কাজিরবাজার ডেস্ক :
সবাইকে শোকসাগরে ভাসিয়ে চিরবিদায় নিলেন নেপালে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত ২৬ বাংলাদেশী। সোমবার কফিনবন্দী হয়ে দেশে ফিরলেন ২৩। বাকি তিনজনের পরিচয় শনাক্ত হয়নি। পরিচয় শনাক্ত হওয়ার পর তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। বিকেলে আর্মি স্টেডিয়ামে এদের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। কফিনে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। পরে পরিবারের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়।
এদিকে শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে ২৩ এ্যাম্বুলেন্সে করে ২৩ মরদেহ আর্মি স্টেডিয়ামে নেয়া হয়। মরদেহের সারির প্রথম এ্যাম্বুলেন্সে ছিল পাইলট আবিদ, দ্বিতীয়টিতে কো-পাইলট পৃথুলা রশিদ আর বাকিগুলোতে অন্যদের মরদেহ। সারিবদ্ধভাবে রাস্তা দিয়ে যখন এ্যাম্বুলেন্সগুলো যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল লাশের মিছিল যাচ্ছে। আর সেই মিছিলের পেছনে যাচ্ছিল শোকের মিছিল। বিমানবন্দর থেকে হতাহতদের বাড়ি আর আর্মি স্টেডিয়ামে কান্নার রোল পড়েছিল। স্বজনহারাদের আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে পড়ে।
গত ১২ মার্চ ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের একটি বিমান কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে অবতরণের সময় বিধ্বস্ত হয়। এ ঘটনায় ৪৯ আরোহীর মৃত্যু হয়। নিহতদের মধ্যে চার পাইলট-ক্রুসহ ২৬ বাংলাদেশী রয়েছেন। বাংলাদেশীদের মধ্যে ২৩ জনকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়।
নেপালে প্রথম জানাযা সম্পন্ন : সোমবার সকালে নেপালে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাছে ২৩ বাংলাদেশীর মরদেহ হন্তান্তর করে নেপাল কর্তৃপক্ষ। এরপর দূতাবাসের আঙ্গিনায় কফিনগুলো সারিবদ্ধ করে রাখা হয়। সকাল নয়টায় প্রথম জানাজা হয়। এরপর নাম লেখা কফিনের পাশে স্বজনরা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। সেখানে প্রিয়জনের কথা স্মরণ করে কফিনের ওপর কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তারা। সকাল সোয়া নয়টার দিকে বিমানবন্দরে নেয়ার জন্য গাড়িতে তোলা হয় কফিনগুলো। পরে সেগুলো নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরে নেয়া হয়। সেখানে আগে থেকে অপেক্ষা করছিল বাংলাদেশ বিমানের একটি বিশেষ কার্গো উড়োজাহাজ।
মরদেহ নিয়ে নামল বিমান : সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে সোমবার নেপালের স্থানীয় সময় দুপুর দুটার দিকে লাশবাহী ৬১-২৬৪০ নম্বরের বিশেষ কার্গো বিমানটি দেশটির ত্রিভুবন বিমানবন্দর থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়। এর কিছুক্ষণ আগে নিহতদের স্বজনদের ইউএস-বাংলার একটি বিমানে করে ঢাকায় আনা হয়। বিকেল চারটার দিকে বিশেষ কার্গো বিমানটি হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের ১ নম্বর ভিভিআইপি টার্মিনালে অবতরণ করে।
যেভাবে লাশ এ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয় : কফিনে বন্দী লাশগুলো এক এক করে নামানো হচ্ছিল বিমান থেকে। কফিনের সামনে কাগজের ভেতরে থাকা হতভাগ্যদের নাম-পরিচয় লেখা ছিল। সারিবদ্ধভাবে কফিনগুলো নামানো হয়। সেখানে আগ থেকেই প্রস্তুত রাখা হয়েছিল ২৩ এ্যাম্বুলেন্স। এক এক করে তা এ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয়। প্রতিটি এ্যাম্বুলেন্সের সামনে নিহত ব্যক্তির নাম-পরিচয় লেখা ছিল। এরপর এ্যাম্বুলেন্সগুলো সারিবদ্ধভাবে আর্মি স্টেডিয়ামের উদ্দেশে রওনা হয়। প্রথম এ্যাম্বুলেন্সে ছিল পাইলট আবিদ সুলতানের মরদেহ। আর দ্বিতীয় এ্যাম্বুলেন্সে ছিল কো-পাইলট পৃথুলা রশীদের মরদেহ। এরপর পর্যায়ক্রমে অন্যদের লাশ নিয়ে এ্যাম্বুলেন্সগুলো রওনা হয়। যেন লাশের মিছিল যাচ্ছিল। তাদের পেছনে স্বজনের শোকের মিছিলও যাচ্ছিল। আর রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে থেকে অনেকেই নিহতদের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছিলেন। অনেকেই তখন কাঁদছিলেন।
বিমানবন্দর ও আর্মি স্টেডিয়ামে স্বজনদের অপেক্ষা : সকাল থেকেই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে নিহতদের স্বজনরা অপেক্ষা করতে থাকেন। লাশ আসার সময় যত ঘনিয়ে আসছিল, কান্নার রোল তত বাড়ছিল। বিমান নামার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় গগনবিদারী আর্তনাদ। সেখানকার আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে আসে। পুরো এলাকা শোকে স্তব্ধ হয়ে যায়।
রাস্তায় নিরাপত্তা জোরদার : এদিকে বিমানন্দরসহ আশপাশের এলাকায় আগে থেকেই রাস্তাঘাটের যানবাহন চলাচলের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছিল। তবে নিহতদের স্বজনসহ সংশ্লিষ্টদের যানবাহন চলাচলের বিষয়ে আগাম বার্তা দেয়া হয়েছিল।
সরকার, বিমান বাহিনী ও স্বজনদের তরফ থেকে মরদেহ গ্রহণ : নিহতদের পরিবারের সঙ্গে বিমানবন্দরে মরদেহগুলো গ্রহণ করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, বিমানমন্ত্রী একেএম শাহজাহান কামাল, বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল আবু এসরার, সিভিল এভিয়েশনের প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল নাইম হাসান, এয়ার কমোডর শফিকুল ইসলাম ও মোস্তাফিজুর রহমানসহ উর্ধতন কর্মকর্তারা।
যাদের মরদেহ আসে : বিধস্ত হওয়া বিমানের পাইলট আবিদ সুলতান ও কো-পাইলট পৃথুলা রশিদ, কেবিন ক্রু খাজা হোসেন মোহাম্মদ শফি ও শারমিন আক্তার নাবিলা।
যাত্রীরা হচ্ছেন, হুরুন নাহার বিলকিস বানু, এস এম মাহমুদুর রহমান, সাংবাদিক ফয়সাল আহমেদ, বিলকিস আরা মিতু, নাজিয়া আফরিন চৌধুরী, আখতারা বেগম, রকিবুল হাসান, রফিকুজ্জামান, সানজিদা হক, অনিরুদ্ধ জামান, হাসান ইমাম, তামারা প্রিয়ন্ময়ী, তাহারা তানভীন শশী রেজা, মিনহাজ বিন নাসির, আঁখি মনি, এফ এইচ প্রিয়ক, উম্মে সালামা, মতিউর রহমান ও মোঃ নুরুজ্জামান।
যে তিন জনের মরদেহ শনাক্ত হয়নি : গত রবিবার সন্ধ্যায় কাঠমান্ডুতে বাংলাদেশ দূতাবাসে এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, নিহতদের মধ্যে আলিফউজ্জামান, পিয়াস রায় ও মোহাম্মদ নজরুল ইসলামের মরদেহ এখনও শনাক্ত হয়নি। নেপালে অবস্থানরত বাংলাদেশ চিকিৎসক দলের সদস্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের শিক্ষক সহযোগী ডাঃ সোহেল মাহমুদ জানান, চিহ্ন দেখে বা অন্যভাবে ওই তিনজনকে শনাক্ত করা না গেলে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
আইএসপিআরের বক্তব্য : বিমানবন্দর থেকে মরদেহবাহী কফিনগুলো সরাসরি আর্মি স্টেডিয়ামে নেয়া হয়। সেখানে জানাযা হয়। এরপর সেখান থেকে কফিন পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
আর্মি স্টেডিয়ামে জানাযা : স্টেডিয়ামে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয় লাশগুলো। এরপর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। হাজার হাজার মানুষ অংশ নেন তাতে। লাশ দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন সেখান উপস্থিত থাকা সকলেই। পুরো এলাকায় শোক নেমে আসে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা : আর্মি স্টেডিয়ামে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের পক্ষ থেকে নিহতদের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান তার সামরিক সচিব এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
লাশ হস্তান্তর : জানাযা শেষে এক এক করে মরদেহ হস্তাস্তর করা হয় পরিবারের কাছে। লাশবাহী এ্যাম্বুলেন্সগুলো আস্তে আস্তে সারিবদ্ধভাবে বের হয় স্টেডিয়াম থেকে। তখন আরেক দফায় কান্নার রোল পড়ে যায়। স্বজনদের মরদেহের সঙ্গে যাওয়ার জন্য আলাদা গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়। সেসব গাড়িতে করে স্বজনরা কাঁদতে কাঁদতে লাশের সঙ্গে বিদায় নেন।
জীবিতদের অবস্থা : রবিবার পর্যন্ত আহত ১০ বাংলাদেশীর মধ্যে ৬ জনকে দেশে পাঠানো হয়েছে। তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এরা হচ্ছেন শাহরিন আহমেদ মুমু, মেহেদী হাসান, সাঈদা কামরুন্নাহার স্বর্ণা, আলমুন নাহার অ্যানি, রাশেদ রুবায়েত ও শাহিন ব্যাপারী। বাকি চারজন সিঙ্গাপুর, নেপাল ও ভারতে চিকিৎসাধীন।