মৌলভীবাজার থেকে সংবাদদাতা :
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে লিয়াকত আলী নামে এক যুবকের যৌবনের ১৬টি বছর কেটে গেছে শিকল আর গৃহবন্দী অবস্থায়। আজও তার দিন কাটছে তালাবদ্ধ ছোট একটি টিনসেড ঘরে। শিক্ষিত টগবগে ওই যুবকের বাড়ি কমলগঞ্জ উপজেলার মুন্সীবাজার ইউনিয়নের বিক্রমকলস গ্রামে।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পৈতৃক সম্পত্তির লোভে মুন্সীবাজার ইউনিয়নের বিক্রমকলস গ্রামের মরহুম বারহাম আলীর ৫ম পুত্র মো: লিয়াকত আলীকে তার আপন ভাইয়েরা মানসিকভাবে অসুস্থ সাজিয়ে চিকিৎসা না করিয়ে একটি ঘরে গৃহবন্দী করে রেখেছে। বাড়ির আঙিনার পশ্চিম অংশে নির্মাণ করা পাকা জেলখানার মতো তৈরি টিনসেডের ছোট ঘরটিতে দ্বিগম্ভর অবস্থায় দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে অমানবিকভাবে মানবেতর জীবন যাপন করছে সে। তাকে অসুস্থ সাজানোর শুরুতে দীর্ঘদিন ছিলো লিয়াকত শিকলবন্দী। বর্তমানে তাকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে। সংসারে ভাই-বোনের যৌথ পরিবারের অনেক সদস্য থাকা সত্বেও কেউ তার চিকিৎসা করাতে আগ্রহী নয়। এ অবস্থায় এখন কেবল মৃত্যুই যেন তার একমাত্র গন্তব্য।
মঙ্গলবার দুপুরে বিক্রমকলস গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ীর পৈতৃক সম্পত্তির তার ভাগের অংশে ছোট পাকা টিন সেটের ঘরটিতে অস্বাস্থ্যকর নোংরা পরিবেশে বিবস্ত্র অবস্থায় গ্রীলের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে লিয়াকত আলী (৩৬)। গায়ে কালো একটি ফুলহাতার গেঞ্জি পড়ালেও পড়নে কিছু পড়েনি সে। ওই ঘরটিতেই চলে তার আহার, নিদ্রা ও প্রাকৃতিক কাজ। পরিবারের সদস্যরা তার কাছে প্রতিদিন খাবার পৌঁছে দেয়। মলমূত্রের মাঝেই কাটছে তার অনিশ্চিত জীবন।
বিক্রমকলস গ্রামের মরহুম বারহাম আলী ও মা মৃত আমিরা বেগমের ৬ ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে ৫ম সন্তান লিয়াকত আলী। ৬ ভাইয়ের মধ্যে তিন ভাই ব্যবসা করছেন। আর দুই ভাই মধ্যপ্রাচ্যে চাকুরী করেন। বাড়িতে থাকা লিয়াকত সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠেন। ১৯৯৭ সালে সে মৌলভীবাজার টাউন সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে আলিম পাস করে। পরিবারের সদস্যরা জানান, ২০ বছর বয়সে লিয়াকত বিয়ে করে উপজেলার কালাছড়ায়। বিয়ের কিছুদিনের মধ্যে স্ত্রী তাকে রেখে বাবার বাড়ীতে ফিরে যায়। এরপর ওই বছরের শেষের দিকে লিয়াকত মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে।
লিয়াকত আলীর বড় ভাই স্থানীয় মুন্সীবাজারের ব্যবসায়ী আয়ুব আলী বলেন, দীর্ঘ প্রায় ১৫-১৬ বছর থেকে সে অসুস্থ। তাকে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে একাধিবার তাকে চিকিৎসা করানো হয়েছে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ খালিকুজ্জান ও ডা: আর কে এস রয়েলের কাছেও দীর্ঘদিন চিকিৎসা করা হয়। কিন্তু কোন সুফল না পাওয়ায় তার সুস্থ হওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছি আমরা।
তার অপর বড় ভাই দুবাই প্রবাসী জমসেদ আলীর দাবি করেন, নিজের ভাইকে কখনো শিকল দিয়ে কিংবা গৃহবন্দী করে রাখতে চাইনি। কিন্তু ছাড়া পেলে সে মানুষের উপর চড়াও হয়, কামড় দিয়ে জখম করে। কাপড় পরিয়ে দিলেও সে টেনে-হিছড়ে ছিড়ে ফেলে। সেজন্য বাধ্য হয়ে তাকে এভাবে রাখা হয়েছে। চিকিৎসা ব্যয় বহন করা সম্ভব না হওয়ায় তাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হয়নি বলে জানান পরিবারের সদস্যরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন গ্রামবাসী বলছেন ভিন্ন কথা। তারা বলেন-পৈতৃক সম্পত্তি লোভে লিয়াকতকে মানসিকভাবে অসুস্থ সাজানো হয়েছে। সুষ্ঠু চিকিৎসার অভাবে দীর্ঘদিন যাবৎ তার এ অবস্থা। তাকে উন্নত ও সঠিক চিকিৎসা প্রদান করা হলে এবং তার প্রতি যতœবান হলে সে সুস্থ হয়ে উঠবে বলে তারা মনে করেন।
মুন্সীবাজার ইউনিয়ন পরিষদের স্থানীয় ওয়ার্ড সদস্য সাইফুল ইসলাম বলেন, তাকে ভাল করার জন্য পরিবারের লোকজনের অবহেলাকে দায়ী করেন।
এ ব্যাপারে কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, বিষয়টি আমার জানা ছিলো না। গৃহবন্দী বা শিকলবন্দি অমানবিক। এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।