকৃত মানুষ বলা চলে না। এমন মানুষকে কেউ ভালোবাসে না। বিশ্বাসও করে না। কথা ও কাজের মিল প্রতিষ্ঠাকে ঈমানে অনিবার্য শত করে দিয়ে ইসলামে মানবসম্পদ উন্নয়নের ঈমানী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
বস্তুত মানুষের প্রকৃত উন্নয়ন, মানবিক ও নৈতিক গুণে বিভূষিত হওয়া, মানুষকে আত্মিক ও বাহ্যিক দিক থেকে সত্যিকার গুণ ও আচরণে সমৃদ্ধ সম্পদে পরিণত করার ক্ষেত্রে আধুনিক বিশ্বে প্রচলিত সকল চেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। সে কারণে তথাকথিত সভ্য সমাজে, অফিসে, দেশে, পরিবারে মানুষের কাছে মানুষের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। মানুষই মানুষের সম্পদ, সম্মান ও জীবনের হুমকিতে পরিণত হচ্ছে। মানুষের আচরণ স্বার্থপরতা, হীনতা ও পাশবিকতায় ভরে ওঠেছে। এ অবস্থা নির্মূল করে মানুষকে সত্যিকারার্থে সম্পদে পরিণত করার জন্য ইসলামী আদর্শ ও শিক্ষার অনুশীলন অনিবার্যÑআলোচ্য নিবন্ধে উপস্থাপিত তথ্য, প্রমাণ ও বিশ্লেষণ এ বিষয়টির অবিসংবাদিত প্রমাণ। এ কারণে মানবসম্পদের চিরস্থায়ী উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য সর্বক্ষেত্রে ইসলামের অনুশীলন অনিবার্য। (সমাপ্ত)