স্মরণ ॥ এক জ্যোতির্ময় তারকার আকস্মিক বিদায়

64

জয়ব্রত দেব

অসময়ে মরিতে চাই না আমরা কেউই, পরিণত বৃদ্ধ বয়সে সকলেরই মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, স্বাভাবিক কিন্তু অপরিণত বয়সে অসময়ে মৃত্যু এসে ডাক দিলে কে তা মেনে নেবে ? ১০০ বছর পর্যন্ত জীবিত না থাকলেও মাত্র ৫০ বছর বয়সে মরতে চাইনা আমি, কেউই চায় না। কিন্তু কারো কারো জীবনে মৃত্যু হঠাৎ করেই দ্বারে এসে কড়া নাড়ে, নিষ্ঠুরভাবে, নির্মমভাবে। ভাগ্য নিতান্ত ভালো থাকলে রক্ষা না হয় অকালে বিদায়। এমন করুণ নিষ্ঠুর ঘটনা আজকাল আমাদের চারিদিকে অহরহ ঘটেই চলেছে। একটা মৃত্যু একটা পরিবারে বিরাট প্রভাব ফেলে, বদলে যায় অনেককিছু কিংবা সবকিছু।
সিলেট জেলাধীন ফেঞ্চুগঞ্জ থানার মৌরাপুর পরগনার বড়বাড়ি বলে পরিচিত জে এন দেব চৌধুরী পরিবারের এ রকমই এক বেদনা বিধুর ঘটনা এটি। ১৯৯৫ সালের জুন মাসে আমার বাবা (উকিল, জিতেন্দ্র নারায়ণ দেব চৌধুরী) মারা যাওয়ার পর থেকে পরিবার সবকিছু যখনই আমরা কিছুটা সামলে উঠেছি ঠিক তখনই আমাদের পরিবারে ঘটে গেল বিরাট এক মর্মান্তিক অঘটন, বড় ভাই জ্যোতির্ময়কে হারাতে হল নিতান্ত অকালে। চোখের সামনে আমাদের সকলের মাঝ থেকে একজন পিতৃতুল্য নির্ভরযোগ্য দায়িত্বশীল বুদ্ধিমান সুশিক্ষিত রুচিশীল প্রিয় আপন একজন কাছের মানুষের অকাল মৃত্যুটা কেন জানি এখনো মেনে নিতে পারছি না আমি।
ঘাতক ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে গত ১৫ই ডিসেম্বর ২০১৬ ইং, মাত্র ৫২ বৎসর বয়সে অকালে প্রাণ হারাতে হল বড় ভাই (বিচারপতি, বাংলাদেশ হাইকোর্ট) জ্যোতির্ময় নারায়ণ দেব চৌধুরীকে। বড়ভাই মানুষ হিসাবে সাধারণ অসাধারণ যে রকমই হোক না কেন, বেশ কিছু বিষয়ে বহু সামঞ্জস্য ছিল সবার কাছে সবার মাঝে। স্কুল, কলেজ জীবনের অনেক সহপাঠী বন্ধুদের সাথে তার ছিল নিবিড় যোগাযোগ সম্পর্ক। ঘুরে বেড়াতে ভীষণ পছন্দ করতো আমাদের বাবার মতই সে, মানুষ জন নিয়ে আড্ডা গল্প খাওয়া দাওয়া খুব ভালো লাগতো তার, বয়সে ছোট বড় অনেকেই ছিল তার প্রিয় তালিকায়। সে ছিল সদালাপী গল্প পিপাসু মানুষ, একা থাকা বা চুপ করে থাকা তার একদম ভালো লাগতো না, খুব সৌখিন রুচিশীল ছিল তার জীবন যাপন। ইউরোপ আমেরিকা কানাডা এশিয়ার অনেক দেশ শহর সে কখনো পরিবার পরিজন নিয়ে কখনো দলবল নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। বসে থাকার পাত্র সে মোটেও ছিল না।
কর্মক্ষেত্র ঢাকায় থাকলেও মায়ের সাথে তার ছিল সার্বক্ষণিক যোগাযোগ, প্রবাসে থাকার কারণে মাকে আমরা নিয়মিত ফোন বা খোঁজ খবর না নিতে পারলেও বড় ভাইয়ের ছিল নিয়মিত সার্বক্ষণিক যোগাযোগ। বিশেষ কোন সমস্যা না হলে প্রতি দুই সপ্তাহ অন্তর তার ছিল সিলেটের বাসায় আসার রুটিন। বড়ভাই ছিল বড়ত্ব নিয়ে একজন আদর্শ বড় ভাইয়ের মতোই। নিজের যোগ্যতা বুদ্ধিমত্তা শিক্ষা দিয়ে সে অনেক সম্মানিত আসন অর্জন করতে পেরেছিল, বাবার পদাঙ্ক এবং পেশা অনুসরণ করে সে একজন সফল উকিল থেকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতির আসন অলংকৃত করে ২০১৪ সালের ফেব্র“য়ারী মাসে। ঢাকায় তার নিজস্ব ল চেম্বার বা ফার্ম সে প্রতিষ্ঠা করেছিল বেশ কয়েক বছর আগেই, সেখানে এখনো তরুণ অভিজ্ঞ বেশ কয়েকজন আইনজ্ঞ তার প্রতিষ্ঠিত ল’ ফার্মটি দেখাশুনা এবং পরিচালনা করছেন। পরিশ্রম, বুদ্ধিমত্তা আর জ্ঞান দিয়ে ঢাকায় একাধিক বাড়ি গাড়ি নিজস্ব প্রভাব প্রতিপত্তি বিত্ত গড়ে তুলতে পেরেছিল।
যতদূর মনে পড়ে ২০১০ সালের দিকে তার গলার স্বর ক্রমশ ভাঙতে শুরু করে এবং আস্তে আস্তে তা বাড়তে থাকে। অনেক ডাক্তার কবিরাজ চিকিৎসা নিয়েও তেমন কোন ফল পাওয়া যাচ্ছিলো না। এমতাবস্থায় ২০১৪ তে অবস্থা বেগতিক দেখে আত্মীয়স্বজন বন্ধু ও ডাক্তারদের পরামর্শে ক্যান্সারের পরীক্ষা করে গলায় ধরা পড়ে ক্যান্সার। সেই থেকে সিঙ্গাপুর, বোম্বে, ঢাকা লক্ষ লক্ষ টাকা আর সময় ব্যয় করেও কোন কিছুতেই ঘাতক ব্যাধিটি কে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হল না। অসুখ ধরা পড়ার মাত্র দুই বছরের মধ্যে নিষ্ঠুরভাবে নিয়তি কেড়ে নিল তাকে। কেন এমনটি আমাদের সাথেই ঘটলো, আক্ষেপ আর অনুতাপ আমাদের সারাজীবন তাড়া করে ফিরবে।
ওর মৃত্যুর পূর্বের শেষ কয়েকটা দিন এখনো ছবির মত আমার চোখের সামনে ভাসছে। ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালের বেডে শয্যাশায়ী চলাফেরার কোন ক্ষমতা নেই, মেরুদন্ডতে ক্যান্সার ছড়ানোর কারণে কিন্তু মানসিক শক্তি তখনো তীব্র এবং প্রখর একজন সুস্থ সবল মানুষের মত। বিছানায় বসে বসে আমাদের সকলকে নানা দিক নির্দেশনা দিচ্ছে বৈষয়িক নানা বিষয়ে। তার সন্তানদের পড়াশুনা-ভবিষ্যৎ ইত্যাদি নানা বিষয়ে সে যে সব প্রস্তুত এবং চিন্তা করে রেখেছে তা যেন অনুসরণ করা হয়, উপস্থিত আমাদের সকলকে উদ্দেশ্য করে। একজন মৃত্যু পথযাত্রী মানুষের এ রকম মানসিক শক্তি আমি এই প্রথম হয়তো শেষ দেখলাম। তখন সে জেনে গেছে তার হাতে আর সময় বেশি নেই। পাঁচ মাসের ব্যবধানে আবার আমি ৯ই ডিসেম্বর ২০১৬ ইং বাংলাদেশে পৌঁছার পর থেকে ওর কাছে ওর সাথেই ছিলাম মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত হাসপাতালে কিন্তু তার এভাবে চলে যাওয়াটা কেন জানি সহজ স্বাভাবিক ভাবে আমি মোটেও মেনে নিতে পারছি না। ক্যান্সার রোগের তার মূল চিকিৎসক বোম্বের ডাক্তার আদভানি এর ভাষ্য অনুযায়ী তার আরো ছয় থেকে আট মাসের মত বেঁচে থাকার কথা। কিন্তু বোম্বে থেকে ফিরে আসার দুই সপ্তাহের মধ্যেই তার না ফেরার দেশে চলে যাওয়া! এ কেমন মৃত্যু? মানসিক ভাবে সুস্থ সবল থাকা অবস্থায় এভাবে মানুষের মৃত্যু হয় নাকি? ক্যান্সার নো আনসার এমন প্রচলিত বাক্য আমাদের সবাইকে হতবাক হতাশ বাকরুদ্ধ করে দিল। শারীরিক কিছুটা জটিলতা যে ছিল না তা নয় কিন্তু চোখে পড়ার মত এমন কোন কষ্ট বা যন্ত্রণা দেখিনি আমরা কিংবা সে নিজেও তেমন কোন অভিযোগ করতে শুনিনি বা দেখিনি। উচ্চমাত্রার পেইন কিলার খেতে হত তাকে কোমরের ব্যথা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য। ক্যান্সার পর্যায়ক্রমে গলা, মেরুদন্ড হয়ে কোমরের হাড়ে, ফুঁসফুঁসে ছড়িয়েছে। একটা একটা করে শরীরের প্রতিটি অর্গানকে ক্যান্সার শেষ করে দিচ্ছে আর মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। একেবারে শেষের দিকে নিঃশ্বাসের সমস্যায় অক্সিজেন মাঝে মাঝে নিতে হত তাকে কিন্তু মৃত্যু এসে একেবারে দ্বারে অপেক্ষা করছে বাহ্যিকভাবে এমনটি ভাবার অবকাশ ছিল না। ১৪ই ডিসেম্বর মধ্য রাত থেকে হঠাৎ করেই তার অবস্থার চরম অবনতি ঘটতে শুরু করে। হার্টবিট, পালস, ব্লাড প্রেসার সব অস্বাভাবিক ভাবে উঠানামা করতে শুরু করে, এটাসেটা অনেক বৈজ্ঞানিক ডাক্তারি আধুনিক যন্ত্র লাগানো অবস্থায় ১৫ই ডিসেম্বর ২০১৬ বিকালে জীবন মৃত্যুর লড়াইয়ে পরাস্থ হতে হল তাকে। চলে গেল বড়ভাই চিরতরে আমাদের ছেড়ে, কিছু কি বলতে চেয়েছিল আমাকে, আমাদের? মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে। কেন জানি তার মৃত্যুর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে আমি হাসপাতালের বাইরে ছিলাম। শরীর খুব খারাপের খবর পেয়ে হাসপাতালের পাশেই ঢাকার পান্থপথ এ ট্রাফিক জ্যাম থাকায় গাড়ি থেকে নেমে রাস্তায় দৌড়াচ্ছি হাসপাতালে দ্রুত পৌঁছার জন্য। কিন্তু আমি এসে পৌঁছার অল্প কিছু আগে সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে চলে গেল, এই নশ্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে। কেমন জানি শান্ত স্তব্দ অন্ধকার হয়ে গেল আমার আমাদের চারিদিক। প্রাণহীন শরীরটা নিথর হয়ে পড়ে রয়েছে হাসপাতালের বিছানায়, আর একটি বাক্য তার মুখ থেকে শুনা হবে না। আর কারো উপর রাগ করবেনা, আর আমাকে দেশে আসার কথা বলবেনা কোনদিন সে, দলবেঁধে তার সাথে বেড়ানো খাওয়া দাওয়া গল্প আড্ডা এখন শুধু ছবি আর স্মৃতি হয়ে রইবে। তার প্রাণহীন নীথর শরীরের সামনে স্তব্দ হয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম পাথরের মত, ডাক্তার এলো কনফার্ম করলো সে এখন মৃত। তার দিকে তাকিয়ে আমি দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম অনেকক্ষণ, কতক্ষণ কি জানি। মনের মধ্যে তখন ভাসতে লাগলো এলোমেলো হাজারো সব চিন্তা।
বারবার একই কথা ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়, ক্যান্সারটা আসলে কি ? কেন এমন হয়, কেন? পৃথিবী যতই আধুনিক উন্নত হোক না কেন চিকিৎসা বিজ্ঞান এখনো পরাস্থ ঘাতক এই মরণ ব্যাধির কাছে। আজকাল এই ক্যানসার রোগ এতই বেড়েছে যে মহামারীর আকার ধারণ করতে আর বেশী বাকি নেই বলেই মনে হচ্ছে। আমাদের খাদ্য, জীবন যাত্রা, নানা ধরনের যন্ত্রের আর ডিভাইসের প্রভাব এর মূল কারণ বলেই গবেষকদের বক্তব্য। আসলে এ এমন এক রোগ অনেকটা বিনা কারণে বিনা নোটিসে শরীরে বাসা বাঁধে, তারপর তিলে তিলে শেষ করে আমাদের দেহকে! বড় ভাইয়ের বাজে কোন অভাস ছিল না, পান, মদ, ধূমপান এসব গতানুগতিক বদঅভ্যাস তাকে স্পর্শ করেনি, তবুও তার গলনালিতেই প্রথমে ক্যান্সার ধরা পড়ে। বড়ভাই(জ্যোতির্ময়) ক্ষণজন্মা একটা নক্ষত্রের মত জ্বলে উঠে পরক্ষণেই আবার নিভে গেল। এতো তাড়াতাড়ি সে চলে যাবে আমরা কেউই ভাবতে পারিনি, বড়ভাইও ভাবতে পারেনি। মায়ার এই সংসার, ভিটে মাটি, আপন-পর সবকিছু ছেড়ে কিভাবে একজন মানুষ বিদায় নেয়, বাধ্য হয়েই বিদায় নিতে হয় সকলকে। মানুষের জীবনটা আসলে যে কি? কিসের পিছনে আমরা এতো দৌড়াদৌড়ি ছুটোছুটি টানাটানি করে কাটিয়ে দিয়েছি, আরো কাটাবো যে কতকাল ! আমরা কত অসহায় কত তুচ্ছ কত ক্ষুদ্র এই নশ্বর পৃথিবীতে, জীবন-মৃত্যুর এই ঘূর্ণিপাকের খেলায় আমরা জুড়ে আছি আদি থেকে অনন্তকাল। শূন্য হাতে পৃথিবীতে এসে আবার আমাদের শূন্য হাতেই ফিরে যেতে হয়। হায়রে এ সাধের মানব জীবন।