কাজিরবাজার ডেস্ক :
মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন বিভাগ গত চার মাসে বাংলাদেশী ১৯ হাজার অবৈধ কর্মীকে আটক করেছে। একই সঙ্গে দেশটির ৪২৭ নিয়োগকারীকেও আটক করা হয়েছিল। নিয়োগকর্তারা পরবর্তীতে জামিনে মুক্ত হয়েছেন। আটক রয়েছেন শুধু কর্মীরা। কর্মীরা জেলখানায় মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। চলতি বছর ৩০ জুন প্রবাসী কর্মীদের ই-কার্ড নিবন্ধন কর্মসূচী শেষ হওয়ার পর দেশটির ইমিগ্রেশন বিভাগ আটক অভিযান শুরু করে। টানা চার মাস এই অভিযান চালানো হয়। অভিযানে বিভিন্ন দেশের ৩০ হাজার কর্মীকে আটক করা হয়েছিল। অনেক দেশ কর্মীদের কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে নিয়েছে। মুক্তি পায়নি বাংলাদেশের কর্মীরা।
সম্প্রতি আটক কর্মীদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে দেশটির ইমিগ্রেশন বিভাগের মহাপরিচালক মোস্তফার আলী। মোস্তফার আলী বলেন, জেলখানায় বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ানো একটা বড় খরচের বিষয়। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যত দ্রুত সম্ভব কর্মীদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে। বিষয়টি নিয়ে ‘সোর্স কান্ট্রি’ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ- আলোচনা করা হয়েছে। কোন্ প্রক্রিয়ায় আটকদের নিজ নিজ দেশে পাঠানো হবে সেই প্রক্রিয়া চলছে।
মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন বিভাগের ঘোষণার পর আটক কর্মীদের বিষয় নিয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে মালয়েশিয়া থেকে যাতে কোন কর্মী দেশে ফিরে না আসে তা নিয়ে দেশটির কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জোরালো আলোচনা করা হবে। অবৈধ কর্মীদের বৈধ করার বিষয়ে অনুরোধ জানানো হবে। বৈঠক থেকেই মালয়েশিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনকে কর্মীদের বিষয়ে দেশটির কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। মন্ত্রণালয়ের ওই তৎপরতা এখন আর নেই। আটকদের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের কোন মাথাব্যথা নেই। তারা অনেকেই জেলজীবন থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরতে চান। তাদের বিষয়েও কোন আলাপ-আলোচনা করছে না মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, বৈঠকে কিছু ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। মালয়েশিয়া থেকে যাতে কোন কর্মী ফেরত না আসে সেদিকটির ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। সিদ্ধান্ত যদি বাস্তবায়ন করা যেত তাহলে এত মানুষকে জেলহাজতে থাকতে হতো না। তাদের কেউ যদি দেশে ফিরতে চায় তাহলে দেশে ফিরিয়ে আনা যেত। আবার দেনদরবার করে কর্মীদের বৈধ করাও যেতে পারত। অনেকদিন চলে গেছে, এখন আর তেমন কিছু করা যাচ্ছে না। তবে একটা কাজ করা যেতে পারে তা হলো আটকদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা। জেলখানায় তারা মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। এখান থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায় থেকে আলাপ-আলোচনা করলে আটক লোকগুলো দেশে ফেরার সুযোগ পেত।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, দেশের হাজার হাজার কর্মী বিরাট অঙ্কের টাকা ব্যয় করে মালয়েশিয়া যায়। তারা নানা কারণে অবৈধ হয়ে পড়েন। অবৈধ কর্মীদের মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ বৈধ হওয়ার জন্য তিন মাস সময় দিয়েছিল। ওই সময়ের মধ্যে অনেক কর্মী ই-কার্ড নিতে পারেনি। তাদের ই-কার্ড দেয়ার সময়সীমা আরও একদফা বাড়াতে মালয়েশিয়া সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষকে এই মর্মে একটি চিঠি দিয়েছিল। হাইকমিশনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে-তারা যেন দেশটির সরকারের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে সব সময় যোগাযোগ রক্ষা করে। যাতে একজন কর্মীও দেশে ফিরে না আসে সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে। বর্তমানে অবৈধ কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযান বন্ধ করলেও বহু কর্মী আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বড় ভূমিকা রাখার কথা থাকলেও মন্ত্রণালয় সেই ভূমিকা পালন করেনি বলে অভিযোগ রয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, মালয়েশিয়ায় ১৫ দেশের কর্মীরা কাজ করছেন। সংশ্লিষ্ট দেশগুলো কর্মী আটকের বিষয় নিয়ে ইতোমধ্যে মালয়েশিয়ার সঙ্গে আলাপ- আলোচনা করে অনেক দেশই সফল হয়েছে। বাংলাদেশ দেরিতে হলেও মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চালায়। কিন্ত এতে কোন লাভ হয়নি। সেই সময় মালয়েশিয়ার আটক অভিযান নিয়ে নিয়োগকর্তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা কারখানায় কাজ করার কোন কর্মী পায়নি। তারা তাদের ব্যবসা নিয়ে শঙ্কিত ছিল। কারণ যতদিন না মালয়েশিয়ায় ধরপাকড় বন্ধ হয় ততদিন পালিয়ে থাকা প্রবাসী কর্মীরা কাজে যোগ দিতে পারবেন না। ফলে হুমকির মুখে পড়বে মালয়েশিয়ার নির্মাণ, ফার্নিচার ও প্ল্যান্টেশন খাত। বিশেষ করে ফার্নিচারে খাতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে। সারা বিশ্বে মালয়েশিয়ার তৈরি ফার্নিচার রফতানি হয়। বর্তমানে ফার্নিচার কারখানায় উৎপাদন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। মালয়েশিয়ার ফার্নিচার শিল্প ব্যবসায়ীদের সংগঠন ‘মুয়াব’সহ ৮ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ তখন প্রধানমন্ত্রীর দফতর বিষয়কমন্ত্রী দাতুক সেরি ড. উই কা সিয়াংয়ের সঙ্গে দেখা করে তাদের অবস্থা তুলে ধরেন। এ সময় ড. সিয়াং তাদের আশ্বাস দেন, দ্রুত পরিস্থিতি স্থিতিশীল হবে। আমরা সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছি। ব্যবসা-বাণিজ্যে যাতে কোন প্রকার প্রভাব না পড়ে সে জন্য যা যা করণীয় তা করা হবে। ব্যবসায়ীরা মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার পর থেকেই দেশটিতে পুলিশী অভিযান শিথিল করা হয়েছে। পুলিশ ধরপাকড় কমিয়ে দিয়েছে। বিশ্বের ১৫ দেশের পক্ষ থেকেই মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানিয়েছে, অবৈধ কর্মীদের বৈধ করার জন্য আরও কিছুদিন সময় বাড়ানোর। তবে কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে প্রকাশ্যে এখনও কোন কিছু বলেনি।
এদিকে, ই-কার্ডের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় অবৈধ কর্মীদের বৈধ করার প্রক্রিয়ায় প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে। অনেক বাংলাদেশীকে নকল ই-কার্ড দেয়া হয়েছে। ই-কার্ডের জন্য নির্দিষ্ট ফি জমা নিলেও নকল ই-কার্ড দেয়ায় কর্মীরা আরও বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। দালালদের মাধ্যমে ই-কার্ড করানো কর্মীরাই প্রতারণার শিকার হয়েছেন। দালালরা কর্মীদের কাছ থেকে বেশি টাকা নিয়ে তাদের কার্ড করে দিয়েছে। আসলে কার্ডগুলো নকল ও ভুয়া। এসব কার্ডের কোন তথ্য মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। মালয়েশিয়ায় দালাল চক্রের কারণে সেখানে কর্মীরা বৈধ হতে গিয়েও প্রতারণার শিকার হয়ে অনেক কর্মী এখন পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন। মালয়েশিয়ায় প্রবাসীর অনেকেই প্রথমে ই-কার্ড পদ্ধতিটিকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। তবে পরবর্তীতে মালয়েশিয়ার সরকারের কড়াকড়ির কারণে অনেক অবৈধ প্রবাসী বৈধ হওয়ার এ সুযোগ নিয়েছে। কিন্তু প্রথমে গুরুত্ব না দেয়ার কারণে অনেক প্রবাসী ই-কার্ড পদ্ধতিতে বৈধ হবার সুযোগ হারিয়েছে। ফলে অনেকে দালালের মাধ্যমে ই-কার্ড সংগ্রহ করে। কিন্তু দালালরা টাকার বিনিময়ে তাদের হাতে নকল ই-কার্ড তুলে দেয়। ফলে বিপাকে পড়েছে এসব কর্মীরা।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের ১৫ ফেব্র“য়ারি থেকে শুরু হয় মালয়েশিয়ায় ই-কার্ড ইস্যুর মাধ্যমে অবৈধ বিদেশী কর্মীদের বৈধ করার কার্যক্রম। চলে ৩০ জুন পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে যারা ই-কার্ড নিতে পারেননি তাদের বিরুদ্ধে ওই দিন মধ্যরাত থেকেই পুলিশী অভিযান শুরু হয়। অভিযানে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী কর্মী আটক হয়।