সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক বলেছেন, এক-এগারোর সময় সাংবাদিক আহমেদ নূর কারারুদ্ধ হয়েছিলেন, র্যাবের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। সেসব ঘটনা নিয়ে তিনি একটি অসাধারণ বই রচনা করেছেন। তাঁর পাঁচমাসের ব্যক্তিগত কারাবাস থেকে শুরু করে কারাজীবন, কারা পরিস্থিতি আর ওই সময়ে দেশে কী ঘটনা ঘটেছিলÑবইয়ে তা স্থান পেয়েছে। বইটি দুঃসময়ের একটি প্রামান্য দলিল।
গত শুক্রবার বিকেল পাঁচটায় সিলেট জেলা পরিষদ মিলনায়তনে সিলেট প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও কালের কণ্ঠের সিলেট ব্যুরোপ্রধান আহমেদ নূর রচিত ওয়ান-ইলেভেন : কারারুদ্ধ দিনগুলো বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেছেন। প্রকাশনা উদ্যাপন পর্ষদের আহ্বায়ক প্রবীণ শিক্ষাবিদ মো. আব্দুল আজিজের সভাপতিত্বে প্রধান আলোচকের বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. মো. আনোয়ার হোসেন।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা দেন সিলেটের মেট্টোপলিটন ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ড. মো. সালেহ উদ্দিন, কবি ও সংসদ সদস্য কাজী রোজী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠশিল্পী বুলবুল মহলানবীশ, জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতিসণ্ডলীর সদস্য কবি আসলাম সানী ও গীতিকবি পরিষদের সভাপতি এম আর মন্জু। স্বাগত বক্তব্য দেন প্রকাশনা উদ্যাপন পর্ষদের সদস্য সচিব নাট্যব্যক্তিত্ব নিজামউদ্দিন লস্কর।
প্রধান অতিথির বক্তৃতায় সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক আরও বলেন, এক-এগারোর সময় সাংবাদিক আহমেদ নূর কারারুদ্ধ হয়েছিলেন, র্যাবের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। সে সময়টাতে একজন সামরিক কর্মকর্তা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে। একজনকে ধরে ১০ জনকে কাবু করার প্রচেষ্টা চালায়। নূর একজন সৎ সাংবাদিক হিসেবে স্থানীয়ভাবে পরিচিত। তাই তাকে ধরে অপর সাংবাদিকদের চুপ করানোর একটা প্রক্রিয়া করা হয়েছিল। নূর সেসময়কার স্মৃতিচারণা করে একটি বই রচনা করেছেন। আমি যদি সেই ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তি সময়ের কোন তথ্য খুঁজতে চাই তাহলে আর পত্রিকা ঘাটাঘাটির প্রয়োজন হবে না। আহমেদ নূরের বইটি খুঁজলে সে তথ্য পেয়ে যাবো। এ বইটি আমাদের ছুঁয়ে গেছে।
প্রধান আলোচকের বক্তব্যে অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তি সামরিক সরকার আমাকেও কারারুদ্ধ করেছিল। তাই নূরের বেদনা আমি অতি সহজেই বুঝতে পারি। তিনি একজন সাংবাদিকের অনুসন্ধিৎসু চোখ দিয়ে কারাগারের অভ্যন্তর ও ওয়ান ইলেভেন সময়কে দেখেছেন এবং নির্মোহচিত্তে স্মৃতিকথা লিখে সময়টাকে ধরে রেখেছেন। তাঁর বইটি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সেই অন্ধকার কালো সময়ের দিনলিপি হিসেবে বেঁচে থাকবে। তিনি বইটিকে ‘দুঃসময়ের জীবন্ত দলিল’ আখ্যায়িত করে বলেন, পুস্তকটির বর্ণনা হৃদয়গ্রাহী। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে সেই ভীতিকর অস্থির সময়ের রাজনীতির বস্তুনিষ্ঠ চিত্র।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. সালেহ উদ্দিন গ্রন্থটিকে ‘এক বৈরী সময়ের উপাখ্যান’ উল্লেখ করে বলেন, তাৎক্ষণিকভাবে জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য জলপাই শাসকরা যা করেন ওয়ান ইলেভেনের কুশিলবরা তাই করেছেন। ওই সময়ে কত নির্দেষ মানুষ নিগৃহ হয়েছেন তার কোন তালিকা নেই। তাদের কষ্টের কাহিনিও জানা যায়নি। আহমেদ নূরের বইটি সেই অভাব খানিকটা লাঘব করেছেন। ভবিষ্যতে যারা এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করবেন তাদের কাজ সহজ করে দিয়েছেন আহমেদ নূর।
বিশেষ অতিথি কবি ও সংসদ সদস্য কাজী রোজী বলেন, আমি বইটি পড়েছি। প্রথমে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল আহমেদ নূর এতো সাহস কোথায় পেলেন। বইটি শেষ করে বুঝতে পারলাম তিনি সাহসটি কোথায় পেয়েছেন। কারণ তিনি তাঁর লেখায় বলে দিয়েছেন তাঁর সাহসের উৎস। আর সেই সাহস হচ্ছে তাঁর নৈতিক শক্তি ও সততা। একজন সাংবাদিকের অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে ভেতর-বাইরের এমনসব ঘটনাবলি ও পর্যবেক্ষণ বইটিতে স্থান পেয়েছে যা ভবিষ্যতের জন্য এক দলিল হয়ে থাকবে। তাঁর এই গ্রন্থটি আমাদের জাতীয় রাজনীতির এক অনুপম ইতিহাস বলে আমি মনে করি।
বিশেষ অতিথি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠশিল্পী বুলবুল মহলানবীশ বলেন, আমাদের উপমহাদেশে কারাবাস কতো অমানবিক হতে পারে তার চিত্র তুলে এনেছেন আহমেদ নূর তাঁর গ্রন্থে। সিনেমা নাটকের চেয়েও অনেক অনেক অমানবিক চিত্র এখানে উঠে এসেছে। বইয়ের সত্যময়তা ও মানবিক বোধ থেকে বলতে পারি বইটি সকালের জন্য অবশ্য পাঠ্য বইয়ে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, একজন সৎ সাংবাদিকের তীক্ষ্ম দৃষ্টি এবং একজন নিরপেক্ষ মানুষের মানবিক দৃষ্টির সমন্বয়ে স্মৃতিধর্মী দিনপঞ্জির অবয়বে বইটি হয়ে উঠেছে সেই বৈরী সময়ের এক অসামান্য দলিল।
জাতীয় কবিতা পরিষদের সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য বিশিষ্ট কবি আসলাম সানী বলেন, এই বইটি মহাকালের, দেশের একটি বন্ধ্যা সময়ের প্রামাণ্য দলিল। প্রতিটি ঘরে ঘরে লাইব্রেরিতে রাাখার মতো। বইটি অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ করার পরামর্শ দিয়ে সানী বলেন, এতে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মানুষ আমাদের কারাগার ও সেই সময়ের চিত্র জানতে পারবে। বিজ্ঞপ্তি