শিয়া মসজিদে হামলা : নতুন চ্যালেঞ্জে বাংলাদেশ

17

কাজিরবাজার ডেস্ক :
সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অবস্থানের মধ্যেই বাংলাদেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে নতুন সংযোজন হচ্ছে শিয়াদের ওপর রক্তাক্ত আক্রমণ। এর আগে শিয়া সম্প্রদারের ওপর হামলার কথা শোনা গেছে ইরাক-ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে।
গত আশুরার আগের রাতে রাজধানীর হোসেনি দালানে মিছিলের প্রস্তুতি নেয়ার সময় গ্রেনেড হামলা চালিয়ে মানুষ হত্যার মধ্যদিয়ে শিয়াদের ওপর হামলার ঘটনা শুরু। সর্বশেষ বৃহস্পতিবর রাতে বগুড়ায় শিয়া মসজিদে ঢুকে দুর্বৃত্তদের এলোপাথারি গুলিতে একজন নিহত হয়। এটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ।
শত শত বছর ধরে এই অঞ্চলে শিয়া-সুন্নির মধ্যে কেউ কোনো তফাতও খুঁজতে যায়নি। বাংলাদেশে শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য নয়। তেমনি রাজনীতিতেও তাদের কোনো সরব উপস্থিতি নেই।
“দেশে আইএস আছে, আইএস নেই” এমন বিতর্কের মধ্যে এমন হামলা নতুন উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। এর আগে একের পর এক ব্লগারদের ওপর হামলা, বিশিষ্টজনদের হুমকি প্রদান, বিদেশি নাগরিকদের হত্যা, বিভিন্ন আধ্যাত্মিক ধর্মীয় নেতাদের হত্যার পর শিয়াদের ওপর হামলার মধ্যে অনেকে যোগসূত্রও দেখতে পাচ্ছেন।
যদিও এসব হামলা নিয়ে সরকার বলছে, অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে যে ষড়যন্ত্র চলছে এরই অংশ হিসেবে শিয়াদের ওপর হামলা করা হচ্ছে। গ্রেফতার করা হচ্ছে হামলায় জড়িতদের।
আর বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে উগ্র ধর্মীয় মতাদর্শ উৎসারিত সন্ত্রাস, সহিংসতা যেটা আগে অনুপস্থিত ছিল এখন সে পরিস্থিতির একটা পরিবর্তন ঘটছে। আর শিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ধর্মীয় সম্প্রদায়গত সহিংসতার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) নজরুল ইসলাম বলেন, অন্যান্য ঘটনার মতো শিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনাকেও সরকার গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। এর জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থাপনা নেই। সবাইকে নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব সরকারের। যার যতটুকু নিরাপত্তা দরকার সরকার সে ব্যবস্থা করছে।
এদিকে এসব হামলার পরপরই অপরাধীদের গ্রেফতারের দাবি জানাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোও ফলাও করে এই সংবাদ প্রচার করছে।
এদিকে হামলার পর থেকে প্রথম ঘটনাস্থল হোসেনি দালানে এখনও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাহারা আছে। ঘটনায় জড়িত সন্দেহে বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। বুধবার রাতে এমন একজন পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। বগুড়ার ঘটনায়ও দুজনকে আটক করা হয়েছে। কিন্তু প্রথম ঘটনার পর সরকারের পদক্ষেপে শিয়া সম্প্রদায়ে কিছুটা স্বস্তি ফিরলেও নতুন হামলায় আবার উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
হোসাইনী ট্রাস্ট মোহাম্মদপুর শিয়া মসজিদের সভাপতি রাশেদ হায়দার বলেন, ‘কোনো ঘটনার পরপরই সরকার তদন্ত করছে। আসামিদেরও গ্রেফতার করছে ঠিক কিন্তু নতুন করে হামলা হচ্ছে। এ দেশে এমনটা ভাবতে পারছি না।’
অন্যদিকে হোসেনি দালানের বোমা হামলার পর সরকারের পদক্ষেপে সন্তোষ প্রকাশ করে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ রজব আলী বলেন, ‘সরকার আমাদের ভালো সাপোর্ট দিয়েছে। এর ফলে নিরাপত্তাহীনবোধ না করলেও কিছুটা অস্বস্তি তো থাকবেই।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দেশে আইএসের অস্তিত্ব আছে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তবে কোনো মুসলমান এসব করতে পারে না।’
সম্প্রতি বিবিসির এক প্রতিবেদনে শিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতির অধ্যাপক ডক্টর আলী রীয়াজ বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে সামগ্রিকভাবে সেকটেরিয়ান ভায়োলেন্স বা ধর্মীয় সম্প্রদায় গত সহিংসতার নজির ছিল না। দুঃখজনক হচ্ছে রাষ্ট্র যখন কাউকে নিরাপত্তা দিতে পারে না, তখন যারা মনে করে সংখ্যালঘুদের ওপর তারা হামলা চালাতে পারবে, তারা সুযোগটা গ্রহণ করে।’
পাকিস্তানের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাত ও সুন্নি গোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন রকম জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থানের পেছনে মূল কারণ ছিল সে সময় রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা ছিলেন তারা নিজেদের ক্ষমতার ভিত শক্ত করতে যখন ব্যস্ত ছিলেন তখন সেই সুযোগে ধর্মীয় সম্প্রদায় গত সহিংসতার বীজ বপন হয়েছে।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ বলেন, এই ধরনের হামলা করে দেশের মধ্যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে অসাংবিধানিক সরকারের ক্ষেত্র তৈরির ষড়যন্ত্র চলছে। আর এতে সহযোগিতা করছে উন্নয়ন সহযোগীরা।’
তিনি এসব বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সবাইকে নিরাপত্তা দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, এক্ষেত্রে অবশ্যই বড় বড় যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেফতার করে বিচার করতে হবে।
অন্যদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান মনে করেন, ‘সমাজে অস্থিরতার কারণেই শিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে। এই ধরনের হামলা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এ ঘটনায় তারা উদ্বিগ্ন।
তিনি বলেন, ‘দুই বিদেশি ও একজন এএসআইকে হত্যার পর শিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনায় দেশ আজ স্তম্ভিত। এ ঘটনাগুলোর কারণে বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।’