॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥
(পূর্ব প্রকাশের পর)
সমাজের সকলের মাঝে সাম্য প্রতিষ্ঠা ঃ রাসূলুল্লাহ (স.) এর আগমনের সময় মানবজাতি বিভিন্ন শ্রেণী ও সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল। এদের কেউ কেউ নিজেদের দেবতার বংশধর মনে করত, আবার কেউ কেউ মনে করত তাদের শরীরে রাজ-রাজাদের রক্তধারা প্রবাহিত। এক কারণে তারা নিজেদেরকে অন্য থেকে শ্রেয় মনে করত। আবার কাউকে মনে করত আল্লাহর মস্তকে থেকে সৃষ্ট। সে জন্য অন্যরা তাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করত। অন্যদিকে কাউকে ভাবত আল্লাহর পদযুগল থেকে সৃষ্ট। এক কারণে তাকে অস্পৃশ্য ও কুলাঙ্গার হিসেবে গণ্য করত। সমাজের প্রভু শ্রেণীদের জন্য তাদের দাস-দাসীদের শাস্তি দেওয়া বা হত্যা করাকে বৈধ মনে করা হত। এ রকম একটি সমাজকে রাসূলুল্লাহ (স.) এমনভাবে পরিবর্তন করেন, যেখানে কোন মানবিক ভেদাভেদ ছিল না। সেখানে তিনি কোন ভাষাগত, দেশগত, শ্রেণিগত, বর্ণগত ও মর্যাদাগত বৈষম্যের চিহ্ন রাখেননি। এ ব্যাপারে তাঁর ঘোষণা ছিল- ওহে মানুষেরা! নিশ্চয় তোমাদের রব এক। তোমাদের পিতা এক। সাবধান! তাক্বওয়া ছাড়া কোন আরবের প্রাধান্য নেই আজমের উপর এবং আজমের উপর এবং আজমেরও প্রাধান্য নেই আরবের উপর। আর কোন লালের প্রাধান্য নেই কালোর উপর এবং কোন কালোর প্রাধান্য নেই লালের উপর। নিশ্চয় আল্লাহর দরবারে তোমাদের মধ্যে সেই সার্বোত্তম যে অধিক মুত্তাকী। সাবধান! আমি কি (রিসালাতের দায়িত্ব) পৌঁছিয়েছি? তাঁরা বললেন: অবশ্যই হে আল্লাহর রাসূল। তখন তিনি বললেন, সুতরাং যে উপস্থিত যে যেন অনুপস্থিতের কাছে পৌঁছে দেয়। রাসূলুল্লাহ (স.) শক্র-মিত্র, সমর্থক বা বিরোধী, মুসলিম বা অমুসলিম সবার সাথে ন্যায় ও ইনসাফপূর্ণ আচরণ করতেন। নিজের নিকট আত্মীয় হলেও কোন রকম পক্ষপাতমূলক বিচার করতেন না। একবার মাখযুম গোত্রের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের জনৈকা মহিলা চুরি করল। উসামাহ (রা.) তার উপর আল্লাহর বিধান কার্যকর না করার সুপারিশ করলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, তুমি কি আল্লাহর নির্ধারিত শাস্তি মওকুফের সুপারিশ করছো? এরপর তিনি দাঁড়ালেন এবং লোকদের উদ্দেশ্য, “হে মানুষেরা তোমাদের পূর্ববর্তীরা এজন্য ধ্বংস হয়ে গেছে যে, যখন তাদের মধ্যে মর্যাদাশীল কেউ চুরি করত তখন তারা তাকে ছেড়ে দিত। আর যখন দুর্বল কেউ চুরি করত তার উপর শাস্তি প্রয়োগ করত। আল্লাহর শপথ! যদি মুহাম্মদের মেয়ে ফাতিমাও চুরি করত আমি অবশ্যই আর হাত কেটে দিতাম। বানু নাযীর যখন বানু কুরাইয়ার কাউকে হত্যা করত তখন অর্ধেক রক্তমূল্য প্রদান করত, আর যখন বানু কুরাইযা যখন বানু নাযীরের কাউকে হত্যা করত তখন তাদেরকে পূর্ণ রক্তমূল্য পরিশোধ করতে হত। কিন্তু যখন আল-কুরআনের এই আয়াত নাযিল হলো- আর তারা যদি কখনো (কোন বিচার নিয়ে) তোমরা কাছে আসে তাহলে তুমি (চাইলে) তাদের বিচার করতে পারো কিংবা তাদের উপেক্ষা করো। যদি তুমি তাদের উপেক্ষা করো, তা হলে (নিশ্চিত থাকো), তারা তোমরা কোনই অনিষ্ট করতে পারবে না। তবে যদি তুমি তাদের বিচার-ফায়সালা করতে চাও, তাহলে অবশ্যই ইনসাফ সহকারে বিচার করবে। নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফকারীদের পছন্দ করেন। তখন রাসূলুল্লাহ (স.) তাদের মধ্যে সমান রক্তপণ ধার্য করেন। পৃথিবীর কোন বিচারক রাসূলুল্লাহ (স.) -এর মত ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি। সত্য ও ন্যায়ের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন একমাত্র তিনিই তাঁর প্রতিষ্ঠিত সমাজে করে দেখিয়েছেন।
সম্পদের সুষম বন্টনব্যবস্থা প্রবর্তন ঃ রাসূলুল্লাহ (স.) এর সামাজিক ন্যায়বিচারের অন্যতম দিক ছিল ধন-সম্পদের সুষম বন্টনব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এ লক্ষ্যে তিনি বৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদে পূর্ণ ব্যক্তিগত মালিকনার স্বীকৃতি দেন। সাথে সাথে মুসলিম সম্পদশালীদের যাকাত প্রদান বাধ্যতামূলক করেন এবং তা অনাদায়ে শাস্তির নির্দেশ দেন। এছাড়া অমুসলিমদের ওপর জিয়ইয়া ধার্য করেন। এর পাশাপাশি ধন-সম্পদ যাতে কারো হাতে কুক্ষিগত হয়ে না থাকে সে জন্য তিনি মানুষদের ধন-সম্পদ দান করতে উৎসাহ দেন। সমাজের কল্যাণের স্বার্থে এবং সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে আল্লাহর সন্তষ্টির জন্য অকাতরে দান করতে অনুপ্রেরণা দান করেন। তিনি নিজেও কোন সম্পদ নিজের কাছে সংরক্ষণ করে রাখতেন না। এ ব্যাপারে আবু যার আল-গিফারী (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসটি উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন, একবার আমি রাসূলুল্লাহ (স.) এর সাথে মদীনার কঙ্করময় প্রান্তরে হেঁটে চলছিলাম। ইতোমধ্যে উহুদ আমাদের সামনে পড়ল। তখন তিনি বললেন, হে আবু যার! আমি বললাম, লাব্বাইক, ইয়া রাসূলুল্লাহ! তিনি বললেন, আমার নিকট এ উহুদ পরিমাণ সোনা হোক আর তা ঋণ পরিশোধ করার উদ্দেশ্যে রেখে দেওয়া ব্যতীত একটি দীনার ও তা থেকে আমার কাছে জমা থাকুক আর এ অবস্থায় তিন দিন অতিবাহিত হোক, তা আমাকে আনন্দিত করবে না। তবে যদি তা আমি আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে এভাবে তাকে ডানদিকে, বামদিকে ও পেছনের দিকে বিতরণ করে দেই তা স্বতন্ত্র। এরপর তিনি চললেন। কিছুক্ষণ পর আবার বললেন, জেনে রেখো, প্রাচর্যের অধিকারীই কিয়ামতের দিন স্বল্পাধিকারী হবে। অবশ্যই যারা এভাবে, এভাবে, এভাবে ডানে ও পেছনে ব্যয় করবে, তারা এর ব্যতিক্রম। তবে এ জাতীয় লোক অতি অল্পই। এমনকি বেশি মুনাফা করার আশায় মানুষের দৈনন্দিন জীবনের দ্রব্য সামগ্রী আটকে রাখাকে তিনি অবৈধ ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি খাদ্যদ্রব্য আটকিয়ে রাখল সে পাপী ও অপরাধী।
জীবন, সম্পদ ও সম্মানের নিরাপত্তা এবং মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করা ঃ রাসূলুল্লাহ (স.) তার প্রতিষ্ঠিত সমাজে সকলের জীবন, সম্পদ ও সম্মানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। অপরের ধন সম্পদ জবর দখল, আত্মসাৎ ও লুন্ঠন করাকে তীব্র ভাষায় ভর্ৎসনা করেন। এটাকে অবৈধ বলে ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, যে অন্যায়ভাবে অপরের জমির এক বিঘত পরিমাণ অংশও জবর দখল করবে, তার গলায় সপ্ত যমীনের হার ঝুলিয়ে দেয়া হবে। তিনি আরো বলেন, যে কোন মুসলমানের অধিকার কেড়ে নিবে আল্লাহ তার জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব করে দিবেন এবং জান্নাত হারাম করে দিবেন। তিনি কঠোর ভাষায় বলেন, প্রত্যেকে মুসলিমের জন্য অপর মুসলমানের রক্ত, ধন-সম্পদ ও মান-সম্মানের উপর অন্যায় হস্তক্ষেপ হারাম। এ কারণে অন্যের অধিকার আদায়ের বেলায় কোন রকম শৈথিল্য প্রদর্শন করতে নিষেধ করা হয়েছে। প্রত্যেকে অপরের অধিকারের ব্যাপারে পূর্ণ সচেতন থাকবে। উচু-নীচু, ধনী-গরীব, শ্রমিক-মজুরসহ সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের নিজ নিজ হকের ব্যাপারে যদি প্রত্যেক নজর রাখে তাহলে এক শান্তিময়, সৌহার্দ্যপূর্ণ সামাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব। আল্লাহর রাসূল (স.) বলেন আল্লাহ বলেছেন : কিয়ামতের দিনে আমি নিজ তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হব। যে ব্যক্তি আমার নামে ওয়াদা ও চুক্তি করে তা ভঙ্গ করেছে, যে ব্যক্তি স্বাধীন মানুষ বিক্রি করে তার মূল্য ভোগ করেছে এবং যে ব্যক্তি কাউকে মজুর নিয়োগ করে সম্পূর্ণ কাজ আদায় করে নিয়েছে, কিন্তু তাকে মজুরী প্রদান করেনি। রাসূলুল্লাহ (স.) তাঁর সমাজে সকলের পূর্ণ মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করেন। তিনি ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, সাদা-কালো নির্বিশেষে প্রত্যেককে তার মর্যাদা অনুযায়ী মূল্যায়ন করতেন। কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করে কোন কথা বলতেন না এবং কেউ সেটা করলে তা অপছন্দ করতেন। এমনকি তিনি নিজের সম্পর্কে বলেন, আমাকে তোমরা সে রকম উচ্চ প্রশংসা করো না, যেমনটি খ্রিস্টানরা ঈসা ইব্ন র্মাইয়ামকে করেছিল। আমি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। “যুদ্ধবন্দী শক্রদেরকেও তিনি ন্যায়সঙ্গত মানবিক মর্যাদাদানের নির্দেশ দেন। অন্যায়ভাবে তাদের হত্যা করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেন। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি যিম্মীদের কাউকে হত্যা করল সে জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না। অথচ চল্লিশ বছরের রাস্তার দূরত্ব থেকে জান্নাতের সুঘ্রাণও অবশ্যই পাওয়া যাবে। এছাড়া আল্লাহর রাসূল (স.) স্বয়ং সব সময় ভয়ে থাকতেন যে, কাউকে জুলুম করে বসেন কিনা। একবার এক মুনাফিক রাসূলুল্লাহ (স.) ন্যায়বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুললে তিনি জবাবে বলেন, ‘আমি যদি আল্লাহর অবাধ্য হই তবে কে তাঁর আনুগত্য করবে? (অসমাপ্ত)