রূপগঞ্জ ট্র্যাজেডিতে হত্যা মামলা, হাসেমসহ গ্রেফতার ৮ ॥ চারদিনের রিমান্ড ॥ অতিরিক্ত কেমিক্যালের ব্যবহার ও গেটের তালা না খোলাই কাল হলো ৫২ শ্রমিকের ॥ এখনও ৫৪ জন নিখোঁজ

11

কাজিরবাজার ডেস্ক :
অতিরিক্ত কেমিক্যালের ব্যবহার, গেট তালাবদ্ধ থাকায় অঙ্গার হলো হাসেম ফুড কারখানার অর্ধশতাধিক শ্রমিক। এ মর্মান্তিক ঘটনায় রূপগঞ্জের চারদিকে এখন শোকের মাতম। বিল্ডিং কোড না মেনেই এ ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে বলে জানায় ফায়ার সার্ভিস। এ ভবনটি নির্মাণের সময় কোন নিয়মই মানেনি কারখানা কর্তৃপক্ষ। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের সজীব গ্রুপের হাসেম ফুডসের কারখানায় অব্যবস্থাপনা ও নানা ত্রুটির কারণে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশ করতে না পারায় আগুন পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রায় ৪০ ঘণ্টা সময় লাগে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের। নিখোঁজের তালিকায় রয়েছেন ৫৪ জন। এখনও লাশের অপেক্ষায় নিহতদের স্বজনরা। নিখোঁজদের স্বজনরা তাদের খোঁজে কারখানা ও বিভিন্ন হাসপাতালে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এদিকে, ১০ জুলাই বিকেল ৫টায় ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার কাজ সমাপ্ত করা হয়। ঢাকা ফায়ার সার্ভিসের ডিডি দেবাশীষ রায় তাদের উদ্ধার কাজ সমাপ্ত করার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অর্ধশতাধিক শ্রমিক নিহতের ঘটনায় শনিবার
দুপুরে সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যানসহ ৮ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতদের আসামি করে হত্যা মামলা হয়েছে। রূপগঞ্জ থানায় ভুলতা ফাঁড়ির ইনচার্জ (ইন্সপেক্টর) মোঃ নাজিম বাদী হয়ে এ মামলা দায়ের করেন। গ্রেফতার হন- হাসেম ফুডের চেয়ারম্যান লক্ষ্মীপুর জেলার চন্দ্রগঞ্জ থানার বালুচরা এলাকার মৃত ইব্রাহীম মিয়ার ছেলে আবুল হাশেম (৭০), আবুল হাশেমের তার চার ছেলে হাসিব বিন হাসেম (৩৯), তারেক ইব্রাহিম (৩৫), তাওসিফ ইব্রাহিম (৩৩), তানজিব ইব্রাহিম (২১), বর্তমান ঠিকানা গুলশান-১, রোড নং-১৩, হাউস নং-৪, থানা গুলশান ডিএমপি ঢাকা, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কোট্টা থানার আতাউর রহমানের ছেলে শাহান শাহ আজাদ (৪৩), দিনাজপুর জেলার থানার নবাবগঞ্জ থানার হরিপুর এলাকার মৃত মনসুর আলীর ছেলে ডিজিএম মামুনুর রশীদ (৫৪), বরগুনা জেলার আমতলী থানার পশ্চিমচুনা খালী এলাকার আবু হানিফ খানের ছেলে এ্যাডমিন প্রধান সালাউদ্দিন (৩০)। এদিকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের সজীব গ্রুপের হাসেম ফুডসের কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৫২ জন নিহতের ঘটনায় গ্রেফতার আট আসামির প্রত্যেকের চারদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। নারায়ণগঞ্জ কোর্ট ইন্সপেক্টর আসাদুজ্জামান মিয়া এতথ্য নিশ্চিত করেন। ১০ জুলাই বিকেলে শুনানি শেষে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফাহমিদা খানমের আদালত এ আদেশ দেয়। এর আগে তাদের ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করে পুলিশ। সকালেই রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে জেলা পুলিশ হাসেম ফুডের চেয়ারম্যান আবুল হাসেমসহ আটজনকে গ্রেফতার করেছে বলে রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এএফএম সায়েদ জানান।
এদিকে, দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। রূপগঞ্জ উপজেলার সজীব গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড লিমিটেড কারখানার আগুনের ঘটনায় তদন্ত হবে এবং দোষীদের বিচার হবে। গাফিলতি বিন্দুমাত্র থাকলেও কারো ছাড় নেই। এছাড়া ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) জিল্লুর রহমান ও জেলা পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম পৃথক প্রেস ব্রিফিং করেন। আগুন নেভানো শেষে ভবনটির অনেকাংশে ফাটল ধরেছে আবার অনেক অংশ ধংসে পড়েছে। এতে করে ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণা দেয় ফায়ার সার্ভিস। এর আগে গত বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টার দিকে আগুনের সূত্রপাত হয়। আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে কাঞ্চন, আড়াইহাজার, পূর্বাচল, ঢাকা, নরসিংদীসহ ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট। এ ঘটনায় ৩টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শামিম বেপারীকে প্রধান করে ৫ সদস্যর একটি, ঢাকা ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক জুলফিকার রহমানকে প্রধান করে ৭ সদস্য ও কারখানার পরিদর্শককে প্রধান করে ৩ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার প্রথম দিনে নারীসহ তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এরপর শুক্রবার বিকেলে ভবনের চারতলা থেকে ৪৯ জনের লাশ উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। এ নিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ালো ৫২ জনে। উদ্ধার হওয়া লাশগুলো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। চেনার কোন উপায় নেই। স্বজনরা চাইলেও লাশ দেখে শনাক্ত করতে পারবেন না। ডিএনএ টেস্ট ছাড়া লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হবে না। তবে তিন সপ্তাহ পরে লাশ শনাক্ত হবে জানায় ফরেনসিক ডিপার্টমেন্ট কর্তৃপক্ষ।
প্রিস ব্রিফিংয়ে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) জিল্লুর রহমান বলেন, অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি হওয়া এই ভবনটিতে ত্রুটি ছিল। ভবন নির্মাণে মানা হয়নি কোন নির্দেশনা। এছাড়া ভবনে পর্যাপ্ত কোন ফায়ার এক্সিট পয়েন্ট ছিল না। ছিল না কোন অগ্নি নির্বাপণের ব্যবস্থা। আমরা আগুন নেভানো শেষে কয়েকটি ফ্লোর তালাবদ্ধ অবস্থায় দেখতে পেয়েছি। আমাদের উদ্ধার অভিযান শেষ হলে তদন্ত শুরু হবে। তারপর আগুনের সূত্রপাত ও অনিয়ম সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানা যাবে।
জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) জায়েদুল আলম বলেন, ভবনটি ত্রুটিপূর্ণ ছিল। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে রূপগঞ্জ থানায় ৮ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ঘটনায় চেয়ারম্যান আবুল হাসেমসহ ৮ জনকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।
এদিকে, এখন পর্যন্ত ৫৪ জনের কোন খোঁজ মেলেনি। নিহতের স্বজনরা দিগি¦দিক হয়ে কারখানা ও বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজাখুঁজি করছেন।
কারও ছাড় নেই – স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার সজীব গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড লিমিটেড কারখানার আগুনের ঘটনায় গাফিলতি বিন্দুমাত্র থাকলেও কারও ছাড় নেই। মামলা হবে, তদন্ত হবে এবং দোষীদের বিচার হবে। ইতোমধ্যে ৮ জন আটক হয়েছেন। শনিবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে একথা জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, একসঙ্গে এতগুলো লোকের প্রাণ হানিতে সারাবাংলাদেশ স্তব্ধ। আমরা দেখেছি প্রথমে তিনজন পরবর্তীতে মৃত উদ্ধার হয়েছে ৪৯ জন। আমাদের ফায়ার সার্ভিস কয়েকজনকে জীবিত উদ্ধার করেছে। হাসেম ফুড প্রোডাক্ট প্রতিষ্ঠানে কত লোক কাজ করছিল সব তদন্তে বের হবে। তারা কী করছিল সকল বিষয় নিয়েই আমাদের তদন্ত কমিটি হয়েছে। ডিসি তদন্ত কমিটি করেছেন এবং শ্রম মন্ত্রণালয়ও তদন্ত কমিটি করেছে। তদন্তের পরেই আমরা বলতে পারব এখানে কী ঘটেছে। এটি অত্যন্ত হৃদয়বিদারক ঘটনা। যারা ইন্তেকাল করেছেন আমরা তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। যে দুইজন এখনও জীবিত আছেন হসপিটালে আমরা আশাকরি তারা সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন। তাৎক্ষণিক যা করার দরকার ছিল ডিসি তা করেছেন। আরও যা যা করা দরকার তা আমরা করব।
মালিকপক্ষের দম্ভোক্তিতে ক্ষোভ : ৫২ জন শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনার পরও একটিবারের জন্যও আসেননি সজীব গ্রুপের মালিক পক্ষের কেউ। উল্টো প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান এমএ হাসেম শুক্রবার দম্ভের সঙ্গে বলেছেন এর দায় তার নয়। তিনি এ দায় নেবেন না। আর তা নিয়ে সকলের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী শোক প্রকাশ করেছেন, প্রধানমন্ত্রী সার্বক্ষণিক মনিটরিং করলেও মালিক পক্ষের এমন গা-ছাড়া ভাব নিহতদের স্বজন এবং স্থানীয়দের ব্যথিত করেছে। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কর্ণগোপ এলাকার হাসেম ফুড লিমিটেডের ছয়তলা ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের দুদিন পার হলেও তাদের দেখা বা বক্তব্য পাননি গণমাধ্যমকর্মীরাও। এ ব্যাপারে স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মী আতাউর রহমান সানি বলেন- ‘গত দু’দিন থেকে রাতদিন সংবাদ সংগ্রহের পাশাপাশি শ্রমিকদের উদ্ধারের কাজ করেছি। অঙ্গার লাশ দেখে চোখের জল ফেলেছি। সবাই সমবেদনা প্রকাশ করলেও হাসেম গ্রুপের কাউকেই সেখানে পাওয়া যায়নি।’ বৃহস্পতিবার (৮ জুলাই) বিকেল সাড়ে ৫টার পর রূপগঞ্জ উপজেলার কর্ণগোপ এলাকায় অবস্থিত সজীব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাসেম ফুডস-এর ‘সেজান জুস’ কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিটের ১১০ জন সদস্য আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করেন। শুক্রবার (৯ জুলাই) দুপুর ১২টা ৩৫ মিনিটে আগুন মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে আসে। এরপরই শুরু হয় মরদেহ উদ্ধারের কাজ। আগুনের ঘটনায় ৫২ জন নিহত হয়েছেন। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অধিকাংশ মরদেহই কারখানার দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ তলা থেকে উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস
অগ্নিকাণ্ডে নিহত বেশিরভাগই শিশু : নিখোঁজ শ্রমিকের স্বজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এদের অধিকাংশের বয়সই ১২ থেকে ১৮ বছরের নিচে। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী নিখোঁজ শ্রমিকরা হলেন, শান্তা (১২), মুন্না (১৪), শাহানা (১৫), নাজমুল (১৫), রিপন (১৭), রাহিমা (১৫), অমৃতা (১৭), তাকিয়া (১৪), হিমু (১৬), সুরিফা (১৩), আমেনা (১৭), মাহমুদ (১৫), তাসলিমা (১৭), কম্পা (১৬), শেফালি (১৭), ইসমাইল (১৫), নাইম (১৪) ও মোহাম্মদ আলী (১৬)। এদের কারও লাশই শনাক্ত করা যায়নি। আর নিহতের মধ্যে বাকিদের বয়স ১৮ এবং তার ওপরে।
লাশ উদ্ধার কাজ সমাপ্ত হলেও শনিবার অনেকেই তাদের স্বজনদের খুঁজতে মিলের আশপাশে আহাজারী করেছেন। সবইতো আঙ্গার হয়ে গেছে তবুও অলৌকিকভাবে সাভারের রানা প্লাজার রেশমার মতো করে কেউ যদি বেরিয়ে আসে সে আশায় বুক বেঁধে আছেন স্বজনরা। নিখোঁজ অমৃতার স্বামী সেলিম মিয়া বলেন, স্ত্রীর সঙ্গে সর্বশেষ তার কথা হয় ঘটনার দিন রাত ৮টায়। আগুন লাগার খবর শুনে কারখানার সামনে এসেছেন তিনি। বাসায় থাকা তাঁদের সাত মসের মেয়ে মায়ের অপেক্ষায় আছে। এখনও তার মা ঘরে ফিরেনি। আর কখনো ফিরবে কিনা সেটা সন্দেহই থেকে যায়। টিপু সুলতানও কি তার হারিয়ে যাওয়া ভাই ভাই মোহাম্মদ আলীকে খুঁজে পাবে? ঘটনার পরপরই বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টায় আগুন লাগার পর তার মুঠোফোনে দুবার ফোন করেছিলেন মোহাম্মদ আলী। জীবনের ভুলত্রুটির জন্য শেষবারের মতো ভাইয়ের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন তিনি। এরপর থেকে মোহাম্মদ আলীর মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। পোড়া হাড়গোড়ে খুঁজেছে ভাইয়ের চেহারা। খোঁজ মেলেনি। বেঁচে ফিরে আসা ভাইয়ের সহকর্মী টিপু বলেন, ‘আগুন লাগার পর আমি তাকে বলেছিলাম জানলার কাঁচ ভেঙ্গে পাইপ বেয়ে নিচে নেমে আসতে। কিন্তু মানুষের চাপে সেটা সম্ভব হয়নি। কালো ধোঁয়ার কারণে নিচে নামা যায়নি। তখন থেকেই মোহাম্মদ আলীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ১৩ বছরের শিশু শ্রমিক হালিমা আগুন থেকে বাঁচতে দোতলা থেকে লাফ দেয়। তাকে বাঁচানো যায়নি।
মেলেনি আম ও কমলার কোন অস্তিত্ব : নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের হাসেম ফুডের ৬তলা ভবনের কোথাও মেলেনি আম ও কমলার কোন অস্তিত্ব। শুধু কেমিক্যাল ও ফ্লেবার দিয়ে তৈরি হতো সজীব ম্যাংগো ও অরেঞ্জ ফ্লেবার ট্যাং বা জুস। ভবনের দ্বিতীয় তলায় তৈরি করা হতো এসব সফ্ট ড্রিংকস। পাশেই আবার কয়েক নামে তৈরি করা টোস্ট বিস্কুট। উৎপাদনের পাশাপাশি এখানেই বাজারজাতের জন্য প্যাকেটজাত করা হতো ড্রিংকস ও বিস্কুটের। সরেজমিন অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে তথ্য। আর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের এ মর্মান্তিক ঘটনায় রূপগঞ্জের চারপাশ শোকাহত।
সরেজমিন ঘটনাস্থলে গিয়ে ভবনে কর্মরত টেকনিশিয়ানদের সূত্রে জানা যায়, ভবনটির প্রথম তলায় (গ্রাউন্ড ফ্লোর) তৈরি হতো কার্টন, জারের (প্লাস্টিক বোতল) ক্যাপ ও উৎপাদিত ড্রিংকস, বিস্কুটসহ সকল পণ্যের বাজারজাত করার বড় বড় পলিথিন। এখানে কাগজ কার্টন করার প্যাকেজিং ব্যবস্থাও ছিল। দ্বিতীয় তলায় তৈরি হতো সজীব ম্যাংগো ও অরেঞ্জ ফ্লেবার ট্যাং সফ্ট ড্রিংকস ও টোস্ট বিস্কুট। তৃতীয় তলায় তৈরি হতো সজীব লাচ্ছি ও সজিব লিচি। চতুর্থ তলায় তৈরি হতো সজীব লাচ্ছা সেমাই, ডেইরিলান লাচ্ছা সেমাই ও নুডুল্স। পাশেই তৈরি করা হতো সজীব ললিপপ, ক্যান্ডি, চকোটকো ও নোসিলা। এখানেই আবার প্যাকেটজাত করা হতো এসব খাদ্যপণ্যের। ভবনের পঞ্চম তলায় ছিল কোম্পানির জেনারেল স্টোর। এখানে ঠেসে রাখা হতো খাদ্যপণ্য উৎপাদনের দামী দামী সব দাহ্য কেমিক্যাল ও তেলসহ প্রয়োজনীয় কাঁচামাল। জেনারেল স্টোরের পাশেই বিভিন্ন নামে তৈরি হতো ঝাল মুড়ি, মটরভাজা ও লাচ্ছা সেমাইসহ কিছু খাদ্যপণ্য। ষষ্ঠ তলায় ছিল সমস্ত মালামালের কার্টন করা গোডাউন। এ ভবনে নিয়ম বহির্ভূতভাবে রাখা হতো উৎপাদিত প্যাকেটজাত মালামাল ও কেমিক্যাল।
দুই হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করতেন কারখানাটিতে : কারখানার শ্রমিক ও ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, সজীব গ্রুপের কারখানাটি তিন শিফটে পরিচালিত হতো। সেখানে কাজ করেন দুই হাজারের বেশি শ্রমিক। কারখানাটিতে সেজান জুসের কর্ক ও লেভেল প্যাকেটিংয়ের কাজ করা হতো। বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টা ৪২ মিনিটে আগুনের সূত্রপাত ঘটে নিচতলায়। ভবনটির ছাদ থেকে ২৫ জনকে জীবিত উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস। তবে জীবন বাঁচাতে গিয়ে অনেক শ্রমিক ভবনের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আহত হন। নিহতও হন কয়েকজন, যাদের হাসপাতালে নেয়ার পর মৃত ঘোষণা করা হয়।
শাস্তির দাবি ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের : নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের হাসেম ফুড এ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে অর্ধশতাধিক শ্রমিক নিহতের ঘটনার প্রতিবাদ ও কারখানা মালিকের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ করেছে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ।
কারখানাটি দাহ্য পদার্থে ঠাসা ছিল : নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুড এ্যান্ড বেভারেজের কারখানায় দাহ্য পদার্থে ঠাসা ছিল বলে পুলিশ দাবি করছে। কারখানাটিতে দাহ্য পদার্থ থাকায় তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন ফ্লোরে। রাসায়নিক কেমিক্যাল, আঠা এবং ভোজ্যতেল থাকার কারণেই মূলত আগুনের লেলিহান ভয়ঙ্কররূপ ধারণ করে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছে।
নিহতদের পরিবার ২ লাখ এবং আহতরা পাবেন ৫০ হাজার -শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী : শনিবার বিকেলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে করে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান। প্রত্যেকের পরিবারকে শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল থেকে নিহতদের ২ লাখ এবং চিকিৎসাধীন আহত শ্রমিকদের আগামীকালই ৫০ হাজার টাকা করে চিকিৎসা সহায়তা দেয়া হবে তিনি জানান। চিকিৎসাধীন শ্রমিকদের এখনই সে অর্থ প্রদান করার কথা বলেন মন্ত্রী। অগ্নিকাণ্ডে নিহত শ্রমিকদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর নিহতদের জনপ্রতি ২ লাখ টাকা দেয়ার কথা জানান।