কাজিরবাজার ডেস্ক :
বয়সের ফাঁদে পড়ে নেতৃত্ব হারাচ্ছেন বর্তমান যুবলীগের কেন্দ্রীয় দুই-তৃতীয়াংশ নেতাই। শুধু যুবলীগই নয়, বয়সের ফাঁদে পড়ে অন্য সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের শীর্ষ নেতারাও পদ হারাচ্ছেন কি না, এটা নিয়েও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অতীতের মতো ‘বুড়ো লীগের’ পরিবর্তে এবার ‘তারুণ্য লীগ’ সৃষ্টির এ প্রয়াসে দীর্ঘদিন কোন পদ না পাওয়া সাবেক ছাত্রনেতারা যেমন গা ঝাড়া দিয়ে মাঠে নেমেছেন, ঠিক তেমনি ৬০-৭০ বয়সী হয়েও সহযোগী ও ভাতৃপ্রতীম সংগঠনের শীর্ষ নেতারা নিশ্চিত পদ হারানোর আতঙ্কে রয়েছেন। সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয়, সহযোগী ও ভাতৃপ্রতীম সংগঠনের সম্মেলন সামনে রেখে বড় ধরনের শুদ্ধি অভিযানের আলামত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী যে বাদ পড়ছেন, সেটা অনেকের আগেই জানা ছিল। কিন্তু সংগঠনটির চেয়ারম্যান, সাধারণ সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ দুটি পদে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন বর্তমান কমিটির অধিকাংশ প্রেসিডিয়াম সদস্যরাই। বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদও ছিলেন চেয়ারম্যান হওয়ার লড়াইয়ে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে রবিবার যুবলীগের বৈঠকে বয়সসীমা ৫৫ বছর নির্ধারিত করা হলে রীতিমতো পদপ্রত্যাশীদের মাথায় যেন বাজ পড়েছে। কেউ-ই আগামী জাতীয় কংগ্রেসে ওই দুটি শীর্ষ পদে লড়াই করার তো দূরের কথা, পদপ্রত্যাশীই হতে পারবেন না।
সংগঠনটির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যুবলীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটিতে চেয়ারম্যান ও সাধারণ সম্পাদক ছাড়া ২৭ প্রেসিডিয়াম সদস্য রয়েছেন। মোট ২৯ সিনিয়র নেতার মধ্যে একমাত্র আতাউর রহমান আতা ছাড়া বাকি ২৮ জনেরই বয়স ৫৫ বছর পেরিয়ে গেছে। ফলে আগামী সম্মেলনে তারা কেউই সংগঠনের চেয়ারম্যান বা সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী হতে পারবেন না।
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকদের মধ্যে এক নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন আহমেদ মহি এবং সুব্রত পালের বয়স ৫৫ বছরের নিচে রয়েছে। নয় সাংগঠনিক সম্পাদক পদের মধ্যে বর্তমান কমিটির ফজলুল হক আতিক, বদিউল আলম, ফারুক হাসান তুহিন এ যাত্রায় রক্ষা পেয়েছেন। এরা আগামী সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য প্রার্থী হতে পারবেন। বর্তমান যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বড় পদে থাকা অন্যদের প্রার্থী হওয়ার কোন সুযোগই আর থাকছে না। এমনকি বর্তমান সম্মেলন প্রস্তুত কমিটির আহ্বায়ক চয়ন ইসলাম ও সদস্য-সচিব হারুনুর রশীদও যুবলীগের সম্মেলনে চেয়ারম্যান কিংবা সাধারণ সম্পাদক হতে পারছেন না।
শুধু যুবলীগই নয়, সম্মেলনকে সামনে রেখে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগেও বড় ধরনের শুদ্ধি অভিযানের আলামত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এসব সহযোগী ও ভাতৃপ্রতীম সংগঠনের কেন্দ্রীয় বড় পদে থাকা নেতারাও রয়েছেন পদ হারানোর আতঙ্কে। জানা গেছে, সম্মেলনকে সামনে রেখে যুবলীগের পর এসব সহযোগী ও ভাতৃপ্রতীম সংগঠনগুলোর সঙ্গেও বৈঠক করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর এসব বৈঠকেই বাকি সহযোগী ও ভাতৃপ্রতীম সংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় কমিটিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে বয়সসীমা নির্ধারণ করে দেয়া হতে পারে। আর তেমনটি হলে এসব সংগঠনগুলোর বর্তমানে শীর্ষ পদে থাকা নেতারাও পদ হারাবেন।
সূত্র মতে, যুবলীগের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগের সবপর্যায়েই বড় ধরনের শুদ্ধি অভিযান চালানো হবে। ক্ষমতার গত দশ বছরে বিতর্কিত ও অভিযুক্তদের সহযোগী ও ভাতৃপ্রতীম সংগঠনগুলোর শীর্ষ পদ থেকে হঠিয়ে তাদের জায়গায় পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির তরুণ নেতৃত্ব আনতে চান দলটির হাইকমান্ড। যাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি, মাদক, সন্ত্রাসের মতো অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে তারা আওয়ামী লীগের মূল দলে এবং সহযোগী ও ভাতৃপ্রতীম সংগঠন- কোথাও কোন স্থান পাবেন না, এটি স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা। ফলে আসন্ন সম্মেলনকে ঘিরে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোতে পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে।
যুবলীগের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকেই প্রধানমন্ত্রী কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, মাদক, সন্ত্রাস ও দুর্নীতিবিরোধী অভিযান অব্যাহত থাকবে। যারাই অপরাধী হোক না কেন তাদের কোন ক্ষমা নেই। একইসঙ্গে সম্মেলন প্রস্তুত কমিটির আহ্বায়ক চয়ন ইসলাম ও সদস্য-সচিব হারুনুর রশীদকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, বিতর্কিত ও অভিযুক্ত কেউ যেন কোন পদে না থাকতে পারেন। এমনকি সম্মেলনের যেসব সাব-কমিটি করা হতে তাতেও যেন এদের কেউ স্থান না পান।
প্রধানমন্ত্রীর এমন কঠোর বার্তার পর নড়েচড়ে বসেছে ইতোপূর্বে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দেয়া একঝাঁক তরুণ সাবেক ছাত্রনেতারা। স্বচ্ছ ইমেজ ও আন্দোলন-সংগ্রামে ইতোপূর্বে নানা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও এসব সাবেক ছাত্রনেতারা ক্ষমতাসীন দলটিতে শুধুমাত্র উপ-কমিটির সহ-সম্পাদকের নামেমাত্র এই পদটি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। দলে বড় ধরনের শুদ্ধি অভিযান ও পরিবর্তনের হাওয়া উঠলে এসব সাবেক ছাত্রনেতারা সহযোগী ও ভাতৃপ্রতীম সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব পেতে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। প্রতিদিনই গণভবনসহ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় ও ধানমন্ডির দলের সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে সাবেক ছাত্রনেতাদের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠছে। নিজ নিজ অবদান বড় নেতাদের সামনে তুলে ধরে দলে মূল্যায়ন চাচ্ছেন।
পরিস্থিতি বুঝতে পেরেই গত দশ বছরে সহযোগী ও ভাতৃপ্রতীম সংগঠনগুলোর বড় বড় পদে থেকে বিতর্কিত এবং নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়া নেতারা নিজেদের গুটিয়ে নিতে শুরু করেছেন। সম্মেলনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের দুটি দলীয় কার্যালয় প্রতিদিনই সরগরম থাকলেও বিতর্কিত এসব নেতাদের উপস্থিতি তেমন নেই বললেই চলে। সংগঠন থেকে বাদ পড়ার নিশ্চিত আভাস পেয়েই এসব সংগঠনের এতদিন দাপটে থাকা নেতারা আগেভাগেই দলীয় কার্যক্রম থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিতে শুরু করেছেন।
দলের পদ ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণœকারীরা এবার যে কোনভাবেই রেহাই পাচ্ছেন না, তা প্রকাশ্য বক্তব্য দিয়েই সেটি জানান দিয়েছেন স্বয়ং দলের প্রধান শেখ হাসিনা। নিকট আত্মীয় হলেও যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীকে সংগঠন থেকে অব্যাহতি ও গণভবনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতেও এতটুকু সময়ক্ষেপণ করেননি তিনি। পরিবারের কাছের মানুষের বিরুদ্ধেও প্রধানমন্ত্রীর এমন কঠোর অবস্থান দেখে অন্য বিতর্কিত ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত নেতাদের ভীতকেই যেন নাড়িয়ে দিয়েছে। এসব নেতারা আগামীতে কোন পদ-পদবি নয়, বরং চলমান প্রশাসনিক শুদ্ধি অভিযান থেকে নিজেদের রক্ষা করতেই দলের প্রভাবশীল কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে ধর্ণা দিচ্ছেন।
যুবলীগের সঙ্গে বৈঠকেও প্রধানমন্ত্রী এসব বিষয়ে তাঁর জিরো টলারেন্স অবস্থানের কথা স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন। বৈঠকে উপস্থিত যুবলীগের একাধিক নেতা জানান, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবাই ভাল ও সচ্ছল থাকুক, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হোক সেটা আমরা চাই। কিন্তু অন্যায়ভাবে যদি কেউ কিছু করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া এটা একান্তভাবে প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। তাই অপরাধী হলে সে দলে যে পর্যায়েরই নেতা হোন না কেন, কোন ক্ষমা হবে না, রেহাই পাবেন না।