॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥
কোন ধর্ম যদি বিশেষ কোন গোত্র বা বর্ণের জন্য নির্দিষ্ট করা না হয় অথবা সীমবদ্ধ না থাকে কোন ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে, বরং ধর্মের লক্ষ্য যদি হয় বিশ্ব জগতের সমগ্র জনগোষ্ঠী তা হলে দু’ভাবে সে ধর্ম গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রথমত স্বেচ্ছায় ধর্ম গ্রহণ করার মাধ্যমে দ্বিতীয়ত জন্মগত সূত্রে। জন্মসূত্রে ইসলাম গ্রহণের ক্ষেত্রে ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রশ্নটি গৌণ।
স্বেচ্ছায় ধর্ম গ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যক্তি সচেতনভাবে একটি ধর্মকে পরিহার করে এবং আরেকটি ধর্ম গ্রহণ করে। কোন ধর্ম গ্রহণ বা বর্জন করার বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে তার পছন্দ-অপছন্দের উপর নির্ভর করে। এ প্রসঙ্গে নবী করীম (সা) বলেছেন যে, “তাকে মুখে ঘোষণা দিতে হবে এবং অন্তরে বিশ্বাস করতে হবে।” স্বেচ্ছায় ধর্ম গ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে প্রথমে গোসল করার মধ্য দিয়ে অবিশ্বাস এবং অজ্ঞতার কালিমা দূরীভূত হয়। অতঃপর সে দু’জন সাক্ষীর উপস্থিতিতে ঘোষণা দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন মা’বুদ নেই এবং মুহাম্মদ (সা) তাঁর রাসূল বা প্রেরিত পুরুষ।
হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে যে, কোন লোক ইসলাম গ্রহণ করলে প্রিয়নবী (সা) তাঁর পূর্ব নাম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেন। যদি দেখা যেত যে, তাঁর নামের সঙ্গে অনৈসলামিক কোন ধ্যান-ধারণা জড়িয়ে আছে, অথবা তার না কা’বার পূজারী, সূর্যের পূজারী, ভ্রান্ত পথের অনুসারী অথবা এ জাতীয় কোন অর্থ বহন করে, তাহলে সে নামগুলো পাল্টিয়ে সুবিধাজনক একটি নতুন নাম ঠিক করে দিতেন। বর্তমান সময়ে নওমুসলিমগণ পূর্ব নামের সঙ্গে একটি আরবি নাম যোগ করে থাকেন।
নবী করীম (সা) এর মাতৃভাষা আরবি। তাঁর স্ত্রীগণ উন্মুল মু’মিনীন বা মুসলমানদের মাতা হিসাবে পরিচিত। তাঁরাও আরবি ভাষায় কথা বলতেন। সে হিসাবে প্রতিটি মুসলমানের একটি মাতৃভাষা আরবি। অন্যভাবে বলা যেতে পারে যে, আরবি মুসলমানদের আধ্যাত্মিক জগতের মাতৃভাষা। সে কারণেই আরবি ভাষা লেখা, বিশেষকরে মূল আরবিতে কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করতে পারাটা প্রত্যেক মুসলমানের একটি পবিত্র দায়িত্ব।
মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করার মাধ্যমে একটি শিশু ইসলাম ধর্মাবলম্বী হয়ে থাকে। ভূমিষ্ট হওয়ার পর পরই তার ডানকানে আযান এবং বাম কানে আকামত দেওয়া হয়। অর্থাৎ জন্মগ্রহণ করার পর প্রথমেই সে শুনতে পায় আল্লাহর একত্মবাদের ব্যাপারে সাক্ষ্য দান এবং আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী ও নিজের কল্যাণের জন্য আহ্বানের কথা। আযানের সময় তাকে শোনান হয় যে, আল্লাহ মহান; আমি শপথ গ্রহণ পূর্বক সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ (মাবুদ) বা উপাস্য নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (সা) আল্লাহর রাসূল। সালাতের জন্য এসো, কল্যাণের জন্য এসো, আল্লাহ ব্যতীত আর কোন ইলাহ (মা’বুদ)নেই। আকামতের সময় তাকে আযানের সব কথাই শোনানো হয়। তাকে আরো শোনানো হয় যে, ওহে সালাতের সময় সমুপস্থিত।
বাল্যজীবন ঃ শিশু ভূমিষ্ট হওয়ার পর প্রথম চুল কেটে সমস্ত চুলের সমপরিমাণ ওজন রূপা বা টাকা গরীব-দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। যাদের সঙ্গতি আছে তারা ছাগল বা ভেড়া যবাই করে এবং সেই গোশত দিয়ে আত্মীয়-স্বজন ও গরীব-দুঃখীদের আপ্যায়ন করে থাকে। ইসলামী পরিভাষায় এটাকে বলে আকীকা। এরপরেই আসে পুত্র সন্তানকে খাতনা (মুসলমানী) করানোর প্রসঙ্গ। খাতনা করানোর নির্দিষ্ট কোন সময় সীমা নির্ধারণ করা নেই। সাধারণত বাল্য বয়সেই খাতনা করানো হয়। অবশ্য কোন বয়স্ক লোক ইসলাম গ্রহণ করলে তাকে খাতনা করানোর ব্যাপরে কোন বাধ্যবাধকতা নেই।
সাধারণত চার বছর পর শিশু লেখাপড়া শুরু করে। এ সময়ে বিশেষ দু’আ-দরূদ ও ভাল খাবারের আয়োজন করা হয়। শিশুকে সে অনুষ্ঠানেই প্রথম পাঠ দেওয়া হয়। শুভ সূচনা হিসাবে কুরআনুল করীমের সূরা আলাকের প্রথম ৫টি আয়াত তিলাওয়াত করা হয়। শিশু উস্তাদের সঙ্গে আয়াতগুলো তিলাওয়াত করে। বলে রাখা আবশ্যক যে, হেরা গুহায় নবী করীম (সা) সর্বপ্রথম যখন ওহী লাভ করেন, তখন এ আয়াতগুলো নাযিল হয়েছিল।
সালাত ও সিয়াম ঃ লেখাপড়ার পাশাপাশি তাকে নামায পড়ার নিয়ম কানুনগুলো শিখতে হয়। তাকে মুখস্থ করতে হয় প্রয়োজনীয় দু’আ-দরূদ ও কুরআনের সূরাসমূহ। সাত বছর বয়সে সে সালাত আদায় করতে শুরু করে। প্রয়োজনবোধে পিতা-মাতা এ জন্য তাকে শাস্তি দেন। বাল্য বয়স থেকে সালাতে অভ্যস্ত করে তোলার জন্য এটা জরুরী।
একটি শিশু বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার উপর সালাত বা নামায পড়ার ন্যায় রোযা রাখা বা সিয়াম পালন করাটাও ফরয হয়ে পড়ে। অবশ্য মুসলিম পরিবারের শিশুরা বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পূর্বেই সিয়াম পালনে অভ্যস্ত হয়ে উঠে। জীবনে প্রথম যেদিন সিয়াম পালন করে. সেদিন সে খুবই আনন্দিত ও উৎফুল্ল হয়ে থাকে। এমন কি এটা যেন তার পরিবারে একটা উৎসবের রূপ নেয়। সাধারণত বার বছর বয়সে ছেলেমেয়েরা সিয়াম পালন করতে শুরু করে এবং বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ক্রমান্বয়ে এ মাসব্যাপী সিয়াম পালনের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠে।
হজ্ব ঃ সঙ্গতি সম্পন্ন লোকের জন্য জীবনে একবার হজ্ব করা ফরয। জিলহজ্বের দ্বিতীয় সপ্তাহে হজ্ব করা হয়। এ সময়ে হাজীগণ মক্কায় সমবেত হন এবং প্রায় সপ্তাহ ব্যাপী তাঁরা মিনা, আরাফাত, মুজদালিফা এবং আবার মিনায় অবস্থান করেন। এ তিনটি স্থান মক্কার উপকন্ঠে অবস্থিত। জিলহজ্ব মাস ছাড়াও বছরের যে কোন সময় কা’বা ঘরে যাওয়া যায়। ইসলামী পরিভাষায় এটাকে বলা উমরাহ।
যিনি হজ্ব করবেন তাকে অবশ্যই নিত্যদিনের পোশাক পরিত্যাগ করতে হবে। এ সময়ে তাকে বিশেষ এক ধরনের পোশাক পরতে হয়, এটাকে বলে ইহরাম। ইহরামে দুই প্রস্থ কাপড় থাকে। কাপড়ে কোন রকম সেলাই চলে না। এক প্রস্থ কাপড় সে পরিধান করে, অন্য প্রস্থ দিয়ে কাঁধ ও শরীর ঢাকে। কিন্তু সর্বক্ষণের জন্য মাথা উন্মুক্ত রাখে। মহিলারা স্বাভাবিক পোশাক পরে। তবে তা হতে হয় শালীন ও মার্জিত। তাদের হাত এবং পায়ের গোড়ালী পর্যন্ত সমস্ত শরীর আবৃত রাখতে হয়। মক্কার আরেক নাম হেরেম শরীফ। হেরেম শরীফে প্রবেশের পূর্বেই ইহরাম বাঁধতে হয়। হেরেম শরীফে প্রবেশের পূর্বে যেখান থেকে ইহরামের পোশাক পরিধান করতে হয় সে স্থানকে মীকাত বলে। আর মক্কাবাসীদের ইহরাম বাঁধতে হয় হেরেম শরীফ বা মক্কার অভ্যন্তর থেকে। হেরেম শরীফ থেকে সে চলে যায় মিনায়। ৯ই জিলহজ্ব যায় আরাফাতের ময়দানে। সারাটা দিন সেখানে কাটিয়ে দেয় ইবাদ-বন্দেগী ও দু’আ-দরূদ পাঠের মধ্য দিয়ে। রাত্রি যাপন করে মুযদালিফায় উন্মুক্ত প্রান্তরে। ১০, ১১ ও ১২ তারিখ এ তিন দিন অতিবাহিত করে মিনায়। মিনায় অবস্থানকালে প্রতিদিন সে শয়তানের প্রতীকিকে লক্ষ্য করে পাথর ছোড়ে। সুযোগ বুঝে এক সময়ে (১০ কিম্বা ১১ তারিখ) তাকে মক্কায় যেতে হয়। তখন সে তওয়াফ ও সাঈ করে। নির্ধারিত নিয়মে পবিত্র কা’বা ঘর ৭ বার প্রদক্ষিণ করাকে তওয়াফ বলে। আর সাফা ও মারওয়ার মধ্যে ৭ বার আসা যাওয়াটা হল সাঈ। কা’বা ঘর তওয়াফ এবং সাঈ করার নির্দিষ্ট কতকগুলো পদ্ধতি ও দু’আ রয়েছে। বস্তুতপক্ষে ইহরাম পরিধান করার পর থেকে ইহরাম ছাড়া পর্যন্ত একজনকে সারাক্ষণ আল্লাহর যিকর করতে হয়। এ সময়ের এ যিকরকে বলে তলবিয়া। তলবিয়ার দোয়া এরকম ঃ “লাব্বায়িক, আল্লাহুম্মা লাব্বায়িক, লাব্বায়েক লা শারীকা লাকা লাব্বায়িক, ইন্নাল হামদা, ওয়ান নিয়মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারীকা লাক্।
উমরা করার জন্য আরাফাত, মিনা বা মুযদালিফায় যেতে হয় না। কিন্তু যথারীতি তওয়াফ ও সাঈ করতে হয় এবং ইহরামের কাপড় পরিধান করতে হয়। এমনকি মক্কায় বসবাসকারী মুসলমানগণকে উমরা করার জন্য মক্কার বইরে গিয়ে ইহরাম করে হেরেম শরীফে প্রবেশ করেত হয়। তওয়াফ ও সাঈ করার পর মাথা মুন্ডন করে তারা স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় ফিরে আসে।
যাকাত ঃ যাকাত এক ধরনের সাদাকা। সকল প্রকার সঞ্চয়, মওজুদ, সম্পদ, উৎপন্ন ফসলের উপর যাকাত প্রদান করতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে ঃ কৃষিপণ্য, বাণিজ্য সামগ্রী, খনিজ সম্পদ, সরকারী চারণ-ভূমিতে পালিত মেষ-ছাগল, গরু, উট। আজকালকার দিনে মুসলমানগণ সঞ্চিত সম্পদের উপর প্রদত্ত যাকাত ব্যক্তিগতভাবে প্রদান করে থাকেন। মুসলিম বা অমুসলিম সব রাষ্ট্রেই এ নিয়ম চালূ রয়েছে। কিন্তু অন্যান্য কর বা খাজনার পরিমাণ স্থানীয় সরকার নির্ধরণ করেন এবং তা আদায়ও করা হয় সরকারী তত্ত্বাবধানে।
যাকাতের হিসাব এ রকম যে, কারো কাছে যদি সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সমমুল্যের অর্থ এক বছরের বেশি সময় জমা থাকে তাহলে তাকে উক্ত সঞ্চয়ের উপর শতকরা ২.৫% হারে যাকাত প্রদান করতে হয়। যাকাতের অর্থ সরাসরি বিরতণ করা যেতে পারে অথবা কোন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও তা ব্যয় করা বৈধ। যাকাতের অর্থ ব্যয় করার ৮টি খাত আল্লাহ তা’আরা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ব্যক্তি তার ইচ্ছানুযায়ী এক বা একাধিক খাতে যাকাতের অর্থ ব্যয় করতে পরে।
বছরের দুটি প্রধান উৎসব দুই ঈদে আরেক ধরনের সাদকা প্রদান করতে হয়। রমযান শেষে ঈদুল ফিতরের সময় দিতে হয় ফিতরা। এর পরিমাণ হল পূর্ণ বয়স্ক একজন লোকের সারা দিনের খোরাকের সমান। এ অর্থ একজন নিঃস্ব দরিদ্র লোকের প্রাপ্য। আবার পবিত্র নগরী মক্কায় যখন হজ্ব পালন করা হয় তখন আসে ইদুল আযহা। এ সময় সঙ্গতি সম্পন্ন লোকেরা গরু, ছাগল অথবা মেষ কোরবানী করে থাকেন। কোরবানীর গোশতের একটি অংশ নিজেদের জন্য রেখে বাকি অংশ দুঃস্থ ও গরীবদের মধ্যে বিতরণ করতে হয়।
অর্থনীতি প্রসঙ্গে এ কথা স্মরণ রাখতে হবে যে, একজন মুসলমানের পক্ষে কোন রকম সুদী কারবারে অংশ গ্রহণের অনুমতি নেই। সে বিষয়ে চিন্তার যথেষ্ট অবকাশ আছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। জুয়া, লটারী অথবা ফটকাবাজী কোন কাজে হাত দিতে পারে না। স্মরণ রাখতে হবে যে, স্বেচ্ছায় কেউ কখনো সুদ দেয় না। ব্যক্তিগতভাবে কাউকে ঋণ দিয়ে তার উপর সুদ আদায়ের প্রবণতাকে সম্পূর্ণরূপে পরিহার করতে হবে। ব্যাংকে জমা রাখা টাকার উপর যে সুদ আসে সে ব্যাংকটি যদি সুদী কারবারের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়, তাহলে এর লভ্যাংশও অবৈধ। কিন্তু এমন অনেক দেশ আছে যেখানে সুদী ব্যাংক ব্যতীত অন্য কোন ব্যাংক নেই। তখন তাকে বাধ্য হয়েই সুদী ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে হয়। সেক্ষেত্রে কেউ যদি ব্যাংকে তার সঞ্চয়ের উপর যে সুদ আসে তা গ্রহণ না করে, তাহলে ব্যাংক ইচ্ছা করলে অদাবিকৃত সুদের অর্থকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দান করতে পারে। কখনো কখনো অনুদান প্রাপ্ত এ সমস্ত প্রতিষ্ঠান ইসলাম বিরোধী কাজে লিপ্ত থাকে। সে কারণেই ব্যাংকে জামা টাকা উপর যে সুদ আসে তা ছেড়ে না দিয়ে বরং তা গ্রহণ করা উচিত। অবশ্য এ অর্থ নিজের বা পরিবারের জন্য ব্যয় না করে কোন জনহিতকর কাজে ব্যয় করতে হবে। প্রখ্যাত মুফতী সারাখশী বলেছেন যে, “অবৈধভাবে উপার্জিত সম্পদ থেকে অবশ্যই মুক্তি পেতে হবে এবং এ সম্পদকে কোন জনহিতকর কাজে ব্যয় করতে হবে”। কারো কারো মতে সরকারী প্রতিষ্ঠান এবং পারস্পরিক সমঝোতা ও দায়-দেনার ভিত্তিতে গড়ে উঠা সোসাইটির সঙ্গে বীমা করা বিধিসম্মত। কিন্ত পুঁজিবাদী মুনাফালোভী কোন কোম্পানীর সঙ্গে বীমা করাটা অবৈধ। (অসমাপ্ত)