আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…

6

কাজিরবাজার ডেস্ক :
এ দেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামের বাঁকে বাঁকে রয়েছে নারীদের অসামান্য অবদান। শুধু অবদান নয় আছে সরাসরি অংশগ্রহণ। সেই সুবাদে বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনেও দেখা মিলেছে জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখার স্বরূপটি। আর মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার সেই অধিকার আদায়ে ঢাকাসহ দেশের নানা প্রান্তে দ্রোহের অনলে জেগে উঠেছিল বাংলার দুরন্ত সাহসী মেয়েরা। স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছেন মিটিং-মিছিলে। পোস্টার লাগিয়েছেন দেয়ালে দেয়ালে। ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্ন আটচল্লিশ থেকে বায়ান্ন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল তাদের সেই সংগ্রাম। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি উত্তাপময় মিছিলের মাধ্যমে তারাই ভেঙ্গে দিয়েছিল ব্যারিকেড বন্দী ১৪৪ ধারা। পুলিশের বন্দুকের নলকে উপেক্ষা করে অংশ নিয়েছিল রাজপথ কাপিয়ে তোলা পিকেটিংয়ে। অনেকেই আহত হয়েছেন। কেউ বা আহত সতীর্থদের সেবা দিয়েছেন। সরাসরি আন্দোলনে অংশ নিতে না পারা নারীদের অনেকেই নিজের অলঙ্কারসহ অর্থ সাহায্য দিয়ে কিংবা চাঁদা তুলে বেগবান করেছিলেন রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনকে। ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা আছে সেই সব ভাষাসংগ্রামী মেয়েদের বীরত্বগাথা।
১৯৪৮ সালেই মাতৃভাষার অধিকারের আদায়ের দাবিতে সোচ্চার হয়ে হয়ে ওঠে নারী সমাজ। ওই বছরের ৩১ জানুয়ারি ঢাকার বার লাইব্রেরিতে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সভায় জীবনবাজি রাখার সাহসী উচ্চারণ করেন ইডেন কলেজের ছাত্রী মাহবুবা খাতুন। তিনি বলেন, ‘বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র করার দাবি স্বীকার করিয়ে নেয়ার জন্য প্রয়োজন হলে মেয়েরা তাদের রক্ত বিসর্জন দেবে।’
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৫২ সালের ১১ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে পতাকা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। সে সময় ৫০০ পোস্টার লেখার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল নাদিরা বেগম ও ডাঃ সাফিয়াকে। তারা দুই বান্ধবী অন্যান্য ছাত্রীদের নিয়ে পোস্টার লেখার ব্যবস্থা করেন। এরপর একুশে ফেব্রুয়ারির হরতালেও নারী ভাষা সংগ্রামীরা রেখেছিলেন অনবদ্য ভূমিকা। সেদিন পুলিশের জারিকৃত ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন নারীরা। পুলিশের লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেলকে উপেক্ষা করে রওশন আরা বাচ্চুসহ কয়েকজন ছাত্রী ভেঙ্গে দেন ১৪৪ ধারা। তাদের মধ্যে অনেকেই আহত হয়েছিলেন। সেদিনের আন্দোলনে নির্ভীক ভূমিকা রেখেছিলেন লায়লা সামাদ, শামসুন নাহার, শাফিয়া খাতুন, সারা তৈফুর, সুফিয়া আহমেদ, রওশন আরা রহমান, হালিমা খাতুন, সুরাইয়া ডলি, সুরাইয়া হাকিম, কায়সার সিদ্দিকী প্রমুখ। আর ভাষার দাবিতে সংগ্রামে অংশ নিয়ে এদিন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন লায়লা নূর, প্রতিভা মুৎসুদ্দি, রওশন আরা রেনু, ফরিদা বারি, জহরত আরা, কামরুন নাহার লাইলি, হোসনে আরা, ফরিদা আনোয়ার ও তালেয়া রহমান সেদিনের আন্দোলনে অংশ নেয়া ছাত্রীরা ঢাকার তৎকালীন বকশীবাজার কলেজ (বর্তমান বদরুন্নেসা কলেজ), মুসলিম গার্লস স্কুল, বাংলা বাজার গার্লস স্কুল, কামরুন্নেসা গার্লস স্কুলে গিয়ে মেয়েদের আন্দোলনের জন্য উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করেন। একুশে ফেব্রুয়ারির পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারিও ভাষার দাবিতে রাজপথে নেমেছিল নারীরা। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ইউনিয়নের সভাপতি শাফিয়া খাতুনের সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীদের একটি সভা হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় আজিমপুর কলোনির মেয়েরা একটি প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে, যেখানে কমলাপুরসহ অন্যান্য এলাকা থেকে মেয়েরা যোগ দেন।
ভাষা আন্দোলনে ঢাকার মতোই নারায়ণগঞ্জে ছাত্রী ও নারীদের অংশগ্রহণ ছিল অনেক বেশি। এমনকি গৃহিণীরা অর্থ সাহায্যের মাধ্যমে বেগবান করেছেন ভাষার লড়াইকে। তৎকালীন এই মহকুমা শহরে নারীদের ভাষা সংগ্রামে সম্পৃক্তকরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংগঠকের ভূমিকা রেখেছিলেন মমতাজ বেগম। ১৯৪৮ সালের মার্চে এ্যাডওয়ার্ড কলেজ থেকে পাবনায় ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। বায়ান্নর আন্দোলনেও এই কলেজের শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় প্রশাসনের জারিকৃত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করেছিল তারা। সেখানে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। সেই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন সুফিয়া বেগম, জাহানারা প্রধান, নূরজাহান বেগম ও হালিমা খাতুন। রংপুরে সংঘটিত ভাষা আন্দোলনে ছাত্রীদের মধ্যে প্রতিবাদী রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন মাসুদা চৌধুরী, ডলি এবং একাত্তরের শহীদ হওয়া মিলি চৌধুরী ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যশোরে গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। এই পরিষদের নেতৃত্বে আটচল্লিশের ১১ মার্চের কর্মসূচীকে ঘিরে ১৪৪ ধারা জারি থাকলেও তা ভঙ্গ করা হয়। বের করা হয় মিছিল। এক মাইল লম্বা সেই মিছিলের হামিদা রহমানের নেতৃত্ব অংশ নিয়েছিলেন অসংখ্য ছাত্রী। ভাষা আন্দোলনের ঢেউয়ে বায়ান্নতে ফুঁসে উঠেছিল বরিশালও। মহিলা এবং ছাত্রীরাও সম্পৃক্ত হয়েছিলেন এই শহরের ভাষার সংগ্রামে। তাদের মধ্যে সামনের সারিতে ছিলেন মিসেস হামিদউদ্দিন, হোসনে আরা নীরু, মঞ্জুশ্রী, মাহে নূর বেগম ও রানী ভট্টাচার্য। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে নারীদের প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল সিলেটে। সেই সভায় বক্তব্য দিয়েছিলেন যোবেদা খাতুন। এছাড়াও সিলেটের ভাষা আন্দোলনে নারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন হাজেরা মাহমুদ, নজিবুন্নেছা, শাহেরা বানু, লুতফুন্নেছা, রাবেয়া খাতুন ও ছালেহা খাতুন।