কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্কট কাটাতে আসন্ন এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় প্রশ্ন বিতরণ ব্যবস্থায় আনা হচ্ছে বড় ধরনের পরিবর্তন। রাজধানীসহ সারাদেশেই কমিয়ে আনা হয়েছে অভিযুক্ত ও অপ্রয়োজনীয় অর্ধ-শতাধিক পরীক্ষা কেন্দ্র। প্রশ্নপত্র ট্রেজারি থেকে কেন্দ্রে নিয়ে পরীক্ষা শুরু হওয়া পর্যন্ত একজন ম্যাজিস্ট্রেট বা সমমর্যাদার কর্মকর্তা সঙ্গে থাকবেন। ট্রেজারি থেকে কেন্দ্রে প্রশ্ন নেয়ার সময় ব্যবহার করা হবে বিশেষ ধরনের ব্যাগ।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা বলেছেন, আগামী ২ এপ্রিল থেকে ১০ শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা সঙ্কটমুক্ত করতে সব ধরনের উদ্যোগই নেয়া হচ্ছে। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন থেকে কেন্দ্রে পরীক্ষা শুরু পর্যন্ত নজরদারিতে রাখা হবে পুরো প্রক্রিয়া। প্রশ্নপত্র বিতরণে বিশেষভাবে নজর দেয়া হচ্ছে। ট্রেজারি থেকে কেন্দ্রে প্রশ্ন নেয়ার সময় ব্যবহার করা হবে বিশেষ ধরনের ব্যাগ, যেটি পরীক্ষার আগে কেউ চাইলেই খুলতে পারবে না। খুললে সেটি ভাঙ্গা বা ছেঁড়া ছাড়া কোন বিকল্প থাকবে না। কর্মকর্তারা বলছেন, আগে বিতরণের পর প্রশ্নের বান্ডিল খুলে কেউ আবার সিলগালা করলেও বোঝার কোন উপায় ছিল না। শিক্ষা বোর্ডগুলো জানিয়েছে, আগের বছরের তুলনায় সারাদেশে অর্ধশতাধিক পরীক্ষা কেন্দ্র কমানো হয়েছে এবার। যেসব কেন্দ্রের অনেকের বিরুদ্ধেই ছিল নানা অভিযোগ। ফলে কেন্দ্রগুলো নিরাপদ মনে করছিলেন না সংশ্লিষ্টরা। তবে অনেক কেন্দ্র ছিল অপ্রয়োজনীয়। নানা তদ্বির করে কেন্দ্র বহু বছর চালু রাখলেও এবার অপ্রয়োজনীয় কেন্দ্রগুলো বাতিল করা হয়েছে। ঢাকা শহরেই বাতিল করা হয়েছে ছয়টি পরীক্ষা কেন্দ্র।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার জানিয়েছেন, দেশের অনেক কেন্দ্র ছিল অপ্রয়োজনীয়। আমরা এবার এমন অর্ধশতাধিক কেন্দ্র কমিয়ে এনেছি। রাজধানীতেই বাতিল করা হয়েছে ৬টি কেন্দ্র। জানা গেছে, বাতিল হওয়া রাজধানীর কেন্দ্রগুলো হচ্ছে ড. শহীদুল্লাহ কলেজ, লালমাটিয়া মহিলা মহাবিদ্যালয়, ধানম-ির নিউ মডেল ডিগ্রী কলেজ, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট গার্লস পাবলিক কলেজ, আবতাবনগরের ইম্পেরিয়াল কলেজ এবং তেজগাঁও মহিলা কলেজ। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক জানিয়েছেন, দেশের বাতিল হওয়া কেন্দ্রগুলোর কর্তৃপক্ষের অনেকে নিজেরাই চাচ্ছিলেন না তাদের কেন্দ্র থাকুক। ঢাকা মহানগরীতে গত বছর কেন্দ্র ছিল ৫৯টি, এবার কেন্দ্র হবে ৫৩টি।
পরীক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কেন্দ্র কমানোর বাইরেও এবার ট্রেজারি থেকে প্রশ্ন কেন্দ্রে পাঠানোর কাজকে বিশেষভাবে নজরদারির মধ্যে রাখা হবে। এর অংশ হিসেবে জেলা উপজেলার সকল ট্রেজারি থেকেই প্রশ্ন কেন্দ্রে নেয়ার সময় একটি বিশেষ ব্যাগে রাখা হবে। দেশের প্রতিটি কেন্দ্রের জন্য থাকবে এ ব্যাগ। ট্রেজারি অফিসার, পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিষয়টি নিশ্চিত করবে। এ কাজে সারাদেশের প্রতিটি কেন্দ্রের জন্য এ ব্যাগ প্রস্তুত করা হয়েছে। সোমবার ঢাকা জেলা প্রশাসকের অফিসে পরীক্ষা নিয়ে আয়োজিত বৈঠকে ব্যাগের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিভাবে প্রশ্নের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে বৈঠকে।
ওই বৈঠকের অংশগ্রহণকারী কর্মকর্তা ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি না হলেও জানিয়েছেন, এমন ব্যাগের প্রশ্ন ট্রেজারি থেকে কেন্দ্রে নেয়া হবে যেটা চাইলেই খুলে কেউ প্রশ্ন বের করে আবার আটকে রাখতে পারবে না। এমনভাবে আটকে রাখা হবে যেন ছেঁড়া বা ভাঙ্গা ছাড়া কেউ প্রশ্ন বের করতে না পারে। কর্মকর্তারা বলছেন, এতদিন ট্রেজারি থেকে প্রশ্ন কেন্দ্রে পাঠানোর সময় সিলগালা করা হলেও সেটি খুলে আবার নতুন করে সিলগালা করে অপরাধীরা পার চেয়ে যেতে পারতেন। অভিযোগ আছে, এই সময়ে অপরাধীরা প্রশ্ন বের করে মোবাইলে ছবি তুলে আবার প্রশ্ন আটকে রাখত। এখন এমনভাবে ব্যাগে রাখা হবে যেন পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে বান্ডিল কেউ খুললেই ধরা পড়ে। কারণ এখন প্রশ্ন বের করতে হলে ব্যাগ ছিঁড়তে হবে। ছিঁড়লে আর আটকানোর উপায় থাকবে না। ৩০ মিনিট আগে ব্যাগ ছেঁড়া হবে কেন্দ্র সচিবসহ সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে।
এছাড়া প্রশ্নপত্র ট্রেজারি থেকে কেন্দ্রে নিয়ে পরীক্ষা শুরু হওয়া পর্যন্ত একজন ম্যাজিস্ট্রেট বা সমমর্যাদার কর্মকর্তা এবার সঙ্গে থাকবেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সোহরাব হোসাইনের এক বৈঠকে ইতোমধ্যেই এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে ও নকলমুক্ত পরীক্ষা অনুষ্ঠানে সরকারের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বিশেষ সহযোগিতাও চেয়েছেন শিক্ষা সচিব।
শিক্ষা সচিব বলেছেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসমুক্ত পরীক্ষা অনুষ্ঠানে বেশকিছু বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়েছে। সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সচিব পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। প্রশ্নপত্র ট্রেজারি থেকে কেন্দ্রে নিয়ে পরীক্ষা শুরু হওয়া পর্যন্ত একজন ম্যাজিস্ট্রেট বা সমমর্যাদার কর্মকর্তা সঙ্গে থাকবেন। ম্যাজিস্ট্রেটসহ দায়িত্বশীল তিন কর্মকর্তার উপস্থিতি ব্যতীত প্রশ্নপত্রের খামের নিরাপত্তা ট্যাগ খোলা যাবে না। কোন অবস্থাতেই দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করা যাবে না। কোন অসঙ্গতি দেখা দিলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকেই জবাবদিহি করতে হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে সোহরাব হোসাইন আরও বলেন, পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে প্রশ্নপত্রের সেট কোড ঘোষণা করা হবে। কোন অবস্থাতেই এর আগে সেটে কোড ঘোষণা করা যাবে না। প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানো ও নকলমুক্ত পরীক্ষা অনুষ্ঠানে সব বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসককে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে চিঠি দিচ্ছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব। পরীক্ষার আগেই সব বিভাগীয় কমিশনার স্ব স্ব বিভাগের সব জেলা প্রশাসক, ইউএনওসহ পরীক্ষায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিয়ে বিশেষ সভা বসছে। সভায় পরীক্ষা অনুষ্ঠানে যথাযথ দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দিচ্ছেন। একইভাবে সব ইউএনও নিজ নিজ উপজেলার পরীক্ষায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিয়ে বিশেষ বৈঠক করবেন।
সচিব জানান, পরীক্ষার্থীকে আধাঘণ্টা আগে আসন গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এরপর কেউ আসলে কোন অবস্থাতেই কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না। কেন্দ্র সচিব এ বিষয়টি নিশ্চিত করবেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত ছাড়া কেউ কেন্দ্রে প্রবেশ ও কেন্দ্রে মোবাইল ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হবে। একাধিক প্রশ্ন সেট থাকলেও সেট কোড ঘোষণার আগ পর্যন্ত যাতে কোন সেটই কেউ দেখতে না পারে তা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।