আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সমন্বয় নেই। অনেক দিন ধরেই এ দশা চলছে। আশির দশকের মাঝামাঝি শিক্ষাক্রম ও শিক্ষার মাধ্যমসংক্রান্ত জটিলতা প্রকট হতে শুরু করে। এখন তা বিশৃঙ্খলায় পরিণত হয়েছে। এর সবচেয়ে বড় কারণ শিক্ষার বেসরকারীকরণ। ওই সময় শহরাঞ্চলে, বিশেষ করে ঢাকায় ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের যাত্রা শুরু হয়, তাদের শিক্ষাক্রম আবার এ দেশীয় নয়। আগেও কিছু প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ার সুযোগ ছিল, তবে তারা একই শিক্ষাক্রম মেনে চলত। স্কুল-কলেজগুলো ছিল সম্পূর্ণ সরকারি অথবা আধা সরকারি; সম্পূর্ণ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ছিল হাতে গোনা। এখন মফস্বলেও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। ক্রমে বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ও মাদরাসার সংখ্যা বাড়ছে; শহরে এখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেরই আধিক্য।
শহরে মধ্যবিত্তের পকেট কেটে বেসরকারি স্কুল-কলেজগুলো চলছে। এসব প্রতিষ্ঠানে দরিদ্র বা নিম্নমধ্যবিত্তের সন্তানের প্রবেশাধিকার নেই। কারণ তাদের মা-বাবার পকেটের আকৃতি এসব প্রতিষ্ঠানের চাহিদার সমানুপাতিক নয়। তাদের ভরসা সরকারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও প্রয়োজনের তুলনায় কম। মফস্বলে বা গ্রামাঞ্চলে শহরের আদলে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালানো সম্ভব নয়। যেসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেখানে গড়ে উঠেছে সেগুলো কোচিং সেন্টারের বেশি কিছু নয়। এসবের বাইরে যে প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে সেগুলো সরকারি না হলেও প্রচলিত অর্থে ‘বেসরকারি’ নয়। স্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সহায়তায়, কিছুসংখ্যক উদ্যোক্তা-শিক্ষকের চেষ্টায় সেগুলো চলে। তাঁরা বেশি সময় এই ‘বেসরকারি’ অবস্থায় থাকতেও চান না। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা প্রায়ই সরকারি সহায়তার দাবিতে রাজপথে নামেন। তাঁদের কাম্য এ সরকারি সহায়তার নাম এমপিও (মান্থলি পে-অর্ডার)। ২০১০ সালের পর থেকে এমপিও প্রদান বন্ধ রয়েছে। সম্প্রতি শিক্ষক-কর্মচারীদের আন্দোলনের মুখে সরকার তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয় আশ্বাস দিয়েছে। তার পরই জারি করা হয়েছে এমপিও নীতিমালা ২০১৮।
নীতিমালা অবশ্যই থাকা উচিত। কিন্তু তার প্রয়োগ সহজ ও যুক্তিসংগত হতে হবে। নীতিমালা যদি এমপিওভুক্তির প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে। সদ্য জারি করা নীতিমালা নিয়ে এ শঙ্কাই করছে শিক্ষক-কর্মচারী মহল। বর্তমানে সরকারের তালিকাভুক্ত নন-এমপিও স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা পাঁচ হাজার ২৪২টি; শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন ৮০ হাজারের বেশি। দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা প্রায় বিনা বেতনে কাজ করছেন। নতুন নীতিমালার কারণে যাঁদের এমপিওভুক্তির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল তাঁরা বিপাকে পড়বেন। শুধু নীতিমালা তৈরি করলেই হয় না, সেটিকে হতে হয় বাস্তবানুগ, না হলে কাজে আসে না। যেসব শিক্ষক-কর্মচারীকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, তাঁরা যেন প্রতারিত না হন, বঞ্চিত না হন। নতুন নীতিমালা অনুসরণ করার সময় বাস্তবতাকে বিবেচনায় নেওয়া হবে বলে আশা করি। জাতির ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সরকারীকরণ বা এমপিওভুক্তিকরণ যৌক্তিক হারে অব্যাহত রাখাই উত্তম।