জীবন বাঁচাতে রক্তদান ॥ আইনী ও ইসলামী দৃষ্টিকোণ

19
Medical aid donate blood isolated icon charity and donation vector save life campaign hand or palm and drop emergency transfusion, healthcare injured people help hemoglobin level emblem or logo

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

(পূর্ব প্রকাশের পর)
লাইসেন্স ব্যতীত বেসরকারী রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনা; ভুল ব্যবস্থাপত্র প্রদান; অননুমোদিত পদ্ধতিতে রক্ত পরিসঞ্চালন; বিনষ্টযোগ্য উপকরণ বিনষ্ট না করা এবং তা পুনরায় ব্যবহার করা; অনিরীক্ষিত রক্ত পরিসঞ্চালন করা; অননুমোদিত উপায়ে রক্ত, রক্তের উপাদান ও রক্তজাত সামগ্রী সংগ্রহ, উৎপাদন ও বিতরণ করা’ অননুমোদিত ব্যক্তি কর্তৃক রক্ত পরিসঞ্চালন করা; রক্তদাতার ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করা এবং অতিরিক্ত সেবা ফিস আদায় করা এই আইন অনুসারে দ-নীয় অপরাধ। উল্লিখিত অপরাধসমূহের যে কোন একটি বা একাধিক অপরাধ সংঘটনের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি বিচারান্তে দোষী সাব্যস্ত হলে সশ্রম কারাদ- অথবা জরিমানা অথবা উভয় দ-ে দ-িত হবে। এ আইনের অধীনে সংঘটিত সকল অপরাধ অআমলযোগ্য (Non-cognizable),  জামিনযোগ্য, আপোষযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। মামলা দায়ের করতে হবে বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। এই আইন অনুসারে কৃত অপরাধের বিচারের জন্য মামলা করতে পারবেন (ক) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং তার অবর্তমানে মহা-পরিচালকের দায়িত্ব পালনরত কোন কর্মকর্তা অথবা তার কাছ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন কর্মকর্তা এবং (খ) ক্ষতিগ্রস্থ কোন ব্যক্তি বা তার প্রতিনিধি। এরা ছাড়া আর কেউ এসব বিষয়ে মামলা দায়ের করতে পারবে না। অভিযোগ দায়ের করতে হবে লিখিতভাবে।
এছাড়া নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন আইন ২০০২-এর আলোকে ২০০৮ সালে প্রণীত হয় রক্তদান বিধিমালা। এতে সরকার অথবা যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক রক্তবাহিত রোগ নির্ণয়, রক্তের অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও রক্ত সংরক্ষণ এসব কাজের জন্য প্রয়োজনীয় রিএজেন্ট, রক্তের ব্যাগ ইত্যাদি সরবরাহ নিশ্চিত করা বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
রক্তদান ও পরিসঞ্চালনের শরয়ী বিধানঃ কোন বিশেষ মুহুর্তে স্বেচ্ছায় সুস্থ রক্তদাতার দেহ থেকে রক্ত সরবরাহ করে গ্রহীতার দেহে পরিসঞ্চালনের মাধ্যমে রোগীর জীবন রক্ষা করা অত্যাবশ্যক হয়ে ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে চিকিৎসকরা নিরাপদ বিশুদ্ধ রক্ত পরিসঞ্চালনের জন্য পরামর্শ প্রদান করেন। রক্তদান প্রসঙ্গে আলিমদের মধ্যে দুটি মত প্রচলিত রয়েছে। নিম্নে তাদের মত দুটি প্রমাণসহ বিশ্লেষণ করা হলোÑ
এক. রক্তদান বৈধ নয়: অনেক আলিমের মতে, ইসলামে রক্তদান বৈধ নয়। তাঁদের দলীল ও যুক্তিগুলো হলো-
ক. খাদ্য হিসেবে রক্ত নিষিদ্ধঃ আল্লাহ তা’আলা প্রবাহিত রক্ত অর্থাৎ শিরা ও ধমনীর টাটকা রক্ত খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন:
তিনি তোমাদের জন্য হারাম করেছেন মৃত জীব, প্রবাহিত রক্ত (কাঁচা বা রান্না করে) শূকর এবং যেসব জীব-জন্তু আল্লাহ তা’আলা ছাড়া অন্য কারো নামে উৎসর্গ করা হয়। কিন্তু যদি কেউ নিরুপায় হয়ে পড়ে এবং ইচ্ছাকৃতভাবে সীমালংঘনকারী না হয়, তাহলে তার কোন অপরাধ হবে না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা’আলা ক্ষমাশীল ও অত্যন্ত দয়াবান।
তিনি আরও বলেন, তুমি বলে দাও, আমার কাছে যে ওহী পাঠানো হয়েছে তার মধ্যে এমন কোন হারাম জিনিস আমি পাচ্ছি না যা একজন ভোজনকারী মানুষ সচরাচর খেয়ে থাকে; কিন্তু মৃত বা প্রবাহিত রক্ত অথবা শূকরের মাংস নিষিদ্ধ। কেননা এসব অপবিত্র- অথবা বা অবৈধ আল্লাহ ছাড়া অন্যের নাম নেওয়ার কারণে। তবে কেউ যদি অবাধ্য না হয়ে এবং সীমালংঘন না করে তা গ্রহণে বাধ্য হয়, তাহলে তোমার প্রতিপালক অবশ্যই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
তিনি তোমাদের উপর হারাম করেছেন মৃত, প্রবাহিত রক্ত ও শূকরের গোশত এবং এমন জানোয়ার যার ওপর আল্লাহ তা’আলা ছাড়া অন্য কারো নাম নেয়া হয়েছে, কিন্তু যদি কাউকে বাধ্য করা হয়, সে যদি সীমালংঘনকারী না হয়, তাহলে আল্লাহ তা’আলা ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।
খ. নিষিদ্ধ খাদ্য দ্বারা চিকিৎসা নিষিদ্ধঃ ইসলামী শরী’আতে যেসব খাদ্য ও পানীয় নিষিদ্ধ তা ঔষধ হিসেবে গ্রহণও নিষিদ্ধ। আবুদ দারদা রা. বলেন, রাসূল স. বলেন, নিশ্চয় রোগ ও ঔষধ আল্লাহ প্রদত্ত দুটি জিনিস। তিনি প্রত্যেক রোগের নিরাময় ব্যবস্থা করেছেন; সুতরাং তোমরা চিকিৎসা গ্রহণ কর; তবে হারাম কোন কিছু দ্বারা চিকিৎসা নিও না।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেনঃ রাসূল স. অপবিত্র ঔষধ থেকে নিষেধ করেছেন। নিষিদ্ধ জিনিসের মধ্যে আরোগ্য দানের ক্ষমতা নেই। ইসলামী শরীয়তে মদ একটি হারাম পানীয়। স্বাভাবিকভাবে তাই মদ দিয়ে ঔষধ গ্রহণও হারাম। এ সম্পর্কে তারেক বিন সুয়াইদ রা. বলেন, রাসূল স. কে মদ ব্যবহার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি তা ব্যবহার করতে নিষেধ করেন। তখন প্রশ্নকারী বলল, আমিতো এটা ঔষধ হিসেবে তৈরি করেছি। তখন রাসূল স. বললেন, মদ কখনো ঔষধ হতে পারে না, বরং সে নিজেই রোগের উপাদান।
গ. আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের যুক্তিঃ ইসলামী শরীয়া কর্তৃক শরীরের অভ্যন্তরে খাদ্য হিসেবে অপবিত্র বস্তু প্রবেশ নিষিদ্ধ করার স্বপক্ষে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান স্বীকৃত যৌক্তিক কারণও রয়েছে। সাধারণত খাদ্য পাকস্থলীতে পরিপাক হয় এবং এর সারাংশ রক্তের মাধ্যমে শরীরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে ধমনী বা শিরায় কোন কিছু প্রবেশ করানোর পর তা সরাসরি রক্তের মাধ্যমে দ্রুত ও সহজেই শরীরের সর্বত্র পরিচালিত হয়। এভাবে রক্তের মাধ্যমে জানা ও অজানা বিভিন্ন রোগের জীবাণু একজনের দেহ থেকে অন্যের দেহে প্রবেশ করতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণার আলোকে জানা যায় যে, প্রবাহিত রক্তের মাধ্যমেও হেপাটাইটিস-বি ও সি, এইডস ও আরও অনেক জানা অজানা প্রাণঘাতী রোগ সংক্রমিত হয় এবং মহামারির আকার ধারণ করতে পারে। কোন প্রাণী জবাই করার পর যে রক্ত বের হয়ে আসে তাতে বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান, জমাট বাঁধার উপাদান  (Heparin), Toxin  ও বিভিন্ন  Pathogenic micro-organism  থাকে। এগুলো প্রাণীদেহের ভিতরে থাকা অবস্থায় প্রাণীদেহের সুস্থতায় ভূমিকা রাখে। কিন্তু এসব পদার্থ খাদ্য হিসেবে খুবই ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত। এ কারণেই আল্লাহ তা’আলা রক্ত খাওয়া নিষিদ্ধ করেছেন।
মূলত আল্লাহ তা’আলা এসব বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেয়ার জন্যই পশু-পাখি জবাই করে রক্ত বের করে দেয়ার আদেশ দিয়েছেন। খাদ্য হিসেবে রক্ত নিষিদ্ধ হওয়ার এ বৈজ্ঞানিক কারণটি অনেক গবেষণার পর সুস্পষ্ট হয়েছে। তাই রক্ত সংস্পর্শের ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বনের জন্য চিকিৎসা ক্ষেত্রে ডিম্পোসিবল্-সিরিঞ্জ ব্যবহৃত হচ্ছে। একজনের ব্যবহৃত সুঁচ যেন অন্যের দেহের সংস্পর্শে না আসে সেজন্য সেমিনার, ব্যানার, পোস্টার ও লেখালেখির মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করে তোলা হচ্ছে।
দুই. রক্তদান বৈধঃ বর্তমান সময়ের অধিকাংশ আলিম ও ফিকহ বোর্ডের সিদ্ধান্ত মতে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রক্তদান ও পরিসঞ্চালন বৈধ। এমত পোষণকারীদের মধ্যে রয়েছে, মিসরের আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাতওয়া কমিটি, সৌদী আরবের বিদগ্ধ আলিমগণের সংস্থা “হাইয়াতু কিবারিল উলামা”, রাবিতাতুল আলাম আল-ইসলামী অধিভুক্ত ফিকহ কমিটির সিদ্ধান্ত।
তাদের দলীল ও যুক্তিগুলো হলো-
ক. জীবন রক্ষা একটি গুরুত্ব দায়িত্বঃ ইসলামী শরীয়ার একটি প্রধান লক্ষ্য হল ‘হিফজুন নাফ্স’ বা জীবন রক্ষা করা, যা চিকিৎসা বিদ্যার প্রাথমিক এবং মৌলিক উদ্দেশ্য। পবিত্র কুরআন মানুষের জীবন রক্ষাকে এক গুরু দায়িত্ব হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন- কোনো ব্যক্তি যদি এমন কোনো লোককে হত্যা করে, যে লোক কাউকেও হত্যার অপরাধে অপরাধী নয়, কিংবা পৃথিবীতে বিপর্যয়ও সৃষ্টি করেনি; সে (হত্যাকারী) যেনো পুরো মানব জাতিকেই হত্যা করলো। আর যে তাকে বাঁচিয়ে রাখে সে যেনো পুরো মানব জাতিকে বাঁচালো।
পবিত্র কুর’আন এ আয়াতে একজন মানুষের জীবন রক্ষাকে পুরো মানবজাতির জীবন রক্ষার সমকক্ষ বলে ঘোষণা করেছে। অন্যকথায় কোনো মানুষ যদি মানুষের জীবন রক্ষার জন্য চেষ্টা করে তাহলে সে পুরো মানব জাতিকে জীবিত রাখার কাজ করে।
খ. সংকট নিষিদ্ধতাকে বৈধ করেঃ ইসলামী শরীয়া জীবন নাশের হুমকি মোকাবিলায় সংকটময় সময়ের জন্য যে কোন নিষিদ্ধতাকে সাময়িকভাবে বৈধ করেছে। এরূপ পরিস্থিতিতে ‘ক্বাওয়ায়িদ আশ-শরীয়ায়’ বর্ণিত জরুরি’ অবস্থায় মৃত প্রাণীর গোশত খাওয়ার অনুমোদনের সাথে তুলনা করা যায়। জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলার বিধান অন্য স্বাভাবিক অবস্থায় নিষিদ্ধ বা নিরুসাহিতকৃত পদ্ধতিকেও অনুমোদন করে।
তাই গুরুতরভাবে অসুস্থ ও দুর্বল কোন রোগীর জীবন রক্ষার্থে কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সেই রোগীর শরীরে রক্ত সরবরাহ অর্থাৎ ব্লাড ট্রান্সফিউশন করা অত্যন্ত জরুরি বলে পরামর্শ দিলে সংকটকালীন রক্তদান বৈধ হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
কিন্তু যদি কেউ নিরুপায় হয়ে পড়ে এবং ইচ্ছাকৃতভাবে সীমালংঘনকারী না হয়, তাহলে তার কোন অপরাধ হবে না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা’আলা ক্ষমাশীল ও অত্যন্ত দয়াবান। (অসমাপ্ত)