তরিকুল ইসলাম
১৫ আগষ্ট জাতীয় শোক দিবস। এই দিনটি আমাদের জন্য অত্যন্ত বেদনার। এই দিনে হত্যা করা হয়েছিল স্বাধীন বাংলার স্থপতি, আধুনিক বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টাকে। যার জন্ম না হলে আমরা পেতাম না সবুজের মাঝে লাল পতাকা, আমরা পেতাম না আমাদের জাতীয় সঙ্গীত, আমরা পেতাম না একটি মানচিত্র, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি জাতির রাখাল রাজা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। আজ এই মহান নেতার ৪৩তম শাহাদাত বার্ষিকী। এই দিনটি বাঙালি জাতিকে বিশ্বের কাছে অকৃতজ্ঞ জাতিতে পরিণত করেছে। এই দিনে আরও হত্যা করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে যিনি পিছন থেকে উৎসাহ ও প্রেরণা যোগাতেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে সৃষ্টি সকল আন্দোলন সংগ্রামে বিভিন্নভাবে যিনি পরামর্শ দিতেন। যার ত্যাগ শেখ মুজিবকে জাতির পিতা বানিয়েছে সেই মহীয়সী নারী জাতির পিতার সহধর্মিনী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে। হত্যা করা হয় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বিশিষ্ট ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব জাতির পিতার জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল, মেজো পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ জামাল, শিশুপুত্র শেখ রাসেলকে হত্যা করেছিল। পুত্রবধূ সুলতানা কামাল, রোজী জামাল, একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের, ভগ্নিপতিআব্দুর রব সেরনিয়াবাত, মুক্তিযোদ্ধা ও যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনি, আরজু মনি, শহীদ সেরিনিয়াবাত, শিশু বাবু, কর্নেল জামিল, আরিমা রিন্টু খানসহ আরও অনেককে।
১৫ আগষ্ট হঠাৎ করে ঘটা কোন ঘটনা নয়। দীর্ঘদিনের লালিত লিপ্সা ও পরাজিত পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের সমন্বয়ে সংঘটিত একটি ঘটনা। পাকিস্তান একাত্তর সালের তাদের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে বীর বাঙালিদের দাবাতে পারেনি। যখন দেখল বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির শক্তি। তখন তারা তাদের পুরনো বন্ধু রাজাকারদের দিয়ে ষড়যন্ত্রের শুরু করে। পাকিস্তান চিন্তা করল এবার যদি বঙ্গবন্ধুকে মারা যায় তাহলে আর পাকিস্তানের ওপর দায়ভার যাবে না যাবে বাঙালির ওপর। এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে আরও অনেকে দেশ জড়িত ছিল। বিশেষ করে পাকিস্তান চিন্তা করল এভাবে যদি শেখ মুজিবকে হত্যা করা যায় তাহলে একসঙ্গে দুটি স্বার্থ সিদ্ধি হবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ধ্বংস হয়ে যাবে অপরদিকে আস্তে আস্তে একটি সময় বাংলাদেশে আবার পাকিস্তানের শাসনে চলে আসবে। পাকিস্তানসহ বিদেশী অনেক দেশ মিলে এই ষড়যন্ত্র শুরু করে দেয়। অকৃতজ্ঞ বাঙালি এবং বেইমান রাজাকার সবাই ক্ষমতার লোভে পড়ে যায়। জাতির পিতার অন্যতম ঘনিষ্ঠতা অর্জন করে তারা জাতির পিতার সঙ্গে বেইমানি শুরু করে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা জাতির পিতাকে অনেকবার সেটি হুঁশিয়ার করেছেন কিন্তু জাতির পিতা বলত পাকিস্তানীরা যেখানে আমাকে হত্যা করতে পারেনি আর সেখানে যে বাঙালির জন্য আমি এত কিছু করে দেশ স্বাধীন করেছি তারা আমাকে হত্যা করবে এটা হতে পারে না। জাতির পিতাকে রাষ্ট্রপতির বাসভবন থাকতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তিনি বাংলার জনগণকে অনেক ভালবাসতেন বলে তিনি চিন্তা করতেন বঙ্গভবনে থাকলে সবাই সবসময় দেখা তার সঙ্গে দেখা করতে পারবে না তাই ৩২নং বাড়িতে থাকতেন। জনগণের প্রতি জাতির পিতার এত ভালবাসা যে একদিন কাল হয়ে দাঁড়াবে সেটা তিনি কখনও বুঝতে পারেননি। ঘরের মধ্যে থেকে মোস্তাকরা যে তার সঙ্গে এত বড় বেইমানি করবে সেটা তিনি কখনও কল্পনাও করতে পারেননি। ১৫ আগষ্ট সকালে জাতির পিতার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু সে অনুষ্ঠানে তার আর যাওয়া হলো না।
১৫ আগষ্ট কালরাতে সেনাবাহিনীর কিছু বিপদগামী সদস্য জাতির পিতার ৩২নং বাড়িসহ তার বিভিন্ন আত্মীয় বাড়িতে হামলা করে। ৩২নং বাড়িতে প্রথম যখন গুলি করে সেটি শেখ কামাল শুনতে পেয়ে সেখানে এগিয়ে যায়। শেখ কামাল দেখতে পায় একদল সৈনিক তাদের বাড়িতে হামলা করেছে শেখ কামাল বঙ্গবন্ধুকে সংবাদ দেয়। তারপর শেখ কামাল নিচে নামেন। যাওয়া মাত্রই তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। জাতির পিতা সংবাদ শোনার পর সেনাপ্রধানের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য টেলিফোনে চেষ্টা করে কিন্তু টেলিফোনের লাইন কেটে ফেলায় তিনি যোগাযোগ করতে পারেননি। জাতির পিতা তখন সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলতে থাকে এই তোরা কারা, তোরা কী চাস। তখন কিছু কুলাঙ্গার জাতির পিতাকে গুলি করে হত্যা করে। পরে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবসহ পরিবারের সবাইকে হত্যা করে। সেদিন স্বামী-সন্তানসহ জার্মানিতে থাকার কারণে প্রাণে বেঁচে যান আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
১৫ আগষ্ট বাঙালির জন্য একটি কলঙ্কিত রাত আর এই জঘন্য ঘটনার জন্য আজও পৃথিবীর কাছে বাঙালি একটি অকৃতজ্ঞ ও খুনী জাতি হিসেবে পরিচিত। জার্মানি থেকে ফেরার পথে এয়ারপোর্টে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার পাসপোর্ট দেখে সেখানকার লোকেরা বলেছিল তোমরা বাঙালিরা এত খারাপ যে তোমরা তোমাদের জাতির পিতাকে হত্যা করেছ। কিন্তু সেদিন আমাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রী তাকে বলতে পারেন নেই যে আমরাই সেই জাতির পিতার কন্যা। জাতির পিতাকে হত্যার পর ঘাতকরা এই দেশকে আবারও পাকিস্তানের পরামর্শে পাকিস্তানের একটি রাজ্যে পরিণত করতে থাকে। কিন্তু ১৯৮১ সালে জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যাকে বাংলাদেশ আওয়ামী লিগের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত করে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। তারপর থেকে বাঙালিরা আবার প্রাণ ফিরে পায় এবং আবার বাংলার জনগণ জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা এই দেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য নিজের জীবনবাজি রাখার প্রতিজ্ঞা করেন।
১৯৮১ সালে দেশে ফিরে শেখ হাসিনা সেদিন বলেছিলেন, আমার মা-বাবা-ভাই কেউ আজ বেঁচে নেই কিন্তু আপনাদের মাঝে আমি আমার মা-বাবা-ভাইদের খুঁজে পেয়েছি। এই দেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে প্রয়োজন হলে বাবার মতো আমি আমার জীবন উৎসর্গ করে দেব। সেই থেকে তিনি তার জীবনবাজি রেখে জাতির পিতার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে কাজ করে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনা ১৫ আগষ্ট থেকে শক্তি নিয়ে পিতার স্বপ্নের ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। আজ বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। শেখ হাসিনার স্বপ্ন ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে রূপান্তর করবেন। আজকের পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র, মেট্রোরেল, ফ্লাইওভারসহ সকল প্রকল্প ১৫ আগষ্টের শোক থেকে নেয়া শক্তি। আজকের প্রযুক্তি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ ১৫ আগষ্টের শোক থেকে নেয়া শক্তি।