আল-আমিন
মহান বিজয় দিবস। ৪৬ বছর আগে এই দিনে ৩০ লাখ তাজা প্রাণের বিনিময়ে পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে লাল-সবুজ পতাকার আশ্রয়স্থল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের যেমন অর্জন রয়েছে তেমনি রয়েছে ব্যর্থতা। এরপরও সব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এখন অপার সম্ভাবনাময় একটি দেশ। বিশ্বের বুকে এ কথা বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। বাংলাদেশও সেই সম্ভাবনাটুকু কাজে লাগাতে যথোপযুক্তভাবে চেষ্টা করছে। যদিও অশিক্ষা, দুর্নীতি, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, জঙ্গিবাদসহ নানা সমস্যার ফলে কাক্সিক্ষত উন্নতি হয়নি আমাদের প্রিয় এ মাতৃভূমির। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রচেষ্টা, নারীর অধিকার সংরক্ষণ, মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ এবং দেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলাসহ সংসদীয় গণতন্ত্রের বিকাশ ও প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করার মধ্য দিয়েই আমরা আমাদের কাংখিত স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারব। দুর্নীতির মূল উৎখাত করে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশ সে পথে এগিয়েছে বহুদূর। এদেশে জঙ্গিবাদ তথা স্বাধীনতাবিরোধী চক্র প্রতিনিয়ত দেশবিরোধী কর্মকান্ডে যুক্ত থাকলেও এদেশের শান্তিকামী জনগণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে তা প্রতিনিয়ত প্রতিহত করে আসছে। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর যে স্বপ্ন দেখেছিল তা সময়ের আগেই বাস্তবে রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশ। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও এদেশের অর্থনীতির বিকাশ ক্রমবর্ধমান। গণতান্ত্রিক সরকার দেশ পরিচালনা করছে। রোগ-ব্যাধির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে মানুষের গড় আয়ুও বেড়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর পদাচারণা বৃদ্ধি পেয়েছে। সাক্ষরতার হার বেড়েছে, ৬৫ হাজারের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ হয়েছে, দরিদ্রতা হ্রাস পেয়েছে, স্থায়ী হয়েছে বহুদলীয় ব্যবস্থা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার মাধ্যমে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, গণমাধ্যমগুলো স্বাধীনভাবে সংবাদ পরিবেশন করছে, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ করা হয়েছে। এসব আমাদের বিজয়ের সাফল্য। আজকের এই বিজয় জাতিকে নতুন ভাবে বাঁচতে শেখায়, অত্যাচার ও শোষণের জবাব দিতে সাহস জোগায়, অধিকার আদায়ে আত্মসচেতন হতে শিক্ষা দেয়। এই বিজয় মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির এক বড় প্রাপ্তি। মুক্তিযুদ্ধ না হলে আমরা স্বাধীনতা পেতাম না, পালন করতে পারতাম না বিজয় দিবস।
বর্তমান প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। তারপরও ’৭১-এর সেই ভয়াল দিনগুলোর ইতিহাসকে লালন করে।আমরা বিশ্বাস করি, দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধে বহু ত্যাগের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের সূর্য ছিনিয়ে এনেছে বীর বাঙালির সন্তানেরা। বাঙালি জাতির বহু আকাংখিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ সম্পন্ন হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদেরকে ফাঁসিতে ঝোলানো বাঙালি জাতির জন্য এক বড় প্রাপ্তি। আমরা আশা করব, অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় কার্যকর করে বাংলাদেশ কলঙ্ক মোচনে আরও একধাপ এগিয়ে যাবে।
২.
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাড়ে চার দশকে এখনো পাকিস্তানিরা বাংলাদেশকে নিয়ে চক্রান্ত করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে প্রেতাত্মাদেরকে উস্কানি দিয়ে ষড়যন্ত্রের চক্রান্ত করছে। তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে চক্রান্তে এখনো সক্রিয়। সেই চক্রান্তের জাল ছিঁড়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে এবং বাংলাদেশকে উন্নয়নের মডেল হিসেবে রূপান্তর করছে এটা আমাদের জন্য সৌভাগ্য। পঁচাত্তরের পরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রথমবার যখন ক্ষমতায় আসে তখন পর্যাপ্ত সময় না পাওয়ায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারে নি। এবার দীর্ঘমেয়াদে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের হাতে সেই সুযোগ এসেছে। আমরা আশা করব এই বাংলার মাটিতে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি আর কোনোদিন মাথা তুলে যেন দাঁড়াতে না পারে সেজন্য সরকারের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে।
বিশেষ করে জননেত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে ইহাতে বাংলার ইতিহাস থেকে নতুন কলঙ্ক মোচন হওয়ার পথে। তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে পারছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে চলেছে। এই অর্জনগুলো আমাদের ভবিষ্যতের পথ চলার পাথেয়।
বাংলাদেশ এখন স্বনির্ভর হয়ে উঠছে। বেকার যুবকরা যুব উন্নয়নে প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন উদ্যোক্তা হয়ে নিজের বেকারত্ব দুর করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে। কৃষি, স্বাস্থ্য, রাজনীতি, সংস্কৃতিসহ সবক্ষেত্রে নিজেরাই নিজেদের ছাড়িয়ে যাওয়ার স্বাধীনতার সুফল ভোগ করছে।
বাংলাদেশ যে স্বপ্নের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেই স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিরা দেশকে ভিন্ন পথে প্রবাহিত করতে চেয়েছিল। কিন্তু ইতিহাস তার সঠিক ধারায় ফিরে এসেছে। বিশ্বের বুকে বাঙালি জাতি তার স্বকীয়তা ধরে রেখে এগিয়ে চলেছে।
৩.
বিজয় দিবসের আনন্দ অন্য কোনো আনন্দের সঙ্গে মেলানো যায় না। এই দিনে নতুন একটি দেশ পাওয়ার আনন্দ সত্যিই গর্ব করার। এক ধরনের অস্বাভাবিক সাহসিকতায় আমাদের বীর যোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করেছেন। বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে মাতৃভূমিকে পবিত্র রেখেছেন। তাদের সেই সাহসিকতার অনন্য অর্জন আমাদের কে শিহরিত করে। তরুণ প্রজন্ম আবেগ আপ্লুত হয়। নিজের মধ্যে শক্তি খুঁজে পায়।
আমাদের সেই বীরের জাতি,দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে নিজের অধিকার আদায় করেছে। দেশকে শত্র“মুক্ত করেছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনবদ্য অবদানের কারণে এবং নেতৃত্বেই সম্ভব হয়েছে। এখন তার রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজের হাল ধরেছেন তার কন্যা শেখ হাসিনা। এই বিজয় দিবসের লাল-সবুজের পতাকাটা নতুনভাবে ভাবায় নতুন প্রজন্মকে। মনে করিয়ে দেয় এই দিনে পতাকাটা তার নতুন প্রাণ ফিরে পেয়েছে তখন এক ধরনের শক্তি পাই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত করে। এই লাল সবুজের পতাকাটাও পতপত করে বাতাসে উড়ে ঘোষণা দেয় আজ আমার আনন্দের দিন। তখন বিজয়ের আনন্দের মাত্রা বেড়ে যায়।
৪.
তথ্যপ্রযুক্তির নতুন দুনিয়ায় অনেক পরিবর্তন হচ্ছে।তেমনি আমাদের বিজয় দিবস আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। কৈশোর থেকে তারুণ্যে রূপান্তরের বয়সে ইতিহাস বিকৃতির যে সংস্কৃতি শুরু হয়েছিল তা বদলাতে শুরু করেছে। তরুণ প্রজন্ম প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারছে। এটা আমাদের জাতীয় জীবনে অনেক বড় পাওনা। যদিও ইতিহাস তার সত্য কক্ষপথ কখনও ত্যাগ করে না।
১৯৭৫ থেকে শুরু করে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২১ বছর ধরে বাংলাদেশের ইতিহাস বিকৃতির এক মহাযজ্ঞ সাধিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূ-লুণ্ঠিত করা, গণতন্ত্রকে রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত করা, যুদ্ধাপরাধীদের এদেশে পুনর্বাসন করা সহ তাদের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত বানিয়ে সকল প্রকার অপকর্ম সাধন করা হয়। ’৭৫ সালে যখন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয় তখন বিশ্ববিবেক হতভম্ব হয়ে ধিক্কার দিয়েছিল এই বাঙালি জাতিকে।
এরপর বহু চড়াই-উৎরাই পার হয়ে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় এসে সরকার গঠন করে। কিন্তু এত কিছুর পরও খুনিরা তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করতে পারেনি। তরুণ প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস জেনেছিল। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের কাজ শুরু করে। বিভিন্ন দেশে পালিয়ে থাকা খুনিদের ইন্টারপোলের মাধ্যমে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। যদিও ২০০১ সাল থেকে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে উড়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। ২০০৪ সালের নির্বাচনে প্রায় ২ কোটি তরুণ ভোটার যুদ্ধাপরাধীদের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধান প্রতিশ্রুতি ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় এনে তাদের বিচার করা। আর এই ইস্যুতে আওয়ামী লীগকে সবচেয়ে বেশি সমর্থন দিয়েছিল তরুণ প্রজন্ম। এরপর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরু হয়। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লাকে যেদিন ফাঁসির আদেশ না দিয়ে আদালত যাবজ্জীবন কারাদন্ডের আদেশ প্রদান করে সেদিন প্রথম ফুঁসে উঠেছিল তরুণ প্রজন্ম।তরুণ প্রজন্মরাই সেদিন কসাই কাদেরের ফাঁসির দাবিতে সারাদেশকে একাট্টা করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বুকে ধারণ করেই নিজেদের উজ্জীবিত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আগামীর বাংলাদেশ গড়ার রূপকল্পে তরুণ প্রজন্ম অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এটা নিঃসন্দেহ প্রমাণিত হয়েছে।
৫.
প্রজন্মের চোখে মুক্তিযুদ্ধ বিজয়, মুক্তিযুদ্ধ মানে ৭ মার্চের উত্তাল ময়দানে বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ। “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” সেই ঐতিহাসিক ভাষণ ইউনেস্কো পৃথিবীর সেরা ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ তৎকালীন নিরস্ত্র বাঙালির মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির জন্য রক্তদানের সাহস, পাকিস্তানের শোষণের প্রতিবাদে বাঙালির স্বাধিকারের আন্দোলন এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করে স্বাধীনতাকে অর্জন করার প্রেরণা। মহান মুক্তিযুদ্ধ একাত্তর আর বিজয় বীর বাঙালির এক অনন্য ইতিহাসও। বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর এক বীরত্বগাঁথা কাহিনি এই ভাষনের মাধ্যেমেই অর্জিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ত্রিশ লক্ষ প্রাণ নিবেদন করেছিল একটি স্বাধীন মানচিত্র বিশ্ব ভূ-খন্ড অঙ্কনের জন্য। স্বাধীনতার রক্তমিছিলে সেদিন যারা জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন আমাদের ধমনিতে তাদের রক্ত। সব শহীদের রক্তঋণ শোধতে মরিয়া হয়ে উঠেছে এই প্রজন্ম। পবিত্র মাতৃভূমিকে কলঙ্কমুক্ত করার লড়াইয়ে রাজপথে অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় মহান ’৭১-এর চেতনা ধারণ করে লড়াই করবে তরুণ প্রজন্ম। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশের বিনিময়ে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে ভেজা বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে শিক্ষায়, প্রযুক্তিতে, স্বাস্থ্যে, শিল্পে, ব্যবসা-বাণিজ্যে এক অন্যন্য দৃষ্টান্ত রাখার লক্ষ্যে পূর্বসূরিদের সাথে কাজ করার প্রয়াস প্রজন্মযোদ্ধাদের। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের ভিত্তির ওপর যে রাষ্ট্র কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে তাকে সমুন্নত রাখতে চাই সঠিক নেতৃত্ব। ’৭১-এর চেতনায় উদ্বুদ্ধ প্রতিটি বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধভাবে সেই লড়াইয়ে অংশ নিয়ে পবিত্র মুক্তিযুদ্ধকে স্বার্থক করে তুলতে হবে।
পূর্বপুরুষরা যেভাবে রক্তনদী পাড়ি দিয়ে আমাদের একটি স্বাধীন ভূখন্ড উপহার দিয়েছেন। সেভাবেই মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ইতিহাস থেকে জেনে আমরা আমাদের দেশের কল্যাণ করার প্রত্যয় করব। আর সব কিছুই উৎসর্গ করব বিজয় দিবসকে। কেননা এই সব কিছুর প্রাপ্তি মুক্তিযুদ্ধের কারণেই হয়েছে। এখন আমি একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে গর্ব করতে পারি, নির্ভয়ে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি গাইতে পারি, বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নিতে পারি, বাংলা ভাষায় অবাধে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা করতে পারি, গল্প-উপন্যাস লিখতে পারি, স্বাধীনভাবে পত্র-পত্রিকায় লিখে নিজের মত প্রকাশ করতে পারি, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় অর্জন করতে না পারলে আমরা থেকে যেতাম পাকিস্তান নামক একটি উদ্ভট রাষ্ট্রের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে। যে রাষ্ট্রধর্মের কারণে বিভাজিত, যে রাষ্ট্র আমার মায়ের ভাষা বাংলাকে অপমান করে রফিক-সালাম-বরকত-জব্বারের মতো দেশপ্রেমিককে হত্যা করেছে। যে রাষ্ট্রে মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মানিক, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণরা উপেক্ষিত। যে রাষ্ট্রের পরিচালকরা চর্যাপদ বোঝে না, রামায়ণ, মহাভারত, মঙ্গলকাব্য, গীতগোবিন্দ, রবীন্দ্রসংগীত, জারি-সারি-ভাটিয়ালি বোঝে না। তারা আমাদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে খাটো করে দেখেছে, আমার হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে দমিয়ে রাখতে চেয়েছে।
আমার মতো তরুণ প্রজন্মের কাছে মনে হয়, মুক্তিযুদ্ধ এক সাংস্কৃতিক বিপ্লব। আমাদের সংস্কৃতিই প্রমাণ করে আমি বাঙালি আর তারা অবাঙালি। ঐ অবাঙালিরা বাঙালির সংস্কৃতিকে অপমান করতে পারে না। এই আধিপত্যবাদী, প্রতিহিংসাপরায়ণ, লুটেরা, নিপীড়ক অবাঙালিদের সঙ্গে আর যৌথ বসবাস নয়। ওদের শাসন মানা বাঙালিদের পক্ষে অসম্ভবই ছিল। শেষ পর্যন্ত বাঙালির বিদ্রোহ যথাযথ ছিল।। অকুতোভয় বাঙালির এই গণবিদ্রোহের নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যেন এক বাঘের গর্জন। ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব’, ‘বাঙালিকে তোমরা দাবায়ে রাখতে পারবা না’। শেখ মুজিবের সেই সাহসী কণ্ঠ আমাকে সর্বদাই অনুপ্রাণিত করে।
সবাইকে বিজয় দিবসের শুভেছা।
লেখক :কথা সাহিত্যিক ও কলামিস্ট।