মুসল্লিদের চোখের জলে সিক্ত আরাফাত ময়দান

112

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের ওপর জুলুম নির্যাতনকারীদের আল্লাহর হেদায়েত কামনা করে সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন মসজিদে নববীর ইমাম ড. শেখ হুসেইন বিন আব্দুল আজিজ। সোমবার আরাফাত ময়দানে লাখ লাখ হাজীর উদ্দেশে তিনি বলেছেন, বিশ্বব্যাপী মুসলমানরা আজ নিষ্পেষিত ও নিগৃহীত। এদের রক্ষা করতে হলে মুসলমানদেরই এগিয়ে আসতে হবে। সন্ত্রাস, হিংসা, বিদ্বেষ নয়-কেবল আল্লাহ ও রাসূল (সা.)-এর নির্দেশিত পথেই কেবল শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
এ সময় “লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক-ধ্বনিতে পাপ মুক্তি ও আল্লাহর খাস রহমতের আশায় লাখ লাখ মুসল্লির চোখের জলে সিক্ত হয়েছে আরাফাতের ময়দান। দুই হাত তুলে এক সঙ্গে বিশ লক্ষাধিক ধর্মপ্রাণ মুসলমান ইহকাল ও পরকালের কল্যাণের পাশাপাশি মুসলিম বিশ্বের শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করেছেন।
আগের রাতে মিনার মাঠেও ধূলিঝড়ের শিকার হওয়া লাখ লাখ হজ্বযাত্রী সমবারও বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করেই আরাফাতে পৌঁছেন। আগের দিন রবিবার সৌদি দৈনিক আলআরাবিয়ার খবরে বলা হয়, বাদশাহ সালমান এবার হজের খুতবা পড়ানোর জন্য মনোনীত করেন মসজিদে নববীর ইমাম শেখ হুসেইন বিন আব্দুল আজিজকে। এ খুতবা রেডিও ও টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয় বিশ্বময়।
ইমাম শেখ হুসেইন বিন আব্দুল আজিজ বলেন, দ্বীন ইসলাম আমাদের কাছে আল্লাহর আমানত। সুতরাং যথাযথভাবে এর রক্ষণাবেক্ষণ এবং চর্চা ও পালন আমাদের দায়িত্ব। বিশুদ্ধ ঈমান এবং আমল এ দায়িত্ব¡ আদায়ের প্রথম শর্ত। হযরত মুহম্মদ (সা.) আমাদের সবার রাসূল। তার প্রতি একনিষ্ঠ ভালবাসা ও গভীর বিশ্বাস ইমানের পূর্ব শর্ত। মুসলমান হিসেবে প্রতিটি কাজে আমাদের নীতিবান, ন্যায় পরায়ণ এবং সৎচরিত্রের অধিকারী হতে হবে। মুসলমান হিসেবে আমাদের পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিকসহ সব ক্ষেত্রে শরিয়তই আমাদের প্রধান উৎস। একে কেন্দ্র করেই আমাদের জীবন চালাতে হবে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ভাল কাজে ব্যয় করতে হবে।
দুপুরে খুতবার পর জোহর ও আছরের নামাজ আদায় করেন হাজীরা। তারা সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করে পাঁচ কিলোমিটার দূরের মুজদালিফায় গিয়ে মাগরিব ও এশার নামাজ আদায়ের নিয়তে রওনা হন। রাতে সেখানে অবস্থান করেন খোলা মাঠে। শয়তানকে নিক্ষেপের জন্য প্রয়োজনীয় পাথর সংগ্রহ করেন এখানেই। আজ মঙ্গলবার মুজদালিফায় ফজরের নামাজ আদায় করে হাজীদের কেউ ট্রেনে, কেউ গাড়িতে, কেউ হেঁটে মিনায় যাবেন এবং নিজ নিজ তাঁবুতে ফিরবেন। মিনায় বড় শয়তানের উদ্দেশে সাতটি পাথর মারার পর পশু কোরবানি দিয়ে মাথার চুল ছেঁটে (মাথা ন্যাড়া করে) গোসল করবেন। সেলাইবিহীন দুই টুকরো কাপড় বদল করবেন। এর পর স্বাভাবিক পোশাক পরে মিনা থেকে মক্কায় গিয়ে কাবা শরীফ সাতবার তাওয়াফ করবেন। কাবা শরীফের সামনের দুই পাহাড় সাফা ও মারওয়ায় ‘সাঈ’ (সাতবার দৌড়াবেন) করবেন। সেখান থেকে তাঁরা আবার মিনায় যাবেন। মিনায় আরও এক বা দুই দিন অবস্থান করে হজের অন্য আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করবেন। এর পর আবার মক্কায় ফিরে বিদায়ী তাওয়াফ করবেন। আগে যারা মদীনায় যাননি, তারা বিদায়ী তাওয়াফের পর মদীনায় যাবেন। যারা আগে মদীনায় গেছেন, তারা নিজ নিজ দেশে ফিরবেন।
এবারও ক’টি স্যাটেলাইট চ্যানেল সৌদিয়া টেলিভিশনের কল্যাণে আরাফাতের ময়দান থেকে খুতবা ও দোয়া সরাসরি সম্প্রচার করে। এতে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ কোটি কোটি মানুষ আরাফাতের হজ্বের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান।
জানা যায়, এবার আরাফাতের ময়দানে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে আধুনিক ব্যবস্থাপনায় হজ্বের সামগ্রিক কর্মকা- তদারকি করা হয়েছে। বাংলাদেশের হাজীদের সবাইকে একটি নির্দিষ্ট চিহ্নিত স্থানের খিমায় রাখার আয়োজন করা হয়। সেখান থেকে অনেকেই আখেরি মোনাজাত মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নিজ নিজ স্বজনদের কাছে সরাসরি সম্প্রচার করেছেন। এতে বাংলাদেশে অবস্থান করেও অনেকে মোনাজাতে অংশ নেন বলে জানা যায়। সৌদি হজ্ব মন্ত্রণালয় ও মোয়াচ্ছাসা কার্যালয় সূত্র জানায়, মক্কা, মিনা ও আরাফাতের ময়দানে সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে সব হাজীকে বিনামূল্যে খাবার, বিশুদ্ধ পানিসহ সব সুবিধা দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বেসরকারী সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান হাজীদের নানা উপহার দিচ্ছে।
জানা যায়, পবিত্র হজ্ব পালন করতে গিয়ে এ পর্যন্ত ৪৫ বাংলাদেশীর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের সব হাজী সুস্থ আছেন। হজ্ব মিশনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে হজ্বযাত্রীদের সার্বিক বিষয়ে দেখভাল করা হয়।
উল্লেখ্য হজ্বের তিন ফরজের মধ্যে আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। হিজরী ১০ সালে অর্থাৎ ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে হজ্ব চলাকালীন সময় আরাফাতে অবস্থিত জাবালে রহমত পাহাড়ে দাঁড়িয়ে মুসলমানদের উদ্দেশে হযরত মোহম্মদ (স.) বিদায় হজ্বের ভাষণ দিয়েছিলেন। এটাই ছিল তার জীবনের শেষ ভাষণ। তাই সচরাচর এটিকেই বিদায় খুতবা বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। ইসলামের প্রকৃত মূল্যবোধ অনুযায়ী মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে এ ভাষণেই চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা দেয়া ছিল।
পবিত্র হজ্বকে কেন্দ্র করে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত প্রায় ২০ লক্ষাধিক মুসলমানের নিñিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পবিত্র শহর মক্কা এবং এর আশপাশের ৩০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে নিরাপত্তা বেষ্টনী। মোতায়েন করা হয়েছে ৮০ হাজার নিরাপত্তাকর্মী।
সৌদি আরবের সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী বিশ্বের ১৬৪টি দেশের ২০ লাখের বেশি মুসলমান এবার হজ্ব করছেন, যাদের মধ্যে বাংলাদেশীর সংখ্যা সোয়া এক লাখেরও বেশি।