“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র“য়ারী, আমি কি ভূলিতে পারি”-প্রতি বছর আমাদের মাঝে একুশ বারে বারে ঘুরে আসে। একুশ আমাদের মনের চেতনা, হৃদয়ের উপলব্দি ও জাতীয় সংস্কৃতির অন্যতম চিহ্ন। মায়ের ভাষা মুখের ভাষার জন্য সংগ্রাম আমাদেরকে সব সময় উদ্দিপ্ত করে। একুশ না আট ফালগুন এ বিতর্কে না জড়িয়ে জাতির জাতীয় সমৃদ্ধ এ চেতনাকে আমরা লালন করি এবং এর আলোকে বিকশিত করি নতুন প্রজন্মকে।
মহান একুশে ফেব্র“য়ারী বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় (জবফ-ষবঃঃবৎ-ফধু)দিন। ১৯৫২ সালের এদিনে আমাদের মাতৃভাষার অস্তিত্বকে ঠিকিয়ে রাখার জন্য রমনার রক্তিম কৃষ্ণচূড়া আর লক্ষ লক্ষ পলাশকে সাক্ষী রেখে নিজেদের জীবনের বিনিময়ে বাংলা মায়ের দামাল ছেলরা ঢাকার পিচঢালা কালো রাজপথকে রক্তে রঞ্জিত করেছিল। শুধু মায়ের ভাষার জন্য সংগ্রাম হয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম ঘটনা বিরল। আমাদের স্বাধীনতার রক্তিম সকালে পৌঁছাতে যে চেতনা সবচেয়ে বেশী কাজ করেছে তা হলো বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের চেতনা।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করেছিল। তখন আমাদের বাংলাদেশ পরিচিত ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামে। শুরু থেকেই পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠি পূর্বাঞ্চলের প্রতি বৈষম্যের সৃষ্টি করে। তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যে প্রতিয়মান হয় যে পূর্বাঞ্চল পশ্চিমাদের জন্য একটি মাথাব্যথা। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ হলেন প্রথম গভর্নর জেনারেল। তিনি ১৯৪৮সালের মার্চ মাসে একবার ঢাকা সফরে এলেন। ২১ মার্চ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে এক বিরাট জনসভায় তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে মর্যাদা দেওয়ার ইংগিত দিলেন। এক দু’দিন পর ২৪মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি ঘোষণা করলেন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ এ ঘোষণা শোনার পরই এদেশের তরুণ ছাত্রসমাজ তীব্র প্রতিবাদ জানাতে শুরু করলো। মূলত ভাষা আন্দোলনের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের সূচনা এখান থেকেই।
ইতিহাস থেকে যতটুকু জানা যায়, ১৯০১ সালের রংপুরের প্রাদেশিক শিক্ষা সম্মেলনে সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, ১৯১৮ সালে বিশ্ব ভারতী সম্মেলনে ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ, ১৯৩৭ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে মাওলানা আকরাম খাঁ, ১৯৪৫সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হলের সাহিত্য সম্মেলনে বাংলাকে এ অঞ্চলের রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানানো হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলনে নিবেদিত ‘তমদ্দুন মজলিস’ নামক সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১ অক্টোবর তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে প্রথম ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। এর আহ্বায়ক মনোনীত হন অধ্যাপক এ এস এম নুরুল হক ভূঁইয়া। ১৯৪৮ সালে গণ পরিষদে লিয়াকত আলী (প্রধানমন্ত্রী) ও খাজা নাজিমুদ্দিন (মুখ্য মন্ত্রী) এর বক্তব্যের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র/ছাত্রীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ৪৮, ৪৯, ৫০, ৫১ সালে দেশব্যাপী হরতাল, ধর্মঘট ও প্রচন্ড প্রতিবাদের ঝড় উঠে। সর্বাত্মক বিক্ষোভ আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে গ্রেফতার হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ডাকসুর তৎকালীন জিএস গোলাম আযম সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের ঢাকার পল্টনের জনসভায় ঘোষনা করে ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ এর প্রতিবাদে ঢাকায় ৪ঠা ফেব্র“য়ারী পালিত হয় ছাত্র ধর্মঘট। এ জন্য ১১ই ফেব্র“য়ারী প্রস্তুতি দিবস এবং ২১শে ফেব্র“য়ারী দেশব্যাপী ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হলো। এই সিদ্ধান্ত বানচালের উদ্দেশ্যে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী ২০শে ফেব্র“য়ারী বিকেলে টানা ৩০দিনের ১৪৪ধারা জারি করে। ২১শে ফেব্র“য়ারী সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে আমতলায় এক বিরাট ছাত্র সমাবেশে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সে সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নুরুল আমীন। ২১শে ফেব্র“য়ারী মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা ১৪৪ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করল। বিকাল ৩.৩০টার সময় আকস্মাৎ পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে মিছিলের উপর গুলি চালাল। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার আরও নাম না জানা অনেকে। পরে তাদের লাশ নিয়ে শোভাযাত্রা বের হলে তাতেও গুলি চলে। সেখানে শহীদ হন শফিউর রহমান। এ হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে বিক্ষোভের আগুন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। মিছিলে গুলি বর্ষন ও ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ২২শে ফেব্র“য়ারী সারাদেশে হরতাল পালিত হয়। এমতাবস্থায় পশ্চিমা শাষকগোষ্ঠী আন্দোলনকে আর কোনভাবেই বন্ধ করতে পারলেন না। দাবী মেনে নিতে হলো-বাংলার আপামর ছাত্রজনতার। বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করলো। পুলিশের গুলিতে যে স্থানে ভাষা সৈনিকেরা শহীদ হয়েছিলেন সেখানে গড়ে উঠলো কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। এই মিনারটি উদ্বোধন করেছিলেন শহীদ শফিউর রহমানের পিতা।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক শাখা ‘ইউনেস্কো’ ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত প্যারিস বৈঠকে অমর শহীদ দিবস একুশে ফেব্র“য়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ইউনেস্কোর সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের একটি বিশিষ্ট অর্জন আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃতি লাভ করলো এবং বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের উজ্জল অধ্যায়টি বিশ্ব ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায়ে পরিণত হলো। ফলে ২০০০সাল থেকে বিশ্বের ১৮৮টি রাষ্ট্রে মাতৃভাষার দাবিতে সংগ্রামকৃত পূর্ব বাংলার দামাল ছেলেদের কথা উচ্চারিত হচ্ছে। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হচ্ছে সেই সব তরুণদের অবদানের কথা।
ঢাকার শহীদ মিনার এখন শুধু ঢাকার নয়, এই শহীদ মিনার এখন সারা বিশ্বের হয়ে উঠেছে নতুন নতুন সংগ্রামের পবিত্র স্মারক, বিজয়ের প্রতীক, অনুপ্রেরণার উৎস। মাতৃভাষা দিবসটি এখন শুধু বিশ্বের ২৫ কোটি বাংলা ভাষীর অমূল্য সম্পদ নয়, প্রায় ৬০০কোটি মানুষের আস্থার প্রতীক, সংগ্রামী চেতনার স্মারক।
একুশে ফেব্র“য়ারী পূর্ব বাংলায় যে অসম্ভবকে সম্ভব করেছে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে এখনো যে সব জনপদে মাতৃভাষার দাবীতে সংখ্যাহীন তরুণ-তরুনীরা সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছেন-বিশেষ করে বিশ্বায়নের এই কালে ২১শে ফেব্র“য়ারী তাদেরকে কোন অন্যায়ের নিকট মাথা না নোয়ানোর প্রত্যয়রূপে জাগ্রত রাখবে। একুশের ইতিহাস মূলত সাধারণ ছাত্রজনতার ইতিহাস। দেশের চিন্তাবিদ, বুদ্ধিজীবীরা তাদের যুক্তিবাদী সৃজনশীল লেখনী দ্বারা সমাজ জীবনে এর ক্ষেত্র রচনা করেন। বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদ ডক্টর মুহাম্মদ এনামুল হকের মতে ‘২১শে ফেব্র“য়ারী কোনো বিশেষ দিন, ক্ষণ বা তিথি নয়, একটি জাতির জীবন্ত ইতিহাস। এ ইতিহাস অগ্নিগর্ভ। যে সজীব ‘লাভা ¯্রাবক আগ্নেয়গিরি’ কখনও অন্তর্দাহে গর্জন করছে, আবার কখনো চারিদিকে অগ্নি ছড়াচ্ছে। সত্যিই এ ইতিহাস মৃত নয়, একেবারে জীবন্ত।’ ৫২ সালের ভাষা আন্দোলন শুধু মাতৃভাষাকে ঠিকিয়ে রাখার আন্দোলনই ছিল না; তা ছিল আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র নস্যাতের এক আপোষহীন সংগ্রাম। সত্যিকার অর্থে বাঙালির জাতীয়তাবোধ এবং স্বাধিকার চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকেই। সেই ভাষা আন্দোলনে বিজয়ী বাঙালি জাতি রক্তক্ষয়ী বহু আন্দোলনের ধাপ পেরিয়ে ১৯৭১ সালে নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে পেরেছে।
আজ স্বাধীনতার চুয়াল্লিশটি বসন্ত অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু বাঙালি জাতির স্বাধিকার ও নিজস্ব স্বকীয়তা-সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ভীনদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসী থাবার কবলে কোমলমতি শিশু-কিশোরদের মেধা ও চরিত্রকে নষ্ট করার অসম্ভব পাঁয়তারা চলছে। তবে আমাদের নিজস্ব মূল্যবোধ ও স্বকীয়তার ভিত্তিতে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম কোমলমতি শিশু কিশোরদের মেধাও প্রতিভার বিকাশে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। যা আজ সর্বমহলে প্রশংসিত হচ্ছে। দেশের তরুণ বুদ্ধিজীবী, খ্যাতিমান সাংবাদিক, কলামিস্ট ও লেখকরা সর্বোপরি দলমত নির্বিশেষে সকল মহল এগিয়ে আসলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য একটি সুন্দর, সাবলীল দেশ গঠন করা সম্ভব। পাশাপাশি আমাদের গণমাধ্যম সংস্কৃতি যেন ভীনদেশীদের কবলে লীন না হয়। আর এটাই হোক আমাদের এবারের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।